'প্রথমে কল করে জানান, আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে; পরের কলে বললেন, মারা গেছে'
জুমার নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় ছেলেটা বলে গেল শ্বশুর বাড়ি যাবে। আমি বললাম, "সাবধানে যাইস। বাসার পাশেই মসজিদ। রাস্তার এপার-ওপার। নামাজ পড়ে বের হয় আমার মানিক। সাথে ছিল দুই বন্ধু। একজনের পায়ে গুলি লাগে। তবুও দুইজন কোনোরকম দৌড়ে আসতে পারলেও আমার পাখিটা আর উঠতে পারে নাই। পিঠ দিয়ে বুলেট ঢুকে পেটে দয়ে বের হয়। রাস্তায় নাকি কেউ ভয়ে তার লাশ ধরেনি।"
সোমবার (২৯ জুলাই) ভাঙা টিনের চালার ঘরের সামনে গুলিবিদ্ধ নিহত সন্তানের ছবি দেখে এভাবেই আহাজারি করছিলেন এক মা। গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) কারফিউর দিনে ঢাকার সাভারের রেডিও কলোনিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাইমন ইসলাম আল আমিন।
সাইমন ইসলাম আল আমিন (২৩) কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর মধ্যপাড়ার মো. বাবুল ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির মেজ ছেলে। তিনি সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। একই এলাকায় একটি নতুন কাজ পেয়েছেন। বাবা গাজীপুরে কাজ করতেন। ১৯ জুলাই (শুক্রবার) নিহত হওয়ার পর শনিবার তার লাশ দাফন করা হয় নানার বাড়ি বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাকে দাফন করা হয়।
বরুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আল আমিনের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, "আমাদের বাসা সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায়। মসজিদ আমাদের বাসা থেকে সামান্য দূরে। রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। ছেলেটা রাস্তা পার হয়ে জুমার নামাজ পড়তে যায়। নামাজ শেষে ফিরছিল বাসায়। নামাজ শেষে বাসা থেকে গুলির শব্দ শুনে বের হই। সামনেই রাস্তার মোড়ে পাম্পের সামনে লোকজন জড়ো হয়ে আছে। আমি দেখে চলে আসি।"
তিনি আরো বলেন, "আমার মনটা কেমন কেমন জানি করছিল। আবার বাসায় ফিরি। কিছুক্ষণ পর তার এক বন্ধু কল দিয়ে বলল, 'আল আমিন গুলিবিদ্ধ হয়েছে'। তখন মনে হয়েছিল মানুষ আমার ছেলেকে পড়ে যেতে দেখেই দূরে গিয়ে জড়ো হয়েছিল। আমি বাসা থেকে বের হতে হতে আরেকটা কল আসে। হাসপাতাল থেকে করা অচেনা ওই নম্বর থেকে বলছিল, খালাম্মা আল আমিন মারা গেছেন! এসময় চারদিকে আর্তনাদের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি দৌড়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি পাখিটার রক্তাক্ত শরীর পড়ে আছে। যেন হাসছিল আমাকে দেখে।"
আল আমিনের বাবা মো. বাবুল বলেন, "ঘটনার পর আমাকে কেউ একজন কল দিয়ে বলেন, 'আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি'। আরেকজন এই নম্বরেই বলেন, 'মারা গেছে'। আমি তখন কর্মস্থল গাজীপুরে। আমি বিশ্বাস করিনি। কারণ সকালে আল আমিনের সঙ্গে কথা হয়েছে। ছেলেটা আমাকে কত অনুরোধ করে বলেছিল যেন বের না হই। আমিও বের না হওয়ার ওয়াদা করি। কিন্তু আমি বের নাহলেও ছেলেটা বের হয়। তার লাশ নিয়ে বাড়ি আসলাম।"
এসময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলতে থাকেন, "আমার ছেলে রাজনীতি করে না। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে আর পড়াশোনা করেনি। আবার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরিকল্পনা ছিল। ছেলেটা নামাজে গেছে। তার কি অন্যায় ছিল? কোন দোষে তাকে গুলি মারা হলো?"
বুক চাপড়ে আহাজারি করে আল আমিনের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, "ঘরের পাখিকে ২৩ বছর না খেয়ে না পরে বাঁচিয়ে রেখেছি। টাকা পয়সার জন্য বাবুটারে পড়াশোনা করাতে পারিনি। পরে কাজ করতে যায়। জুলাই মাসের দুই তারিখে কাজে গিয়ে মাইনে পাওয়ার আগেই মারা গেছে। ইচ্ছে ছিল বড় ভাইয়ের প্রবাসে যাওয়ার ঋণ শোধ করে আবার পড়াশোনা করবে। ভালো চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ধরবে। গত ৫ মাস আগে বিয়ে করেছে। বউটাকে আর তুলে আনতে পারে নাই। এর আগেই আমার ছেলেটা মারা গেল।"
তিনি জানান, আন্দোলনকারীদের পাশেই ছিলেন আল আমিন। তার পিঠে গুলি লেগে নাভির ওপর দিয়ে বের হয়ে গেছে। সারারাত কোনো অ্যাম্বুলেন্স খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে শনিবার ভোরে কুমিল্লার লাকসাম থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স গিয়ে তার লাশ আনে। পরদিন সকাল ১০টায় ময়নাতদন্ত ও পুলিশ রিপোর্ট ছাড়াই তার লাশ দাফন করা হয়।
মনোয়ারা বেগম বলেন, "সেদিন তেমন কোনো ঝামেলা হয়নি। আমার ছেলেটাকে কেন মারল? আমার ছেলে আন্দোলনও করেনি, সংগ্রামও করেনি। নামাজ পড়তে গেছে। আর লাশ হয়ে ফিরেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে আমাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু এতে কি আমার ছেলে আর ফিরে আসবে?"