মিয়ানমারের তীব্র সংঘাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে: দালালদের সহযোগিতায় বাংলাদেশে ঢুকছেন তারা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ নিতে তীব্র সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। আর তাদের দমনে বিমান হামলা চালাচ্ছে মিয়ানমার সরকারের সামরিক জান্তা বাহিনী। তাদের এ দমনপীড়ন, হামলা, বিস্ফোরণের শব্দে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা টেকনাফ পর্যন্ত কেঁপে উঠছে। এ পর্যন্ত খবর এসেছে, সীমান্তের ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। গত এক মাসে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গতকাল শনিবার থেকে রবিবার পর্যন্ত বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠেছে টেকনাফ সীমান্ত।
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমিন বলেন, "সীমান্তের ওপারে আকাশে বিমানের চক্কর, মর্টার শেল ও শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণে এপারের ঘরবাড়ি কাঁপছে। এতে আতঙ্কে ঘুমহীন রাত কাটছে এপারের মানুষের।"
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, "এই পরিস্থিতির মধ্যে সীমান্তের ৩০ টি পয়েন্ট দিয়ে দালালদের সহায়তায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে।" বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে বলে জানান তিনি।
সীমান্তের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য বলছে, আগস্ট মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ হয়েছে। টেকনাফের বেশির ভাগ জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল, উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্তসহ অন্তত ৩০ টি পয়েন্টে দিয়ে এসব রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো হওয়া রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় এই অনু্প্রবেশ অব্যাহত রেখেছে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জনপ্রতিনিধি বলছেন, কিছুসংখ্যক অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বিজিবি সদস্যরা আটকও করেছে। গত শুক্রবার ভোরে শাহপরীরদ্বীপ থেকে অনুপ্রবেশের সময় আটক হওয়া রোহিঙ্গাদের বিজিবির একটি গাড়ি যোগে টেকনাফের দিকে নিয়ে যেতেও দেখেছেন তারা।
দালালের সহযোগিতায় নৌকা নিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করেছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজির আহমদ। তিনি জানান, গত কয়েক দিনে কেবল কেরনতলি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় অনেক রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিজিবি এসব রোহিঙ্গাকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বলে জানতে পেরেছেন।
গত শুক্রবার ভোরে টেকনাফের একটি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের মংডু শহরের দলিয়াপাড়া ও সুদাপাড়া এলাকা এখন রোহিঙ্গা শূন্য। ওখানে উভয় পক্ষ শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমা, মর্টার শেলের পাশাপাশি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। প্রাণ রক্ষায় যে যে দিকে পারছেন পালাচ্ছেন। দালালদের জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা দিয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। এখন ক্যাম্পে প্রবেশের চেষ্টা করছেন।
টেকনাফে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মাইন উদ্দিন বলেন, কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে। ক্যাম্পে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অনুপ্রবেশের সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাফ নদী থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে, আজ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, "আমরা আর কোনো রোহিঙ্গাকে দেশে প্রবেশ করতে দিতে চাই না। তবে এখনো অনেকে বিভিন্নভাবে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। বিজিবি যাদের ধরছে তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে সবাইকে থামানো সম্ভব নয়।"