বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দলভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কী হলো?
জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রত্যক্ষভাবে ছাত্রলীগের সহিংসতা ও দৈন্যতা দেখার পর, দেশের মানুষ একমত হয়ে যায় যে ছাত্র রাজনীতির নামে এতদিন যা চলছিল তা আর চলতে দেওয়া যাবে না।
জুলাইয়ে প্রথম দফার গণহত্যার পর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৯ দফা দাবি উত্থাপন করে। এগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দলভিত্তিক ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করা এবং ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল অন্যতম।
শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সোসাইটির করা এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৪% শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে।
তবে গত কয়েক সপ্তাহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মনোভাবে হয়তো বদলে গেছে। কারণ তারা বিএনপি সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রদল এবং জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতি 'অভিন্ন লক্ষ্য' নিয়ে একত্র হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে আমরা দেখেছি ছাত্রশিবির দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে তাদের কমিটি ঘোষণা করে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে উঠেছে। এছাড়া, আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিজেই একটি আনুষ্ঠানিক সংস্থায় পরিণত হয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরেই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে ঐকমত্য গড়ে তুলতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
শিবির নিজেদের কমিটি ঘোষণার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা বিবৃতি দিয়েছে।
বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, শিবিরের আত্মপ্রকাশের বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন; তারা মনে করে অন্যান্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের প্রকাশ্যে আসা উচিত ছিল।
শিবিরের গোপনে কমিটি গঠনের বিষয়টির সঙ্গেও তারা একমত নন বলে জানান তারা। তবে তারা কার্যত জানিয়ে দিয়েছে, ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলভিত্তিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তাদের নীতিগতভাবে কোনো বিরোধ নেই।
তাহলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন ক্যাম্পাসে কেমন রাজনীতি চায়?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক মেহরাব হোসাইন সিফাত বলেন, 'আমরা লেজুরবৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বলতে জাতীয় রাজনৈতিক দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংগঠন/দলকে বোঝাই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা ছাত্র সংগঠনগুলোকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বা মূল সংগঠনের প্রভাবমুক্ত রাজনীতি করতে দেখি না।'
উদাহরণ হিসেবে মেহরাব বলেন, ব্রিটেনে লেবার বা কনজারভেটিভদের সমর্থক ছাত্র সংগঠনগুলোকে কিন্তু তারা সব সময় নিয়ন্ত্রণ করে না।
তিনি বলেন, 'আমরা এমন রাজনীতি চাই যেখানে ছাত্র সংগঠনগুলোর ওপর জাতীয় দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। দলগুলোর মধ্যে যদি এমন কাঠামো থাকে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু তা না থাকলে নিজেদের পুনর্গঠন করে তারপর ক্যাম্পাসে আসতে হবে তাদের।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম জানান, মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে একাধিক ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনকে নিয়ে করা এক বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্যান্য বাম সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক শামসুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-কে বলেন, 'গতকালের বৈঠকে আমি উপলব্ধি করেছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও অন্যান্য দল এবং তাদের রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা চান না। আমি মনে করি তারা সবচেয়ে বেশি চায় ছাত্রলীগ আবার ফিরে না আসুক।'
তিনি বলেন, ওই বৈঠকে ছাত্রদলের নেতারা অঙ্গীকার করেছেন, তারা স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। যেমন তারা 'তাদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের বাইরে গিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শিবির নিষিদ্ধকরণকে সমর্থন করেছিল'। [১৯৮৯ সালের ১৫ আগস্ট শিবির কর্মীদের হাতে এক ছাত্রদল কর্মী নিহত হওয়ার পর ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শিবির বিতাড়িত করে।]
শফিউল আলম জোর দিয়ে বলেন, কয়েক ব্যাচ আগে পাস করা শিক্ষার্থীদের পরিবর্তে, নিয়মিত শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করলে ছাত্র রাজনীতির অনেক সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
ড. শামসুল হক বলেন, 'ছাত্র সংগঠনগুলো যদি রাজনৈতিক দলের সেবা না করে শিক্ষার্থীদের ইস্যুতে স্বাধীনভাবে কাজ করে, তাহলে সেটা হবে ইতিবাচক ও কার্যকর রাজনীতি।'
তিনি বলেন, 'সাধারণ শিক্ষার্থীরা আর সংঘাত ও রক্তপাতের রাজনীতি চায় না।'
তিনি আরও বলেন, আলাপচারিতা থেকে আমি ধারণা পেয়েছি যে ক্যাম্পাসে শিবির, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন বা অন্য কোনো দলের উপস্থিতি এখন আর কোনো সমস্যা নয়। বরং মূল দলগুলো থেকে ছাত্র সংগঠনগুলোকে 'বিচ্ছিন্ন' করার বিষয়টি নিয়েই এখন উদ্বেগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, 'জাতীয় রাজনৈতিক দল থেকে ছাত্র রাজনীতি বিচ্ছিন্ন করা জরুরি। নিরাপদ ক্যাম্পাস, স্থিতিশীল জাতীয় ভবিষ্যতের জন্য, সরকারি সেবার কাঠামো সংস্কার এবং প্রতিটি সেক্টরে উপযুক্ত জনশক্তি গড়ে তুলতে এটি গুরুত্বপূর্ণ।'
আমরা তাকে প্রশ্ন করি, এর মানে কি? ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন বা শিবিরের মতো ছাত্র সংগঠনগুলো কি ক্যাম্পাসে থাকতে পারবে?
হাসানুজ্জামান বলেন, 'হ্যাঁ, তারা থাকতে পারবে। তারা চাইলে খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার দলকে ভোট দিতে পারেন। কিন্তু ক্যাম্পাসে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা প্রকাশ্যে প্রকাশ করতে পারবেন না। জাতীয় রাজনীতিতে আপনি কাকে ভোট দিতে চান তা নিয়ে আপনার পক্ষপাত থাকতে পারে, কিন্তু ক্যাম্পাসে আপনি এর ওপর ভিত্তি করে রাজনীতি করতে পারেন না।'
তাই শিবির, ছাত্রদলসহ অন্যরা ক্যাম্পাসে থাকতে পারবে, কিন্তু তারা ক্যাম্পাসে জামায়াত, বিএনপিসহ অন্যান্য জাতীয় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না।
কিন্তু এই ব্যবস্থায় কি রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র সংগঠনের সদিচ্ছার ওপর খুব বেশি আস্থা রাখা হচ্ছে না?
হয়তো ভবিষ্যতই তা বলবে। তবে আপাতত ছাত্র সংসদকেই ভবিষ্যৎ হিসেবে দেখছেন অধ্যাপক শামসুল আলম।
তিনি বলেন, 'আমরা শিগগিরই জাকসু (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সংসদ) আয়োজন করব। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি শৃঙ্খলাবদ্ধ হবে। কারণ, যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চায় তারা মাদকাসক্ত বা ছোটখাটো অপরাধও করবে না। তারা ভালো থাকার চেষ্টা করবে, তাদের ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নেবে। এতে নেতৃত্ব তৈরি হবে। আর এই নেতৃত্ব অবশ্যই নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ভেতর থেকেই আসতে হবে।'