বাংলাদেশের জাগ্রত প্রহরীদের কারণে ‘ঢাকা যেন নতুন গোথাম’
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সাইদ বিপ্রো ও তার প্রতিবেশীরা নিরাপত্তার কাজে নিজেরাই মাঠে নেমে পড়েছেন। লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মধ্যে পুলিশ যখন আত্মগোপনে, তখন লাঠিসোঁটা, ক্রিকেট ব্যাট, যার যা আছে তা নিয়েই নিরাপত্তার কাজে বের হয়ে পড়েছেন তারা।
৩৩ বছর বয়সী বিপ্রো বলছেন "ঢাকা এখন গোথামের মতো হয়ে উঠেছে।" পশ্চিমা সাহিত্যের কমিকস বইয়ের সুপার হিরোদের শহরের নাম হলো গোথাম। আর এ গোথামের সঙ্গে ঢাকার তুলনা দিলেন বিপ্রো।
বিপ্রো এখন প্রতি রাতেই এলাকার কয়েক ডজন লোকের সঙ্গে গাড়ি তল্লাশি, অপরিচিতদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং সন্দেহভাজন অপরাধীদের দমন করে চলেছেন। তিনি বলেন, "আমাদের এখানে কোনো আইন-শৃঙ্খলা নেই। আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেকেই করতে হবে।"
বাংলাদেশ ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ। দেশজুড়ে মানুষ এখন নিজেদের এলাকায় পাহারা দিচ্ছে।
গত মাসে প্রতিবাদী ছাত্রদের ওপর হামলা চালানোর নির্দেশ দেয় শেখ হাসিনা। তার নির্দেশে পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা আন্দোলন দমনে সহিংসতা চালায়। এতে প্রাণ হারায় প্রায় ৫০০ জন। এ হামলা আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেয়, যা হাসিনাকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ও পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। তার পতনের পর ক্ষোভ থেকে পুলিশের ওপরও হামলা হতে থাকে। যার কারণে প্রতিশোধমূলক এ হামলার ভয়ে তারা দায়িত্ব ত্যাগ করে গাঁ ঢাকা দিতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো দেশের আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা।
মাঠে পুলিশের অনুপস্থিতির কারণে সামরিক বাহিনী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এমন সেব্চ্ছাসেবক, ছাত্র ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। এ স্বেচ্ছাসেবকরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুর করে এলাকা পাহারা দেওয়ার মতো দায়িত্বও পালন করছে। বর্তমনার পরিস্থিতে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা রাতেবেলা টহল দেওয়াকে নাগরিক দায়িত্ব হিসেবে দেখছেন।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং নতুন করে সহিংসতা দেখা দিতে পারে। আর এ সহিংসতা ড. ইউনুসের সরকারকে অস্থিতিশীল অবস্থায় ফেলে দিবে এবং দেশকে আরো কঠিন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটের দিকে ঠেলে দিবে।
ঢাকার গবেষণা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভার্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, "শেখ হাসিনার পতন ছিল 'একটি বিশাল জয়'। কিন্তু বিপ্লবের নামে স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে দেশ চালানো, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ খুবই বিপজ্জনক। এটি আমার বা ছাত্রদের বা সাধারণ জনগণের কাজ নয়।"
রাত বারোটার পর মোহাম্মদপুরের ব্যস্ত রাস্তাগুলো যখন নীরব হয়ে যায় এবং দোকান বন্ধ হয়ে যায় তখন বিপ্রোর মতো আরো অনেক বাসিন্দা তাদের বাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে আসেন। তারা রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান নেন এবং গাড়ি ও রিকশা যাত্রীদের থামিয়ে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এলাকার নারীরাও তাদের সঙ্গে যোগদেন এবং ছোট ছেলেপেলেরা রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে নামেন। এসময় এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে।
মোহাম্মদপুরের ৩৮ বছর বয়সী আরেক বাসিন্দা সৈয়দ সিয়াম বলেন, "এই পরিস্থিতি আমাদের বন্ধনকে আরও মজবুত করেছে। আমরা সবাই মানুষের সেবা করতে এখানে আছি। আমরা বাংলাদেশকে সেবা করতে চাই এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই।"
কিন্তু মানুষের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাতের ক্ষত এখনও তাজা, এবং এ রাগ যেন অল্পতেই জেগে উঠতে পারে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা জানান, গত মাসে আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন এক ১৮ বছর বয়স তরুণ। তার মৃত্যুর সময় পুলিশের গুল ল্যাম্পপোস্টে এসেও লাগে। সেই রাতে পুলিশের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ প্রতিবেদককে দেখান বাসিন্দারা।
সরকার পতনের পর, কাছেই এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং সেদিনের ঘটনার পর থেকে এলাকার পরিচিত দলীয় সদস্যদের আর দেখা যায়নি।
টহল দেওয়া বাসিন্দাদের মধ্যে ৪২ বছর বয়সী শহিদুল ইসলাম বলেন, "১৫ বছর ধরে তারা জনগণকে অত্যাচার করেছে। তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হবে। মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে। আমরা চেষ্টা করছি মানুষের এ প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতাকে কমিয়ে আনার।"
মোহাম্মদপুরবাসীরা যুক্তিদেন যে পুলিশ না থাকায়, আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।
কিছুদিন আগেই স্থানীয়রা তিন ব্যক্তির একটি দলকে আটক করে। তল্লাশি চালিয়ে তাদের একজনের কাছ থেকে ছুরি পাওয়া যায় বলে দাবি করেন তারা। পরে ওই ব্যক্তিদের মারধরে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। পরে সকালে সেই ব্যক্তিদের সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
বিপ্রো সেই ঘটনার সময় না থাকলেও বলেন, "বাসিন্দারা শুধুমাত্র 'আত্মরক্ষার' জন্য মারধর করেন এবং আমরা সবসময় দলে ভারি হয়ে তাদের বেঁধে ফেলার চেষ্টা করি। আমরা পুলিশের চেয়ে সৎভাবে ভালো কাজ করছি।"
৫২ বছর বয়সী আরেক বাসিন্দা খালিদ উসমানি বলেন, তার জীবদ্দশায় বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে বাসিন্দাদের এমন উদ্যোগের কারণে আমাদের কেউ স্পর্শ করতে পারবেনা।
কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা এ এন এম মুনিরুজ্জামান সতর্ক করেছেন, "এ নিরাপত্তা পরিস্থিতি 'টেকসই নয়'।' তিনি বলেন, "দেশে একটি নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। আমরা এখনো দেখছি, ছাত্ররা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা প্রয়োজন। পুলিশদের নিজ দায়িত্বে আবার ফিরে আসতে হবে।"
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো দেশের অর্থনীতি ঠিক করা। এর পাশাপাশি বিচার বিভাগের মতো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। সম্প্রতি তিনি বিদেশী সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করাই তার এখন প্রধান কাজ। জনগণ যাতে নিজের কাজে যেতে পারেন তা তিনি নিশ্চিত করতে চান।
তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, তার সরকার ইতিমধ্যে কিছু সফলতা অর্জন করেছে। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, গত সোমবার থেকেই বেশিরভাগ থানা পুনরায় চালু হয়েছে। তাছাড়া রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদেরও দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
তবে মোহাম্মদপুরবাসী বলছেন, "তারা এমন পুলিশ বাহিনীকে সহজে মেনে নিতে পারবেন না। এ পুলিশ বাহিনী শেখ হাসিনার। পুলিশ শেখ হাসিনার হয়ে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।"
এদিকে ৩৪ বছর বয়সী ফয়সাল জাভেদ বলেন, "পুলিশ ছাড়া শুধু ঢাকা নয়, কোনো শহরই নিরাপদ না।" রাত যত গভীর হয় ততোই তাদের আরো সতর্ক হয়ে কাজ করতে হয় বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, "আমরা পুলিশ চাই। তবে তাদের মধ্যে থাকতে হবে নতুন চিন্তাধারা। কারণ তাদের জন্যই অনেক জীবন হারিয়ে গেছে।"