জেন ‘জি’ বিপ্লব: ছাত্রনেতাদের কারাগারে কাটানো ‘দুঃস্বপ্নময়’ অভিজ্ঞতা
ভোর হতে না হতেই বাইরে থেকে জোরে জোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুরু হয়। ওই সময় পাঁচতলায় নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঘুমাচ্ছিলেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ইফতেখার আলম। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আধা ডজন পুলিশ সদস্য তার ঘরে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় অকথ্য ভাষায় প্রশ্ন এবং তারা চিৎকার করে ইফতেখারকে বলতে থাকে যে সে বাংলাদেশের জাতির সঙ্গে অন্যায় করেছে।
ইফতেখার বলেন, "সেদিন তারা বদ্ধ উন্মাদের মতো আচরণ করছিল আর বলছিল আপনার ফোন কোথায়? ল্যাপটপ কোথায়? এসব বলে চিৎকার করছিল আর অস্ত্র তাক করে সারাঘর তল্লাশি চালাচ্ছিল। এরপর আমার চোখ বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে কালো কাচের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়।"
ইফতেখারের ধারণা তাকে সেদিন 'আয়নাঘর'-এ নেওয়া হয়েছিল।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে আয়নাঘরে শত শত মানুষকে নির্যাতন করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনার পতন ও তার পালিয়ে যাওয়ার পর সেই বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পান কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তারাই একে একে সেখানকার লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে শুরু করেন।
'আমার জীবন এখানেই শেষ'
২৩ বছর বয়সী ইফতেখার জুলাইয়ের শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীর একজনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও তিনি।
প্রথমে আন্দোলনটি সরকারি চাকরিতে কোটার সংস্কারের দাবিতে শুরু হলেও ছাত্রদের ওপর দমন-পীড়ন ও বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ায় এটি সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
ইফতেখারকে আয়নঘরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সেখানে তার কাছে আন্দোলনের নেতাদের অবস্থান জানতে চাওয়া হয় এবং সে যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে তাকে 'গুম' করা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়।
ইফতেখার বলেন, তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্যাতন করেছে নিরাপত্তাকর্মীরা। তার শরীরের সব জায়গায় লোহার পাইপ দিয়ে পেটানো হয়। পেটাতে পেটাতে তার পায়ের হাড় ভেঙে দেয় নিরাপত্তাকর্মীরা। এ অবস্থায়ই তাকে বারবার বৃত্তাকারে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বমি করে ফেলেন ইফতেখার।
তিনি আরও বলেন, তার হাতে ও পায়ে সিগারেটের আগুনের ছেঁকাও দেওয়া হয়। চিৎকার করলে শাস্তি আরও বাড়বে বলেও তারা হুমকি দেয়। শুধু তাই নয়, এটি তাদের কাছে একটি 'খেলা' বলেও উল্লেখ করে তারা।
এত নির্যাতনের পর জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তাকে ইলেকট্রিক শক ও ওয়াটারবোর্ডিং করা হবে বলে জানানো হয়। আর এজন্য তার ঘাড়ে ইলেকট্রিক শকও দেওয়া হয়।
সেই সময়ের মানসিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে ইফতেখার বলেন, "এটি থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। আমার মনে হচ্ছিল আমার জীবন এখানেই শেষ হয়ে যাবে এবং কেউ তা জানতে পারবে না।"
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, তিনি একা নন।
পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও সীমান্তরক্ষীদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ নিরাপত্তা দল র্যাব শেখ হাসিনার আমলে ডিজিএফআই'র মতো এমন অনেক গোপন নির্যাতন চালিয়েছে। র্যাবের এ ধরনের আইনবহির্ভূত কার্যক্রমের কারণে ২০২১ সালে 'গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন'র অভিযোগে এনে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
মানবাধিকার সংস্থা 'অধিকার'র তথ্যমতে, শেখ হাসিনার শাসনামলে ৭০৯ জনকে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরে মুক্তি পেয়েছেন, কেউ সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন, আবার কাউকে কাউকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এখনও ১৫৫ জনের মতো মানুষ নিখোঁজ রয়েছে।
অধিকার ২৯ আগস্ট এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, "বাংলাদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনী নিয়মিত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকে গুম করেছে। তাদের গুমের তালিকায় বেশিরভাগই ছিল শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ভিন্নমত অনুসরণকারী ও রাজনৈতিক কর্মীরা। এসব গুমের উদ্দেশ্য ছিল দেশে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা।"
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও হাসিনার শাসনামলে পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর গুম ও নির্যাতনের নথিপত্র নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন করেছে।
সিএনএন এসব নির্যাতনের সাক্ষ্য এখনও স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। আয়নাঘর ও যারা এখনও নিখোঁজ রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে সিএনএন।
নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়া শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যেই গুম হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে ও ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া সাম্প্রতিক বিক্ষোভে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, দমন পীড়ন তদন্তে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং দলকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।
জাতিসংঘরে মানবাধিকার হাইকমিশনারের মুখপাত্র রবিনা শামদাসানি বলেন, "জোর-জবরদস্তি ও গুমের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক ইতিহাস হয়ে আছে।"
তিনি আরও বলেন, "জাতিসংঘ এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করতে চায়। আর এ গণতন্ত্র জবাবদিহি, একতাবদ্ধ ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে।"
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি পান ইফতেখার আলম। তাকে উঠিয়ে নেওয়া ব্যক্তিরা একটি নির্জন এলাকায় তাকে নামিয়ে দেয়। এ সময় তাকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, সে যদি চোখের বাঁধন খোলে, তাহলে তাকে গুলি করা হবে।
আয়নাঘর থেকে মুক্তির এক মাস পর ইফতেখারের পায়ের প্লাস্টার খুলে দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। কিন্তু তিনি বলেন, তার যে মানসিক ক্ষতি হয়েছে তা থেকে সেরে উঠতে বেশ সময় লাগবে। "এটি যেন এক দুঃস্বপ্ন" ছিল তার জন্য।
আন্দোলনের নেতারাও এর লক্ষ্যবস্তু ছিল
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাস্সুমকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে সময়ের অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, "সময়টি আমার জন্য খুবই ভয়াবহ ছিল। তারা বাসার তিনটি দরজা ভেঙে ফেলে এবং আমাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর যে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা ছিল আরও ভয়াবহ।"
তাবাস্সুমকে ২৮ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। এ সময় তাকে প্রচণ্ড মারধরও করা হয়। বন্দিদশা থেকে মুক্তির পর আবারও আন্দোলনে যোগ দেন তাবাস্সুম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত তাবাস্সুম। জুলাই ও আগস্টে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিটিশ আমলের কার্জন হল দিয়ে যখন তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন তার চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল তার অদম্য সাহস। তার সহপাঠী নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ তার সঙ্গে ছবি তুলছিলেন। আবার কেউ কেউ তার সেসব ভয়াবহ দিনগুলোর অভিজ্ঞতাও জানতে চাচ্ছিলেন।
তার পাশ দিয়ে এক শিক্ষার্থী যাওয়ার সময় তাকে দেখে চিৎকার করে বলেন, "আমাদের দেখা হবে আয়নাঘরে।"
তাবাস্সুম জানান, তাকে চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মারধর করা হয়েছিল। এতে তার পুরো শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল, তার মুখ কেটে গিয়েছিল এবং কানের পর্দাও ফেটে গিয়েছিল।
২৩ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, "আমি এখন শ্রবণযন্ত্র ছাড়া ডান কানে শুনতে পাই না। পিটুনির কারণে আমার দুটি দাঁতও নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে।"
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) আটক থাকা অবস্থায় তাবাস্সুমসহ পাঁচ ছাত্রনেতাকে এটি যৌথ স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়। এ স্বীকারোক্তি পরবর্তী সময়ে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়।
তাবাস্সুম বলেন, "তারা আমাদের একটি ভিডিও বার্তা তৈরি করতে বাধ্য করেছিল। সেখানে আমাদের বলতে বাধ্য করা হয় যে আমরা আমাদের আন্দোলন বন্ধ করেছি এবং আর কোনো আন্দোলন হবে না।"
এ ভিডিওটি যখন ধারণ করা হয় তা মারধরের চেয়ে বেশি 'মানসিক যন্ত্রণাদায়ক' ছিল বলে উল্লেখ করেন তাবাস্সুম। তিনি ভয় পেয়েছিলেন। তিনি মনে করছিলেন, এতে বাংলাদেশের জনগণ তাদের বিশ্বাসঘাতক মনে করবে।
তিনি বলেন, "এটাই ছিল সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়।"
বাংলাদেশ ২.০
তাবাস্সুম বলেন, হাসিনার পদত্যাগের খবর যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আন্দোলনকারীরা অনুভব করেছিল যে তাদের ত্যাগ সার্থক।
"আমি এ খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমি অনেক কেঁদেছি। বিষয়টি এমন ছিল যে এ মুহূর্তের জন্যই যেন আমি বেঁচে ছিলাম", বলেন তাবাস্সুম।
এখন তাবাস্সুম সুস্থ হওয়ার পথে আছেন। তবে মারধরের কারণে তার স্মৃতিশক্তি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মারধরের আগের ঘটনাগুলো মনে করতে তার কিছুটা কষ্ট হচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে নতুন বাংলাদেশ ২.০ গঠনে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ঢাকার রাস্তাগুলো এখন বিক্ষোভের শিল্পকর্ম ও দেয়ালচিত্রে সজ্জিত। এখানে পপ আর্ট-স্টাইলে বিভিন্ন নকশা ও স্লোগান দিয়ে দেয়াল সাজানো হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে, 'প্রতিরোধ দীর্ঘজীবী হোক', 'তোমার স্বপ্নকে উড়তে দাও' ও 'এটাই নতুন বাংলাদেশ, জেনারেশন জি দ্বারা নির্মিত।'
দেশের রাস্তাগুলো এখন নতুন আশাবাদ ও নাগরিক গর্বে উজ্জীবিত। যদিও দেশজুড়ে এখনও নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে ছোটখাটো বিক্ষোভ চলছেই।
আগস্টের শেষের দিকে সিএনএন দেখেছে, রাজধানী ঢাকা ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর মধ্যে ভেশ কয়েকটি বিক্ষোভ ছিল- প্যারামেডিকদের ডাক্তারি লাইসেন্সের দাবিতে, মটরচালিত রিকশাচালকদের বৈধতার দাবিতে।
এর আগে হাসিনার শাসনামলে মানুষ গ্রেপ্তার ও গুম হওয়ার বয়ে অনেকেই রাস্তায় প্রতিবাদ করতে ভয় পেতেন।
কিন্তু এখন ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলোও রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা হাসিনার বন্দিশিবিরে আটকদের মুক্তির দাবিতে জনসম্মুখে এসেছেন।
নতুন নেতৃত্বের অধীনে দেশে পরিবর্তন আসবে বলে অনেকেই সতর্কতার সঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কারণ অস্থিতিশীলতা সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।
তাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস জনগণকে ধৈর্য ধরার জন্য অনুরোধ করছেন। কারণ তাকে ফ্যাসিবাদী দলের ১৫ বছর শাসনের পর 'পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জ' মোকাবিলা করতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা তাকে ক্ষমতায় এনেছেন। তারা বিশ্বাস করেন, তিনি দেশের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করবেন।
তাবাস্সুম বলেন, "ড. ইউনূসের মধ্যে একটা অভিভাবক অভিভাবক ভাব আছে। তিনি আমাদের যত্ন নেন, তিনি আমার দেশের যত্ন নেন। আমরা তাকে বিশ্বাস করতে চাই।"
কিন্তু তিনি স্বীকার করেন যে "বিপ্লব-পরবর্তী সংস্কার খুব কঠিন।"
আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, "আমার দেশ অসুস্থ। কিন্তু আমার দেশের মানুষ, আমরা সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকব।"
অনুবাদ: সাদিয়া আফরিন রেনেসাঁ