ফেনীতে ১ সপ্তাহে ৪৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে পানির উচ্চতা ১.৫ ফুটও বাড়ার কথা ছিল না!
ঘন ঘন মৌসুমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাংলাদেশ সম্প্রতি স্মরণকালের সবচেয়ে বিধ্বংসী বন্যার সম্মুখীন হয়েছে।
এ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হলেও, বন্যার তীব্রতা বৃষ্টিপাতের পরিমাণের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় দুর্যোগের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে– তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
ফেনীতে আগস্টের ১৬ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত এক সপ্তাহে ৪৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে ১৯ আগস্ট এক দিনে ফেনীতে সর্বোচ্চ ১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃষ্টিপাতের ফলে এই অঞ্চলের পানির স্তরের উচ্চতা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফেনীর মুহুরি নদীর পরশুরাম স্টেশনে ১৬ আগস্ট পানির উচ্চতা ছিল ৭.২ মিটার যা ২১ আগস্ট বেড়ে গিয়ে ১৩.৪২ মিটারে পৌঁছায়। অর্থাৎ ৫ দিনে প্রায় ২০ ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দেশের বৃষ্টিপাতে এ অঞ্চলের পানি ১.৫ ফুটের বেশি বাড়ার কথা নয়।
ফেনীতে এর আগে ১৯৮২ সালের ২ আগস্ট একদিনেই ২৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। তখন ফেনী এলাকার নদী ও খালের পানির উচ্চতা বাড়লেও এমন ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হতে হয়নি।
এই বৈপরীত্য বন্যার অস্বাভাবিক প্রকৃতিকে চিহ্নিত করে, যা সারাদেশের অন্তত ১১টি জেলাকে প্রভাবিত করে যেখানে কোনো কোনো এলাকায় পানির স্তরের উচ্চতা ১৪ ফুটও ছাড়িয়ে গেছে।
তবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,দেশে ১৬ আগস্ট থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত যেসব এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে সেখানে পানির স্তরের উচ্চতা দুই ফুটও হওয়ার কথা না।
এছাড়া ভারতের ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তার পরিমাণ অধিক হলেও, এর আগে এমন রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের পরেও এবারের মতো ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হতে হয়নি।
বিএমডির আবহাওয়াবিদ ডক্টর মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক টিবিএসকে বলেন,"এবারের বৃষ্টিপাতই রেকর্ড বৃষ্টিপাত নয়। অতীতে বন্যাপ্রবণ এলাকায় এমন বেশি বৃষ্টিপাত দেখা গেছেও। এবারে ভারী বৃষ্টিপাত হলেও এত ভয়াবহ বন্যা হওয়ার কথা ছিল না।"
আবুল কালাম উল্লেখ করেন, বন্যা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিপাতের কারণে হয়নি।
তিনি বলেন, "ভারত থেকে আসা উজানের পানি, দেশের নদীগুলোর নাব্যতা না থাকা, লঘুচাপের কারণে জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়া এবং দেশের জলাধারের ক্রমশ সংকোচনের কারণে এ বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে এবং অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।"
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বৃষ্টিপাতের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কুমিল্লায় ১৯ আগস্ট ১৮৩ মিলিমিটার এবং ২১ আগস্ট ১৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ১৯ থেকে ২২ আগস্টের মধ্যে এ জেলায় মোট ৫৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
তা সত্ত্বেও এ এলাকার পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ ২২ ইঞ্চি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।
একইভাবে চট্টগ্রামে ২০ আগস্ট সর্বোচ্চ ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয়। আর এক সপ্তাহে মোট ৫৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। যার ফলে পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ ২২ ইঞ্চি বাড়ার কথা।
কক্সবাজারে ১৭ আগস্ট সর্বোচ্চ ১৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় এবং এক সপ্তাহে জেলায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ৭১৫ মিলিমিটার, যার কারণে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সর্বোচ্চ ২৮ ইঞ্চি।
এবারের বন্যার সময়ে ২১ আগস্ট ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুরাতে ৩০০ মিলিমিটার এবং বিলোনিয়াতে এক দিনে ১৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডাব্লিউসি) তথ্যমতে, কুমিল্লার গোমতী নদী, হবিগঞ্জের খোয়াই নদী, ফেনী নদীর রামগড় স্টেশনের পানির উচ্চতা বিগত ৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে
এছাড়া ফেনীর রামগড় ও পশুরাম নদীর ভারতের দিকের অংশের পানির উচ্চতাও ৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সর্দার উদয় রায়হান বলেন, "বাংলাদেশ একসাথে এতোগুলো পয়েন্টে বন্যার মুখোমুখি এবারেই প্রথম হয়েছে। এছাড়া বন্যার পানি সরে যেতে অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশী সময় লাগছে। অন্যান্য সময় বন্যার পানি ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে মোটামুটি নেমে যায়। কিন্তু এবারে কোথাও কোথাও এক সপ্তাহেও পানি নামেনি।"
ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢল এবারের বন্যা পরিস্থিতি অবনতির জন্য অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, "ভারতের সাথে এ অংশের নদীগুলোর কোথাও আমাদের বাঁধ নেই। তাই এ অংশের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি কিংবা কমে যাওয়া নির্ভর করে ভারত থেকে আসা উজানের পানির ওপর। কিন্তু ভারত কখনও বাঁধ খুলে দেওয়া কিংবা ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি আমাদেরকে জানায় না। তারা শুধু নিয়মিত নদীর পানির উচ্চতার তথ্য ও কয়েকটি পয়েন্টের বৃষ্টিপাতের তথ্য দেয়।"
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, "গত বছর সিকিমের তিস্তার বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পরে ভারত আমাদেরকে জানিয়েছিল। তাই তখন আমরা সতর্কবার্তা দিয়ে প্রস্তুতি নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু এবারে এখন পর্যন্ত ভারত থেকে আমরা বাঁধের কোনো তথ্য পাইনি।"
ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হওয়া নদীর অধিকাংশে বাঁধ দেওয়া (ভারতের অংশে)। কৃত্রিম বাঁধা না থাকলে ও পানির স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে এতো ভয়াবহ বন্যা হত না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের একটি যৌথ নদী কমিশনের সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বন্যার পূর্বাভাসের ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে তিন ধরনের তথ্য চাওয়া হয়: অভিন্ন নদীগুলোর উজানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পানির গতিবেগ, আগামী তিন দিনে বৃষ্টির পরিমাণ এবং বাংলাদেশের উজানে ভারতের অংশে থাকা ৬০টি বাঁধ খুলে দেওয়ার সময় ও সেখান থেকে ভাটির দিকে আসা পানির পরিমাণ।
এসব তথ্য চেয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও ভারত কোনো সাড়া দেয়নি। ভারত শুধু অভিন্ন নদীগুলোর ১৪টি পয়েন্টের পানি বৃদ্ধির তথ্য দিয়ে দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
নদী ও বদ্বীপ গবেষণা কেন্দ্রের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজাজ যৌথ নদী কমিশনকে অনেকটা অকার্যকর বলে সমালোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানায় নদীগুলোর ওপর থাকা ৫৪ টি স্টেশনের মধ্যে মাত্র ৮ টি স্টেশনের ডেটা পায় বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে আবার বাঁধ খোলা কিংবা বন্ধ হওয়ার কোনো তথ্য পাই না। এই কমিশন গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের কোনো উপকারে আসেনি।"
কমিশনটিকে কার্যকর করার জন্য এবং নিয়মিত আপডেট শেয়ার করার জন্য দেশের কর্মকর্তাদের প্রতিটি বাঁধে অবস্থান করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেন অনুরোধ করা হয়– সে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মোহাম্মদ আজাজ।
তিনি আরডিআরসি'র একটি সমীক্ষার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের অন্তত ৬০টি বাঁধ রয়েছে এবং যার কোনোটিই ৩০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না।
আজাজ বলেন, "এই বাঁধগুলিকে ভারত অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশে বন্যার তীব্রতা বাড়িয়ে তোলে।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন, পূর্ববর্তী সরকার নদী ও জলাশয় ভরাট করে এবং প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা ধ্বংস করে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি করার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বাড়িয়ে দিয়েছে।