মিয়ানমার সংঘাত: জনবল সংকটে সেন্টমার্টিনের একমাত্র হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে শঙ্কা
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের আঁচ আরও প্রকট হয়ে পড়ছে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। সংঘাতের কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতায় দ্বীপটিতে স্বাভাবিক সময়ের মতো পর্যাপ্ত ঔষধপত্র ও চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। সেই সঙ্গে চিকিৎসাসেবা বিষয়ক একটি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এটির নবায়ন নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নাফ নদীতে সেন্টমার্টিনগামী নৌযান লক্ষ্য করে গত ৫, ৮ ও ১১ জুন মিয়ানমারের একটি অজ্ঞাত সশস্ত্র গোষ্ঠী তিন দফায় গুলিবর্ষণ করার পর থেকে নৌপথটিতে স্বাভাবিক নৌ-চলাচল এখনো বন্ধ রয়েছে।
বর্তমানে বিশেষ ও জরুরি প্রয়োজনে বিকল্পপথে সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে নৌ-চলাচল। এর মধ্যে দ্বীপটির চিকিৎসা সেবা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্যবিভাগ সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য বলছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দার জন্য কেবল সেন্টমার্টিন ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। হাসপাতালটিতে একজন মেডিক্যাল অফিসার, একজন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার, একজন মিডওয়াইফ রয়েছেন।
অন্যদিকে ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাত্র একজন অফিস সহায়ক কর্মরত আছেন। এ স্বল্প সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় ২০২০ সালের মার্চ থেকে স্বাস্থ্য ও লিঙ্গ সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬ জন এনজিও কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে হাসপাতালটি চালু রাখা হয়।
আগামী ৩০ জুন প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তাই হাসপাতালটিতে কর্মরত এনজিওর কর্মকর্তা কর্মচারীরাও এ সময়ের পর আর থাকছেন না। ফলে দ্বীপটির চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম জানান, এ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। অসুখ একটু জটিল হলেই টেকনাফ বা কক্সবাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে জনবল না থাকলে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও পাওয়া যাবে না।
এ পরিস্থিতিতে দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সরকারের কাছে সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রনয় রুদ্র জানান, টেকনাফ সীমান্তে মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী বাহিনীর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে প্রায়ই মর্টার শেল নিক্ষেপ ও গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। মাঝে মাঝে ওপারের গুলি নাফ নদীতেও এসে পড়ে। তাই নাফ নদী দিয়ে সেন্টমার্টিন রুটের সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
তিনি জানান, বিকল্প পথে সীমিত পরিসরে নৌযান চললেও স্বাভাবিক পরিস্থিতির মতো খাদ্যদ্রব্য ও ঔষধ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে খাদ্যদ্রব্য ও ঔষধপত্রের কিছুটা অভাব রয়েছে। এর মধ্যে আগামী ৩০ জুন এনজিওর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে এনজিওর ওই ১৬ জনও আর থাকবেন না। এতে চিকিৎসা সেবা বিঘ্নিত হবে।
বিষয়টি ইতিমধ্যে লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আসিফ আহমেদ হাওলাদার জানান, এনজিওর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। খুব দ্রুতই এ বিষয়ে একটি সুখবর পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের জেরে গত ১ জুন বিকেলে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা হওয়া পণ্যসহ ১০ যাত্রীর এক ট্রলারকে লক্ষ্য করে নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে গুলি ছোঁড়া হয়।
এছাড়া গত ৫ জুন সেন্টমার্টিনের স্থগিত হওয়া একটি কেন্দ্রে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদের ফলাফল নির্ধারণের জন্য ভোটগ্রহণ করা হয়। আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফেরার পথে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রলারকে লক্ষ্য করে একই পয়েন্টে ফের গুলি করা হয়।
গত ৮ জুন আরও এক ট্রলারকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয় একই পয়েন্টে। সর্বশেষ ১১ জুন একটি স্পিড বোটকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ হয়।
প্রতিটি এই গুলিবর্ষণের ঘটনাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলসীমায় ঘটেছে। গুলিবর্ষণের এসব ঘটনায় হতাহতের না হলেও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে দ্বীপে খাদ্য সংকট ও জরুরি আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
১২ জুন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের জরুরি সভায় বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করে যাত্রীদের আসা-যাওয়া ও পণ্য নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৩ জুন থেকে টেকনাফের সাবরাং মুন্ডার ডেইল উপকূল ব্যবহার করে শুরু হয় যাত্রীদের আসা-যাওয়া। পরদিন ১৪ জুন কক্সবাজার শহর থেকে দ্বীপে পণ্য নিয়ে যায় জাহাজ।