তীব্র গ্যাস সংকটে বিপাকে দেশের সিরামিক শিল্প
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান গ্যাস সংকটে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের সিরামিক শিল্প। গ্যাসের ঘাটিতে অনেক কারখানায় নিষ্ক্রিয় পড়ে আছে যন্ত্রপাতি, অনেক কারখানা পৌঁছেছে বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
দেশে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল শিল্পগুলো দীর্ঘদিন ধরেই জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হয়ে আসছে। তবে গত এক মাস আগে থেকে ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার পর থেকে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে।
গত ২৬ মে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। রিমালের কারণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের একটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তখন থেকেই সিরামিক কারখানাগুলো তীব্র গ্যাস-সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত টার্মিনালটিতে বর্তমানে মেরামতের কাজ চলছে। এটি সম্পূর্ণভাবে ঠিক হতে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জানা গেছে।
এদিকে, সিরামিক শিল্পকে বাঁচাতে গ্যাস সংকট সমাধানে গত ২৬ জুন শিল্প, বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী; প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা এবং এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, 'গত প্রায় ১ মাস ধরে মিরপুর সাভার, ধামরাই, গাজীপুর, নরসিংদীর ময়মনসিংহে অবস্থিত ২২ থেকে ২৫টি সিরামিক তৈজসপত্র, টাইলস্, স্যানিটারিওয়্যার ও সিরামিক ব্রিকস্ কারখানায় তীব্র গ্যাস সংকট বিরাজ করছে। একটি কারখানায় যেখানে যেখানে ১৫ পিএসআই প্রেসার প্রয়োজন হয়, সেখানে গ্যাসের প্রেসার কখনও কখনও ২/৩ পিএসআই থেকে শূন্যের কোঠায় পর্যন্ত নেমে আসছে। ফলে ক্যাপাসিটির বড় অংশ অব্যবহৃত থাকছে। এসব কারখানায় দৈনিক ২০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে।'
চিঠিতে আরও বলা হয়, 'সিরামিক পণ্য উৎপাদনে কিলন (Kiln) বা চুল্লিতে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহ থাকতে হয়। সিরামিক পণ্য পোড়াতে কিলনে ১২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ফায়ারিং করা হয়। নির্দিষ্ট মাত্রার (কমপক্ষে ১৫ পিএসআই) প্রেশার ছাড়া কোনোভাবেই চুল্লিতে উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।'
'গ্যাসের প্রেসার কমে গেলে কিলন এর মধ্যে প্রক্রিয়ায় থাকা সব পণ্য তৎক্ষনাৎ নষ্ট হয়ে যায়। এই কিলন একবার বন্ধ করে পুণরায় পূর্ণমাত্রায় চালু করতে সর্বনিম্ন ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা দরকার হয়। অনেক সময় এই কিলন যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কারখানার বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। ফলে এ খাতের কোম্পানিগুলোর ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে,' বলা হয় চিঠিতে।
এ খাতের কোম্পানিগুলোকে বাঁচাতে গ্যাস সংকট সমাধানে উদ্যোগ নিতে মন্ত্রীদের সহায়তা চেয়েছে সংগঠনটি।
বিপাকে উৎপাদকরা
দেশে সিরামিকস উৎপাদনে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গ্রেটওয়াল সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির গাজীপুরের টাইলস কারখানার সক্ষমতা ১.৫ কোটি স্কয়ার ফিট। তবে গ্যাস সংকটের কারণে গত একমাস ধরে গ্রেটওয়াল টাইলসের উৎপাদনের একটি বড় অংশই বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং গ্রেট ওয়াল সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুল হুদা টিবিএসকে বলেন, "গ্যাসের চাপ কম থাকায় আমরা এখন তিন শিফটের বদলে শুধু এক শিফটে কারখানা চালাচ্ছি। লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন খরচও বেড়েছে ৩০ শতাংশ।"
গাজীপুরের মাওনায় দেশের আরেক বৃহৎ টাইলস, স্যানিটারি ওয়্যার ও টেবিলওয়্যার উৎপাদনকারী কারখানা আরএকে সিরামিকস। গত এক সপ্তাহে গ্যাস সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটি সর্বোচ্চ ৫৫ শতাংশ ক্যাপাসিটি ব্যবহার করতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন এর কর্মকর্তারা।
আরএকে সিরামিকসের কোম্পানি সচিব মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গ্যাসের প্রেশার ১৫ পিএসআইয়ের বেশি থাকতে হয়। অধিকাংশ সময়ই আমরা তা পাই না। গ্যাস দিয়ে কারখানার জন্য যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়, সে ক্যাপটিভ পাওয়ারও দিনের একটি বড় সময় বন্ধ থাকে। ফলে কারখানার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।"
ঢাকার পাশেই ধামরাইতে কারখানা দেশের নেতৃত্বস্থানীয় টেবিলওয়্যার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মুন্নু সিরামিকসের। সিরামিকস পণ্য রপ্তানিতেও দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান মুন্নু সিরামিকস। তবে গ্যাস সমস্যার কারণে এখন তাদের কারখানার প্রায় ৪০ শতাংশ সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
মুন্নু সিরামিকসের হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট খন্দকার ফয়েজ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "পাইপ লাইনে গ্যাস নেই। গ্যাস আসলেও সেটার প্রেশার ৩-৪ পিএসআইয়ের বেশি হয় না। যদিও আমাদের চুল্লি সচল রাখতে ১২ পিএসআই দরকার হয়। বিকল্প হিসাবে আমরা সিএনজি ব্যবহার করছি। তবে সিএনজির পাওয়ার ন্যাচারাল গ্যাসের তুলনায় কম হওয়ায় প্রেশার ৮-৯ এর বেশি ওঠানো যায় না।
"এসব কারণে আমরা এখন সক্ষমতার ৫০-৬০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছি না। তবে ফ্যাক্টরি পূর্ণমাত্রায় চালু রাখতে হচ্ছে। ফলে ব্যয় বাড়ছে," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং এফএআরআর সিরামিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "২০১৯ সাল থেকে তিন দফায় গ্যাসের দাম প্রায় ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচমালের দাম ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়েছে। ডলার বিনিময় হারের কারণে আরও ৪০ শতাংশ বেড়েছে খরচ। স্থানীয় বাজারে বিক্রিতে ডেলিভারি চার্জ, মার্কেটিং কস্ট, শ্রমিকদের খরচও বেড়েছে। তবে পণ্যের দাম বাড়েনি।"
"অন্যদিকে গ্যাস সংকটের কারণে কারখানাগুলোকে উৎপাদনে না থেকেও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাজারে এই খাতের টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে," যোগ করেন তিনি।