সাদিক অ্যাগ্রোর দুটি খামারের বেশিরভাগটাই ছিল অবৈধ জায়গায়
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় সাদিক অ্যাগ্রোর দুটি খামারের অবৈধ অংশ ভেঙে দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। আজ বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে এ অভিযান চালানো হয়।
এরমধ্যে একটি খামার গড়ে তোলা হয় সাতমসজিদ হাউজিংয়ের ১ নম্বর সড়কের শেষে রামচন্দ্রপুর খালের পাড়ে। দ্বিতীয় খামারটি হলো মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সড়কের পাশে নবীনগর হাউজিং এলাকায়।
সাতমসজিদ হাউজিংয়ে অবস্থিত খামারটির জন্য মাত্র পৌনে ৫ শতক জমি ভাড়া নেওয়া হয়। তবে রামচন্দ্রপুর খালের আরও প্রায় ১৫ শতক জায়গা দখলে নিয়ে মোট ২০ শতক জায়গার ওপর এটি গড়ে তোলা হয়।
উচ্ছেদের সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "আমরা সকালে এখানে অভিযানে আসলে সাদিক অ্যাগ্রো থেকে দাবি করা হয় ভবনটির বৈধ কাগজপত্র আছে। এরপরে আমরা আবার কাগজপত্র মিলিয়ে দেখি, কিন্তু আমরা দেখতে পাই (খামারের) ভবনটি খালের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে।"
সরেজমিনে দেখা যায়, এই খামারের অস্থায়ী শেড ও একটি ভবন ছিল খালের জায়গায়। দখলের পরে এই বর্ষাকালেও খালে কোনো পানির প্রবাহ নেই। একেবারে সরু একটি নালায় পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারটি পুরোটাই অবৈধ জায়গায়। স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের প্রায় ৩৩ শতক (এক বিঘা) জমিতে গড়ে তোলা হয় এই খামার।
ঈদুল আজহার আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনার ঘটনায় আলোচনায় আসেন মতিউর। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে থেকে তিনি বিপুল সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন করেছেন, উঠতে শুরু করে এমন অভিযোগ।
একইসঙ্গে এই ছাগলকাণ্ডে সাদিক অ্যাগ্রোকে নিয়েও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতে থাকে। খালের অংশ দখলে নিয়ে খামার গড়ে তোলার বিষয়টিও এরপর সামনে আসে।
এদিকে খালের জায়গা ও সিটি করপোরেশনের জমি দখল করে দীর্ঘদিন খামার পরিচালনা করে আসলেও, এর আগের উচ্ছেদ অভিযানগুলোয় কোনো আঁচড় পড়েনি সাদিক অ্যাগ্রোতে। কেন এমনটা হলো সঙ্গতকারণেই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এর আগে ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি সাদিক অ্যাগ্রোর সাতমসজিদ হাউজিংয়ের খামার থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরত্বের বসিলায় অবৈধভাবে দখল হওয়া লাউতলা খালকে দখলমুক্ত করতে অভিযান চালায় ডিএনসিসি। যেখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ট্রাক টার্মিনাল উচ্ছেদ করা হয় উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে।
সম্প্রতি গত ২৩ জানুয়ারি লাউতলা খালের কাছের আরও একটি অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে ঢাকা উত্তর। তখন খাল দখল করে ১০তলা একটি নির্মানাধীন ভবন ভেঙে ফেলা হয়।
কিন্তু অবৈধভাবে খাল দখল করে গড়ে তোলা সাদিক অ্যাগ্রো তখনও ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন সময় সাদিক অ্যাগ্রোর দখলদারি নিয়ে মিডিয়ায় নিউজ কিংবা ঢাকা উত্তর খালের সীমানা নির্ধারণ করলেও তা উদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়নি সিটি করপোরেশন। যদিও ডিএনসিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা এবছরে ঈদুল আজহার আগেই সাদিক অ্যাগ্রোকে নোটিশ পাঠিয়েছিলেন।
ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৫ এর নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের অভিযান কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান নয়, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে। সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনকে ঈদের আগেও আমরা নোটিশ দিয়েছি। অবৈধ স্থাপনা থাকলে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। আমরা ঈদের আগে উচ্ছেদ অভিযান করিনি, কারণ এর ফলে (কোরবানির পশুর) বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত। আমরা এমনটা চাইনি বলে উচ্ছেদে যাইনি। কিন্তু সেই নোটিশ পেয়েও কোনো ব্যবস্থা নেননি ইমরান।"
ঢাকা উত্তর সিটির জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবারের অভিযানে ৬০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এতে প্রায় ১০ বিঘা জমি জমি দখলমুক্ত করা হয়।
সাদিক অ্যাগ্রোর খামারের পেছনের অংশেই খাল ভরাট করা জায়গায় রিকশার গ্যারেজ ও বস্তিঘরের মতো বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনাও ছিল। অভিযানে এগুলো উচ্ছেদ করা হয়।
সাদিক আগ্রোর রামচন্দ্রপুর খালের অংশ দখলে নেয়ার কথা উল্লেখ করে মোতাকাব্বির আরও জানান, "এখানে বড় একটি অংশে গরুর শেড ও একটি অংশ রিকশার গ্যারেজ বলে দখল করে রাখা হয়েছিল। খালের প্রবাহিকার ৩০ ফিটের ভেতরে কোনো স্থাপনা থাকতে পারবে না এই নীতিমালা রয়েছে। জমির মালিক কাগজ দেখিয়েছেন ৪.৮৬ শতাংশের। কিন্তু (খালের জায়গা) দখল করেছেন আরও বেশি।"
জানা যায়, সাতমসজিদ হাউজিংয়ে অবস্থিত খামারটির জমির মালিক হলেন জনৈক আব্দুল রশিদ তালুকদার। তবে এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁর ভাই আব্দুল আলীম। তাঁর থেকে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে পৌনে পাঁচ শতক জমি ভাড়া নেন সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন । এরপরে রামচন্দ্রপুর খালের আরও ১৫ শতাংশ জায়গা দখল নিয়ে সেখানে গবাদিপশুর শেড তৈরি করেছিলেন।
চলতি বছরের ১ এপ্রিল আরও তিন বছরের জন্য জমির ইজারা চুক্তির নবায়ন করেন ইমরান।
আব্দুল আলীম টিবিএসকে বলেন, "(ভাড়া দেওয়া) জমির পরিমাণ ৪.৮৬ শতক। এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সিটি করপোরেশন কর্তৃক জমির সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল।"
এরপর দুপুর সোয়া দুইটার দিকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সড়কের পাশে নবীনগর হাউজিং এলাকার ৭ নম্বর সড়কে সাদিক অ্যাগ্রোর অপর খামারে অভিযান শুরু হয়। এই উচ্ছেদ অভিযানে সড়কের প্রায় ৩৩ শতাংশ জায়গা দখল করে গড়ে তোলা খামারটি ভেঙে দেওয়া হয়।
সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ)-র সভাপতি। খামারের সঙ্গেই অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয় ছিল। অভিযানে কার্যালয়টিও ভাঙা পড়ে।
ইমরান হোসেন বলেন, "আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যখন খালগুলোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন পায়, তখন ভবন খালের বাইরে আছে এমনটাই জানিয়েছিল জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। যদিও ভবন আমার না, আমি ভাড়াটিয়া।"
তিনি আরও বলেন, "আমি এই জমিতে ভাড়ায় ছিলাম, তাই উচ্ছেদ অভিযানে আমার কিছু যায় আসে না। আমি অন্য জায়গায় চলে যাব। জায়গার মালিক শেড করেছেন, আমি নিচতলা ভাড়া নিয়েছি। খাল ভরাটসহ যা কিছু বলা হচ্ছে, সবই মালিকের করা।"