খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন সহজ হবে অপচয় কমানো গেলে
রবিশস্যের কারণে শীতকালে খাদ্যশস্যের দামে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেলেও দেশে খাদ্য অপচয় নতুন একটি আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা যেমন হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি এক পর্যায়ে বেড়ে যাচ্ছে খাবারের দামও। এ সংকট রোধের উপায় হচ্ছে খাদ্য চেইনের প্রতিটি ধাপে — একেবারে মাঠ থেকে শুরু করে মুখে — অপচয় হ্রাস করা।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ সূচকে বাংলাদেশ শাকসবজি উৎপাদনে ১৪তম এবং চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। আর দেশে মাথাপিছু খাদ্য অপচয় প্রতি বছর ৬৫ কেজি। খাদ্য অপচয় বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে মানুষের জন্য উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশই অপচয় হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ধারণা অনুযায়ী, সারাবিশ্বে প্রায় ১৩০ কোটি মেট্রিক টন খাদ্য নষ্ট হয়, অর্থমূল্যের দিক থেকে যা প্রায় এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুসরণে বিশ্বজুড়ে দেশগুলো নিজেদের মতো করে খাদ্য অপচয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এসডিজির ১২.৩ নম্বর টার্গেটের উদ্দেশ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্যের ক্ষতি এবং অপচয় অর্ধেকে কমিয়ে আনা।
খাদ্যের অপচয় কমাতে বাংলাদেশও বেশ কিছু প্রকল্প শুরু করেছে। তবে এসব প্রকল্পের সম্মিলিত প্রভাব এসডিজি ২০৩০ অর্জনে যথেষ্ট নয় বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)-এর তথ্য বলছে, দেশে ফসলের মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতিবছর ৫০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্য অপচয় হয়। আর বাসা-বাড়িতে খাবার নষ্টের বার্ষিক পরিমাণ ১ দশমিক শূন্য ৭ কোটি মেট্রিক টন। সবমিলিয়ে বার্ষিক অপচয় ও নষ্ট হওয়া খাদ্যের মোট পরিমাণ এক কোটি ৫৭ লাখ মেট্রিক টন।
ফসলের উৎপাদন-পরবর্তী ক্ষতি (পোস্ট-হার্ভেস্ট লস) ও খাবার টেবিলে খাদ্যের অপচয় কমাতে সরকারের যে কয়েকটি চলমান উদ্যোগ রয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে মোট অপচয়ের মাত্র ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ রোধ করা সম্ভব বলে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে।
বিশ্বব্যাপী ৮ শতাংশ খাদ্য খামারে, ১৪ শতাংশ খামার থেকে খুচরা দোকানে পৌঁছাতে এবং ১৭ শতাংশ দোকান ও বাসা-বাড়িতে নষ্ট হয়।
খাদ্য সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানো, উৎপাদন-পরবর্তী ক্ষতি কমিয়ে আনাসহ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নের জন্য কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় বর্তমানে ৮টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। তবে এমনকি এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলেও খাদ্যের অপচয় কমবে কেবল নামমাত্র। আবার এগুলোর সুফল পেতেও অন্তত ২–৬ বছর পর্যন্ত সময় লাগবে।
এছাড়া জনসচেতনতা তৈরির মাধ্যমে খাবার টেবিলের অপচয় কমাতে সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও নেই। ফলে এসডিজি'র আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যের অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য থাকলেও গত নয় বছরে এ সংক্রান্ত অগ্রগতি পর্যালোচনার কোনো সূচক হালনাগাদ করতে পারেনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
খাদ্য অপচয় রোধে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাপরবর্তী সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যখন খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টির মতো নানা প্রকৃতিক দুর্যোগে সারাবিশ্বের ন্যায় দেশেও কৃষি উৎপাদন ব্যপকভাবে ব্যহত হচ্ছে, তখন ফসলের উৎপাদন-পরবর্তী ক্ষতি এবং খাবার টেবিলে অপচয় রোধে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো একেবারেই পিছিয়ে।
জানা গেছে, বাষ্পতাপ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলমূল ও কৃষিপণ্যের পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমাতে ঢাকার সাভারে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ৫০ কোটি টাকা খরচ করে দুটি বাষ্পতাপ প্ল্যান্ট তৈরি করছে।
দুটি প্ল্যান্টের সক্ষমতা অনুযায়ী প্রতি বছর ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আম ও অন্যান্য কৃষিপণ্যে বাষ্পতাপ প্রযুক্তি ব্যবহারে ট্রিটমেন্ট করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এতে এসব পণ্যের শেলফ লাইফ বাড়বে এবং পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমে আসবে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এ কার্যক্রম শুরু হতে আরও অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে।
বিএডিসি'র প্রকল্পটির সাবেক প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মাহবুবে আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগামী জুনের মধ্যেই [প্রকল্পটি] শেষ হবে এবং আমরা কৃষিপণ্যে বাষ্পতাপ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করতে পারব। এটি পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমানোর পাশাপাশি রপ্তানিতেও ভূমিকা রাখবে।'
ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে একই উদ্দেশ্যে আরও একটি প্রকল্পের কাজ মাত্রই শুরু করেছে বিনা। ১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ময়মনসিংহ সড়কের পাশে তৈরি করা হচ্ছে গামা ই-রেডিয়েশন সেন্টার। যেখানে বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন কৃষিপণ্য ও ফলমূলের ওপর এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু বর্তমানে প্রকল্পটির প্রয়োজনীয় যন্ত্র কেনা ও অবকাঠামো তৈরির দরপত্র আহ্বানের কাজ চলছে। প্রকল্প শেষ হতে অন্তত আরও দুই বছর সময় লাগতে পারে।
বিনা বলছে, পেঁয়াজ, আলু, সবজি, আম, কলা, লিচু, মশলা, মাছ, ড্রাই ফিসসহ বিভিন্ন পণ্যে বিকিরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমিয়ে আনা যাবে। এর মাধ্যমে প্রায় ৫৩ হাজার মেট্রিক টনের মতো পণ্যের অপচয় কমানো যাবে প্রতি বছর।
বিনা'র গবেষণার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজে ২০–২৫ শতাংশ, আমে ৩০–৩৫ শতাংশ, কলা, পেপে, পেয়ারা ও লিচুতে ২৫–৩০ শতাংশ, চালে ৮–৯ শতাংশ, ডালে ৬–৭ শতাংশ, আলুতে ১০ শতাংশ এবং আদায় পোস্ট-হার্ভেস্ট লস ৫–৭ শতাংশ। এই ১০টি পণ্যের বছরে মোট উৎপাদন হয় ৫২ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন। আর পোস্ট-হার্ভেস্ট লস হচ্ছে ৫ দশমিক ১৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
বিনা'র ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি হলেও গামা ই-রেডিয়েশন সেন্টারটি তৈরির কাজ শুরু করতেই তিন বছর লাগল। এটা আগামী দুই বছরে শেষ করতে পারব বলে আশা করছি।'
খামার যান্ত্রিকীকরণ হতে পারে দারুণ সহায়ক
এসব প্রকল্পের বাইরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাস্তবায়িত হচ্ছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প। তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটির মাধ্যমে সারাদেশে বীজ বপন থেকে শুরু করে মাড়াই পর্যন্ত সব কাজ যন্ত্রের মাধ্যমে করে কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ ও ১০–১৫ শতাংশ পর্যন্ত পোস্ট হার্ভেস্ট লস কমিয়ে আনাই এর বড় উদ্দ্যেশ্য। তবে নানা অনিয়মের অভিযোগে ইতোমধ্যেই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তবে প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম ২০২৩ সালের আমন মৌসুমে যন্ত্রের ব্যবহার বিষয়ে একটি ধারণা প্রদান করেন। তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৫৭ লাখ ৩০ হাজার ৭৬৪ হেক্টর জমিতে আবাদ করা আমনের ১১ দশমিক ২২ শতাংশ জমির রোপণ থেকে শুরু করে মাড়াই পর্যন্ত যন্ত্রের ব্যবস্থাপনায় করা হয়। এতে করে ২ দশমিক ১৮ লাখ মেট্রিক টন ধানের পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমিয়ে আনা গেছে। এ সক্ষমতায় বছরে প্রধান দুই মৌসুম আমন ও বোরোতে ৪ দশমিক ৩৬ লাখ মেট্রিক টন ধানের পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমানো সম্ভব।
এদিকে দানাদার খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ৮১টি ওয়ারহাউজের আধুনিকায়ন করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পার্টনার প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নই শুরু হয়নি।
এর বাইরে পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমিয়ে আনতে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যক্তি ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে কিছু প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি)। প্রতিষ্ঠানটি পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমিয়ে আনতে উৎপাদিত ফলমূল ও কৃষিপণ্যের প্রসেসিংয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রসেস করে একটি পণ্যের ভ্যালু অ্যড করার পাশাপাশি শেলফ লাইফও বাড়ানোর প্রযুক্তি সরবরাহ করছে উদ্যোক্তা ও কৃষকদের মধ্যে। তবে এটি ঠিক কী পরিমাণ ভ্যলু অ্যাড করছে এ ধরনের কোনো সমীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কাছে নেই।
বারি এ বিষয়ে প্রায় ৩০০ উদ্যোক্তাসহ মোট তিন হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এসব প্রশিক্ষণে কৃষিপণ্যের স্টোরিং, প্যাকেজিং, বাছাই, প্রসেসিংয়ের বিভিন্ন বিষয় শেখানো হয়েছে।
বারির পোস্ট-হার্ভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, 'আমরা আমাদের প্রযুক্তিগুলো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা ও আগ্রহী কৃষকদের দিয়ে থাকি। এখানে পোস্ট-হার্ভেস্ট লস, ফুড প্রসেসিংয়ের মতো কাজগুলোর ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।'
'এগুলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা দ্বারা বাস্তবায়িত উদ্যোগ। যেখানে বড় পরিসরে কেবল কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া কোনোটিই বর্তমানে পোস্ট হার্ভেস্ট লস কমানোয় কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না,' তিনি আরও বলেন।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ টিবিএসকে বলেন, 'কোন পর্যায়ে কী পরিমাণ কৃষিপণ্য নষ্ট হয় এ বিষয়ে সব তথ্য সংগ্রহ করে পরবর্তীসময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করব।'
অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়নাধীন ৩টি প্রকল্পের একটি হচ্ছে মোট দেড় লাখ টন ধারণক্ষমতার ৩০টি সাইলো নির্মাণ প্রকল্প। ২০২১ সালে শুরু হয়ে ২০২৪-এর ডিসেম্বরে এটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো পর্যন্ত মাত্র সাইলোর ড্রয়িং ও ডিজাইনের কাজ শেষ হয়েছে।
আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে দুর্যোগপ্রবণ ১৯টি জেলায় মোট আট লাখ পারিবারিক সাইলো বিতরণ করা হয়েছে। এই সাইলোগুলো মূলত দুর্যোগের পর পরিবারের দানাদার খাদ্যশস্য সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করার কথা। অন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন খাদ্য গুদাম তৈরি করে ১ দশমিক ৩৮ মেট্রিক টন লাখ ধারণক্ষমতা বাড়ানোর চলমান কাজ ২০২৬ সালে শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অথচ সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, প্যাকেজিং ও পরিবহনে বিভিন্ন সুপারিশের আলোকে ২০২০ সালে জাতীয় কৃষি নীতি নেওয়া হলেও এটি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে কৃষি বিভাগ থেকে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জনায়, জাতীয় কৃষি নীতিতে সংরক্ষণাগারের ঘাটতি, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ, উৎপাদন-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা, রেফ্রিজেরেটর ভ্যান ও হিমাগারকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে কৃষি প্রক্রিয়াকরণকে শক্তিশালী করার তাগিদ দেওয়া হয়।
পেঁয়াজ, শাকসবজির অপচয় রোধ করতে পারে সংরক্ষণাগার
জানা গেছে, উৎপাদিত খাদ্যের অপচয় কমানোর আরও একটি বড় উদ্যোগ ছিল সংরক্ষণ সক্ষমতার উন্নয়ন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রজেক্টের আওতায় হিমাগার তৈরিতে বিনিয়োগ সহজ করতে নীতিগত নানান সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি করা হলেও তার দৃশ্যমান কোনো ফল নেই।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, দেশে বেসরকারি হিমাগার রয়েছে ৪১৪টি, যার ৯৫ শতাংশ সক্ষমতাই ব্যবহার করা হয় আলু সংরক্ষণে। বাকি ৫ শতাংশ ফল ও মাছ সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। অথচ হিমাগার ব্যবস্থাপনার কারণে আলু যেভাবে সারা বছরের চাহিদা পূরণে ভুমিকা রাখছে, সেভাবে অন্য পণ্যগুলোর ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেত।
কৃষি অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, পেঁয়াজের যে ভারত-নির্ভরতা, তা কাটানোর সহজ সমাধান হচ্ছে সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা। কারণ ২৮ লাখ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে ৩৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন করেও পুরো বছরের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। পেঁয়াজের ২৫–৩০ শতাংশ পোস্ট-হার্ভেস্ট লসের কারণে ভারত থেকে ছয় লাখ মেট্রিক টনের মতো পেঁয়াজ প্রতি বছরই আমদানি করতে হয়।
বিনা'র গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর পেঁয়াজের পোস্ট-হার্ভেস্ট লস টাকার অংকে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, 'পেঁয়াজ সংরক্ষণের উপযোগী করে হিমাগার তৈরি করতে পারলে আমরা আলুর মতো সেলফ-সাফিসিয়েন্ট হতে পারব। এজন্য উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে প্রয়োজন প্রণোদনা দেওয়া।'
দেশে শীতকালে যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয়, গ্রীষ্মে তার দুই-তৃতীয়াংশ উৎপাদন কমে যায়। সবজির জন্যও বিশেষায়িত হিমাগার করতে পারলে অপচয় কমানোর পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা সম্ভব বলে জানান কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
খাদ্য অপচয় কমানো জরুরি: কৃষি অর্থনীতিবিদেরা
কৃষি অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্য উৎপাদনের তাল মেলাতে উৎপাদিত খাদ্য অপচয়ের হাত থেকে বাঁচানো জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ১১ বছরে ধান ও গমের মতো প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়ে গত অর্থবছর নাগাদ দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টনে। একই সময়ে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ হারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তৈরি হওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২০২৩ সালে সাত লাখ মেট্রিক টনের বেশি বিভিন্ন উৎপাদিত খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়েছে।
দেশে মূল্যস্ফীতিতে যখন ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠছে, তখন এ ঘটনা বাংলাদেশের মতো মধ্য-আয়ের দেশগুলোর জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনছে বলে মন্তব্য করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম খান।
তিনি বলেন, 'গৃহস্থালি পর্যায়ে রান্নার পর খাবারের অপচয়ের হার বাংলাদেশে প্রায় ২৫ শতাংশ। পল্লী অঞ্চলে নষ্ট হওয়া খাবারের একটা বড় অংশ হাঁসমুরগি ও গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হলেও শহরে বাড়তি খাবারের পুরোটাই চলে যাচ্ছে ডাস্টবিনে।'
কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হওয়ার মতো বৈশ্বিক ঘটনা এবং চরম আবহাওয়ার প্রভাবে ঘন ঘন ফসলের ক্ষতি চীন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলোকে খাদ্য অপচয় রোধে তাদের আইন কঠোর করতে জোরদার পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে।
লোহিত সাগরের সংঘাত শুরুর পর বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহকে আরও ব্যাহত করতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্রমহ্রাসমান প্রবণতাকে ধীর করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে খাদ্যের অপচয় কমানোর আহ্বান আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
বিবিএস ২০২৩ সালের খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ২১ শতাংশেরও বেশি জনসংখ্যা মাঝারি বা গুরুতর (১ শতাংশের কম) খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, খাদ্য অপচয় কমাতে এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা কমাতে দেশকে এর প্রচেষ্টা আরও ত্বরান্বিত করতে হবে।