চাঁদাবাজি আর কমিশনের কাছে জিম্মি শরীয়তপুরের জেলেরা
মেঘনা নদীতে গুল্টি জাল ফেলছিলেন মোস্তাফা পাজাল (৬৪)। সাথে তার ছেলে ৩০ বছর বয়সী কালিম পাজাল। পরিশ্রান্ত শুকনো কণ্ঠে মোস্তাফা পাজাল বলেন, "বয়স অনেক অইছে। এ বয়সেও মাছ ধইরা খাইতে অয়। কি করুম বড় সংসার কাম না কইরা উপায় নাই। হেইয়ার পর নদীতে জাল পাত্তে গেলে এক খন্দে টাকা দিতে হয় ৮ থেকে ১০ হাজার।"
কাকে দিতে হয় প্রশ্নের উত্তরে স্থানীয় কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে মোস্তফা বলেন, "এদের টাকা না দিলে নদীতে বাইতে দেয় না। অহন জাল না পাতলে কি কইরা খাইমু। হেইলিগ্যা টাকা দেই। জাল বাইয়া দ্যাহা যায় দিন শ্যাশে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৭০০ বা ১হাজার টাহা পাই। হেই টাহা থিক্ক্যা আড়োতে শতকিরা ১০ টাহা রাইখ্যা দেয়।"
প্রশ্ন ছিল আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন বা ঋণ আনছেন? উত্তরে তিনি জানান, "না। টাহা আনোন লাগবো ক্যা। মাছ ব্যাচতে গেলে দিতেই অইবো। না দিলে ব্যাচতে পারুম না। উপায় নাই বাধ্য অইয়াই দেই। আমাগো দুক্খু দেহার কেউ তো নাই।"
মোস্তাফা পাজালের মতো শরীয়তপুরের জেলেরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন আড়ৎদার আর চাঁদাবাজদের কাছে। মাছের মূল্যের ১০ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত দিতে হয় আড়ৎদারকে। আর নদীতে মাছ ধরতে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের পরিমাণ চাঁদা নিচ্ছে আরেকটি চক্র। এছাড়া নৌপুলিশকেও দিতে হয় বিভিন্ন অঙ্কের চাঁদা, এমন অভিযোগ করছেন জেলেরা। অবশ্য এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নৌপুলিশের কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে মৎস্য কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসন বলছে আড়তে মাছ বিক্রি করতে গেলে চাঁদা বা কমিশন দেয়ার কোনো বিধান নেই।
গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর ইউনিয়নের ছৈয়ালপাড়া গ্রামের মোস্তাফা পাজাল জানান, দীর্ঘ জীবনে পদ্মা-মেঘনা চষে বেড়িয়েছেন। ধরেছেন নানান প্রজাতির মাছ। সেই মাছ বিক্রি করে চলেছে তাদের সংসার। নদীতে জাল ফেলতে কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি। বাঁধাও আসেনি কখনও। দিতে হয়নি কোনো টাকাকড়ি। কিন্তু দিনে-দিনে পাল্টে গেছে সেই পরিস্থিতি। এখন নদীতে নামলে দিতে হয় চাঁদা।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা ইউনিয়নের বোরোকাঠি গ্রামের জেলে আলম মিয়া বলেন, "আমি নদীতে গোচি জাল দিয়ে মাছ ধরি। বাইলা (বেলে) মাছ, ইচা (চিংড়ি) মাছ আর গুরাকারা মাছ পাই। বড় নৌকা বা বড় জাল কিছুই নাই তারপরও এই ছোট জাল পাততেও বছর বছর টাকা দিয়া আইছি। ধরেন আরো ১৫/২০ বছর আগে টাকা দেওয়া লাগে নাই, গত ১০/১২ বছর ধইরা এরকম শুরু হইছে। আমার মত অনেক জেলেকে এরকম টাকা দিয়া বছর পর বছর মাছ ধরতে হয়।"
অভিযুক্ত চাঁদা আদায়কারীদের একজন আমজাদ হাওলাদার। গোসাইরহাট উপজেলার ছৈয়ালপাড়া গ্রামে বাড়ি। দিনভর চরে থাকেন। ছোট একটি টিনের ঘরও আছে সেখানে। সেই চরের গিয়ে কথা হয় তার সাথে। আমজাদ হাওলাদারের দাবি ১০০ একর জমি রয়েছে তার। সেই জমির মধ্যে নদীও আছে।
তিনি বলেন, "জমির পাশে যে নদী তা আমাদের, তাই জেলের কাছ থেকে টাকা নেই। আমার জমিতে জাল ফেলবে আর আমাকে টাকা দেবে না এটা হয়! যে টাকা দেয় তারেই জাল ফেলতে দেই। টাকা না দিলে ফেলতে দেই না।"
ওই গ্রামের আরও একজন চাঁদা আদায়কারী আবুল মোল্লা। তিনিও টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেন। বলেন, "আমরাও এক সময় ২০/ ২৫ হাজার দিয়ে বাইছি। এখন মাছ নাই তাই জাল ফেলি না। ওহন আমারে দেয় কত ৫০০ বা ১ হাজার। জেলেরা ইচ্ছামতোই দিয়ে যায়। জোর জুলম করি না।"
এই বিষয়ে গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর ইউনিয়নের চেয়্যারমান মিজানুর রহমান সরদার বলেন, "এই অঞ্চলের নদী থেকে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি জেলেদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে এ ঘটনা সত্য। আমার কাছে অনেক জেলেই অভিযোগ দিয়েছে। আমি স্থানীয়ভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও করেছি কিন্তু সমাধান হয়নি। পরে উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েও কোন সমাধান পাইনি।"
তিনি আরো বলেন, "নানাভাবে এই অঞ্চলের জেলেরা নির্যাতিত। মাছ ধরতে গেলে যেমন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর কাছে জিম্মি থাকছে ,অভিযানের নামেও প্রশাসনের লোক বিভিন্ন উপায়ে অর্থ আদায় করছে। এছাড়া আড়তগুলোও কোন নিয়মনীতির মধ্যে চলছে না- এসব বিষয়ে সমাধান দরকার। আপনারা সরেজমিন একটি প্রতিবেদন করেন আমি আপনাদের প্রতিবেদনটি নিয়ে জোরালোভাবে বিষয়টি প্রশাসনের কাছে তুলে ধরব।"
পাকেরচরে বাড়ি ইব্রাহীম মোল্লার। নৌকা ঘাটে বাধা আর সব জাল ঘরে উঠিয়ে রেখেছেন।
ইব্রাহীম জানান, "টাকা দিতে পারি না এজন্য জালও ফেলতে দেয় না। এক খন্দে কেউ ৩ হাজার, কেউ ৫ হাজার এমন চাঁদা দাবি করে। কত জনের কথা বলুম? আর কতজনরেই দিমু? এই জন্যই জাল নৌকা গুটায়ে ঘরে বসে থাকি। সরকারের নদী, আমরা মাছ ধরতে পারি না- এমন দুঃখের কথা কার কাছে কই বলেন ভাই। এখন পাইলে কোন দিন কামলা খাটি, না পাইলে ধার দেনা করে চলি।"
মেঘনা তীরের পুরো গোসাইরহাটের এমন চিত্র। সাতপাড়, চরজালালপুর, মাঝেরচর, কুচাইপট্টি, ব্যারাকেরচর এলাকায় ঘুরে আবার ঘাটে ফেরার পথে কোদালপুর বড় একটি আড়তে নামলাম। জেলেরা মাছ নিয়ে আসছেন, সেই মাছ আড়তে কেনাবেচা হচ্ছে। জেলে আড়তদার আর পাইকারদের মাঝে কেনাবেচা। এমন একটি আড়ত সুলতান মৃধার। সেই আড়তে আড়তদার আর পাইকারের হাকডাক। একটি বড় আকারের পাঙ্গাসের দরদাম চলছে। ডাকাডাকি শেষে অবশেষে পাঙ্গাস মাছটি বিক্রি হলো ৯ হাজার টাকায়। পাইকার আড়তের সরকারের কাছে ৯ হাজার টাকা বুঝিয়ে দিলেন কিন্তু আড়তদার মাছ শিকারি মোঃ হানিফকে ৮ হাজার ১০০ টাকা দিলেন। বাকি ৯০০ টাকা রেখে দিলেন। এভাবে প্রতিটি আড়তেই জেলেদের কাছ থেকে বিক্রি ১০ শতাংশ হারে টাকা কেটে রাখছেন।
কথা হয় ওই আড়তের আড়দার সুলতান মৃধার সাথে। তিনি অকপটে স্বীকারও করলেন টাকা কেটে রাখার কথা। বললেন, "এটা সারা বাংলাদেশেরই নিয়ম। তাই আমরাও ৮ থেকে ১০ শতাংশ কেটে রাখি। আমাদের একটা খরচ আছে। আবার আমরা তো দাদনও দিয়েছি।" কিন্তু যাদের দাদন দেননি তাদের কাছ থেকে কেন কেটে নিচ্ছেন, এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
আরও কথা হয় আড়তদার রিয়াজ মুন্সির সাথে তিনি জানান, এই ঘাটে ২৬টি আড়ত রয়েছে। এখানে প্রতিদিন অন্তত ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার মাছ কেনাবেচা হয়। যার মধ্যে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা কমিশন কেটে রাখা হয়। তার কাছে প্রশ্ন ছিল জেলেদের কাছ থেকে কমিশন নেয়া হয় কেন এবং এর কোন বৈধতা আছে কি-না। তিনি বলেন, "সরকারি নিয়ম নেই কিন্তু আমরা আড়তদাররা জেলেদের দাদন দিয়েছি। তাই আমরা মাছ বিক্রির সময় জেলেদের কাছ থেকে একটা অংশ কেটে রাখি। সেটা কেউ ৫ শতাংশ, কেউ আবার কম বেশি।"
৩২ বছর বয়সী মোঃ ইউসুফ ঢালী জানান, "আমরা গুল্টি জাল দিয়ে মাছ শিকার করি। এ জাল বৈধ। তারপরও নৌপুলিশ আমাদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়। নৌকা প্রতি ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিয়ে থাকে। চাঁদা না দিলে ধরে নিয়ে যায়। পরে আরও বেশি টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়। আমাদের কোন পথ নাই, ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয়।"
এমন নিরব চাঁদাবাজি চললেও এসব চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধে নেই কোন পদক্ষেপ। নৌপুলিশের চাঁদা আদায়ের বিষয়ে কথা হয় নৌপুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন, "মা ইলিশ,অভয়াশ্রম ও জাটকা নিধন বন্ধসহ মাছ রক্ষায় বিভিন্ন অভিযানে নৌপুলিশ দায়িত্ব পালন করে। এছাড়া বছরের বাকি সময়গুলো অভিযান না চললেও বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ জাল, চায়না দুয়ারি এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চলে। এই ধরনের অপরাধ যদি করে তাহালে এসবের বিরুদ্ধেও মামলা করি। গত মাসেও (আগস্ট) ৬৬টি মামলা হয়েছে। আমাদের পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো করা হচ্ছে আমরা সব সময় প্রস্তুত আছি। জেলেদের নৌপুলিশের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে, তা লিখিত বা গোপনে আমাদের জানাতে পারে। কোন প্রকার অনিয়ম আমরা বরদাস্ত করব না। অপরাধ প্রমাণিত হলে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।"
নরসিংহপুর নৌফাঁড়ির ইনচার্জ মোঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, "আমাদের মূল দ্বায়িত্ব কাচিকাটি ইউনিয়ন। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে গোসাইরহাটের কোদালপুর পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বড় এলাকা কিন্তু লোকবল কম। আমরা কোন জেলে থেকে চাঁদা নেই না। অভিযানের সময় মৎস্য কর্মকর্তাদের সাথে দায়িত্ব পালন করি। আমাদের কথা বলে অন্য কেউ এ ধরনের কাজ করে থাকতে পারে।"
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল হক বলেন, "আড়তে মাছ বিক্রি করতে গেলে চাঁদা বা কমিশন দেয়ার কোনো বিধান নেই। এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর নদীতে মাছ শিকার করতে গেলে কাউকে চাঁদা দিতে হবে বা সরকারি ফি দিতে হবে এমন কোন নিয়ম নাই। সকল নদী, খাল, বিল জেলেদের জন্য উন্মুক্ত। জাল যার জলা তার এই নিয়মের ভিত্তিতেই সকল জেলে নদীতে সরকারি ফি ছাড়াই মাছ শিকার করতে পারবে। সেক্ষেত্রে যদি কেউ টাকা দাবি করে থাকে সেটা নিঃসন্দেহে অবৈধ। সেক্ষেত্রে কোন জেলে যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করে তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।"
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, "নদীতে জাল ফেললে জেলেদের কাছ থেকে কারো চাঁদা নেয়ার সুযোগ নেই আর আড়তদারদের ১০ শতাংশ কমিশন নেয়া এটাও বৈধ নয়। তাই বিষয়গুলো আমি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।"
মুন্সি মৎস্য আড়তের মালিক আদিল মুন্সি বলেন, "আমরা আড়তদার আমাদের এখানে কয়েকজন কাজ করে তাদের একটা শ্রম আছে সেজন্য খরচ হিসেবে আমাদের কিছু একটা অংশ রাখার বৈধতা প্রয়োজন। তবে এটাও ঠিক ভিন্ন ভিন্ন আড়তে কমিশনের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন আদায় করছে। কেউ কেউ বেশি পরিমাণেও নিচ্ছে। খামখেয়ালীও করছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি সমাধান করে দেয়া উচিত।"
কিন্তু মোস্তাফা পাজাল কি আশাবাদী হতে পারছেন?
"এর আগে আমাগো এই কথা হোনতে কোন মানুষ আহে নাই। আমনেরা আইছেন এখন সরকাররে যদি জানান তবে আমাগো থিকা চাঁদা নেওয়া বন্ধ হইবো আমরা নদীতে ইচ্ছামত জাল ফেলতে পারুম মাছ ধরতে পারুম", বলেন মোস্তাফা পাজাল।
জেলা মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, শরীয়তপুর জেলায় পদ্মা-মেঘনা মিলে নদীপথ রয়েছে ৭০ কিলোমিটার। আর নদীকেন্দ্রিক জেলে রয়েছে ৩৩ হাজার ৩৬৮ জন। শুধু পদ্মা-মেঘনা থেকে বছরে ১০ হাজার ৮০ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয়। যার মধ্যে শুধু ইলিশ রয়েছে ৫ হাজার ৬৭০ মেট্রিক টন। মাছ কেনাবেচার জন্য নদীতীরে আড়ত রয়েছে ১০১টি। এসব আড়তে কেনাবেচা হয়ে থাকে সব ধরনের মাছ। এতে বছরে লেনদেন হয় অন্তত ৫০০ কোটি টাকা।