ডলার সংকটে অচলাবস্থার মুখে সার আমদানি
চলমান ডলার সংকটের মধ্যে ব্যাংকগুলো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে রাজি না হওয়ায় সার আমদানি করতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকারিভাবে সার আমদানির ঋণপত্র খুলছে না ব্যাংকগুলো। আর দরপত্র দিয়েও সার আমদানির জন্য বেসরকারিখাতের কোনো সাড়া মিলছে না। অন্যদিকে আগে আমদানি করা সারের মূল্য পরিশোধ না করায় বাংলাদেশে সার রপ্তানি করতেও রাজি হচ্ছে না বিদেশি সরবরাহকারীরা।
এ অবস্থায় সার আমদানিতে জরুরি সহায়তা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি লিখে কৃষি মন্ত্রণালয় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, জরুরিভিত্তিতে সার আমদানি শুরু না করা গেলে আগামী অক্টোবর থেকে দেশে সার সংকটসহ বহুমাত্রিক সংকট দেখা দিতে পারে।
১৩ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, বর্তমানে দেশে মজুত থাকা ইউরিয়া সার দিয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং নন-ইউরিয়া সার দিয়ে অক্টোবর পর্যন্ত চাহিদা মেটানো যাবে।
অক্টোবর হতে শুরু হতে যাওয়া রবিশস্যের মৌসুমে চাহিদা মেটাতে ৪০ লাখ মেট্রিক টন সার লাগবে। ঋণপত্র খোলার পর সার বাংলাদেশের বন্দরে পৌঁছাতে ৯০–১২০ দিন সময় লাগে।
বিভিন্ন ব্যাংকে ঘুরে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের এলসি খুলতে বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএডিসি) ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারিখাতের মাধ্যমে সার আমদানিও সম্ভব হচ্ছে না।
'দেশের ব্যাংকখাতের অস্থিরতা ও দেশের বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায়' বিদেশি ব্যাংকগুলো বেসরকারিখাতের সার আমদানির এলসি কনফার্মেশন না দেওয়ায় বিএডিসির দরপত্রে সাড়া দিচ্ছেন না বেসরকারি আমদানিকারকেরা।
এ অবস্থায় সরকারের জরুরি সহায়তা চেয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে হাসিনা সরকারের শেষ দিকে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির মিটিং হয়নি। হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর এখনও সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি গঠন হয়নি। ফলে ইউরিয়া আমদানির অনুমোদন ও এলসি খোলার উদ্যোগ নিতে পারছে না বিসিআইসি।
কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে সার আমদানির প্রতিবন্ধকতা দূর করতে দ্রুত পদেক্ষেপ গ্রহণ করতে গতকাল মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
'দেশে বর্তমানে সার আমদানিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষি উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য সার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা প্রয়োজন,' বলা হয় চিঠিতে।
সাধারণত, সরকারি ব্যাংকগুলো বাকিতে সার আমদানির এলসি খুলে এবং নিজস্ব তহবিল থেকে বিদেশি সরবরাহকারীর বিল পরিশোধ করে। সার আমদানি হওয়ার পর বিসিআইসি ও বিএডিসি সরকার থেকে ভর্তুকির টাকা পেয়ে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করে।
কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে সরকার সারের ভর্তুকি পরিশোধ না করায় সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও কৃষি ব্যাংক সার আমদানির এলসি খুলতে কয়েক মাস ধরে অপারগতা প্রকাশ করে আসছে।
গত ১২ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সার, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে যাতে ডলার সংকট কোনো প্রভাব না ফেলে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
চাহিদা অনুযায়ী ইউরিয়া সারের যোগান নিশ্চিত করে বিসিআইসি। সংস্থাটির ইউরিয়া আমদানির এলসি ব্যাংকগুলো খুলছে না বলে গত মাসেই সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান মঙ্গলবার টিবিএসকে বলেন, 'আমরা ইউরিয়া আমদানির জন্য কাতারের সঙ্গে চুক্তি করেছি। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে এ মাসেই চুক্তি হবে। কাফকোসহ (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড) এ তিন দেশ থেকে ১৭ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া আমদানি করতে হবে।'
তিনি বলেন, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গঠিত হলে আমরা ইউরিয়া আমদানির এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করব। আশা করছি, দেশের খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জরুরিভাবে সার আমদানির বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে দুটি ইউরিয়া কারখানা চালু আছে, যেগুলোতে ১০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন সম্ভব।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে যা বলেছে কৃষি মন্ত্রণালয়
বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে সোনালী ব্যাংক গত জুন মাস থেকে সার আমদানির এলসি খুলছে না বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
'সোনালী ব্যাংকের অপারগতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শক্রমে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র খোলার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হলে ইসলামী ব্যাংক শতভাগ মার্জিন ছাড়া ঋণপত্র খুলবে না বলে বিএডিসিকে জানায়।
'বিএডিসির নিজস্ব কোনো তহবিল না থাকায় মার্জিন দিয়ে সার আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সার আমদানিতে জুন মাস হতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে,' চিঠিতে বলেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
এতে আরও বলা হয়েছে, গত মে পর্যন্ত বিএডিসির আমদানি করা সারের বিলমূল্য ১৬০ মিলিয়ন ডলার এখনও বকেয়া থাকায় বিদেশি সার সরবরাহকারীরা বাংলাদেশে সার সরবরাহ করতে অপারগতা প্রকাশ করছে এবং সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে।
টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট), ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ও এমওপি (পটাশ) সারের চাহিদা মেটাতে এ বছর বেসরকারিখাতের মাধ্যমে ৯ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন সার আমদানি করে বিএডিসি।
কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও ডলার সংকটসহ ব্যাংকিংখাতের বর্তমান অবস্থা এবং দেশের বিদ্যমান বাস্তবতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলে চিঠিতে লিখেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কারণ হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, 'ঋণপত্রের বিদেশি কনফার্মিং ব্যাংক না পাওয়ায় বেসরকারিখাতে সার আমদানিতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।'
অন্যদিকে, ইউরিয়া আমদানির এলসি খুলতে ব্যাংকগুলো অনীহা তুলে ধরে গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে পাঠানো চিঠিতে বিসিআিইসি জানিয়েছে, এটি ৪ জুলাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফার্টিগ্লোব থেকে সার আমদানির জন্য এলসি খুলতে সোনালী ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তবে ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা সম্ভব নয় জানিয়ে ৭ জুলাই এলসি প্রস্তাব ফেরত পাঠায় ব্যাংকটি।
বিসিআইসি চেয়ারম্যান টিবিএসকে বলেন, 'এখন ইউরিয়া আমদানি শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ব্যাংকগুলো আমাদের এলসি গ্রহণ করছে না। সোনালী ব্যাংক পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।'
চলতি আমন মৌসুমের জন্য পর্যাপ্ত সার মজুত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বোরোর মূল মৌসুমে পর্যাপ্ত [সার] সরবরাহ নিশ্চিত করা। সরকার যদি অন্তর্বর্তী সমাধান হিসেবে বন্ধ কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করতে পারে, তাহলে আমরা এ সংকট কমাতে পারব।'
এর আগে ১৬ এপ্রিল কাফকো থেকে ইউরিয়া আমদানির জন্য এলসি খোলার জন্য অগ্রণী ব্যাংকের কাছে একটি প্রস্তাব জমা দেয়। তবে ব্যাংক এলসি না খুলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
চট্টগ্রামভিত্তিক বহুজাতিক যৌথ উদ্যোগ কাফকো থেকে ইউরিয়া কেনার জন্য চুক্তির অংশ হিসেবে সরকারকে এলসি খুলতে হয়।
এরপর বিসিআইসি ২১ এপ্রিল কৃষি ব্যাংকের কাছে এলসি খোলার প্রস্তাব করে। ব্যাংকটি ঋণপত্র প্রক্রিয়াকরণ করতে ৫৩ দিন সময় নেয়।
তারপর ২৯ মে বিসিআইসি কাফকো থেকে পরবর্তী ব্যাচের সার আমদানির জন্য অগ্রণী ব্যাংকের কাছে আরেকটি এলসি প্রস্তাব জমা দেয়। অগ্রণী ব্যাংক ৩২ দিন পর ওই এলসি খোলে।