বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতিতদের ৮০ শতাংশ সাধারণ ছাত্র: গবেষণা
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতিতদের মধ্যে ৮০ শতাংশ সাধারণ ছাত্র, যাদেরকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী সন্দেহে নির্যাতন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন 'সোচ্চার– টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ' এর ক্যাম্পাস নির্যাতন নিয়ে করা এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সোমবার (৭ অক্টোবর) অনলাইন প্ল্যাটফর্ম 'জুম'-এ আয়োজিত ওয়েবিনারে এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে নির্যাতিত ৫০ জন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, নির্যাতিত অন্যান্যদের মধ্যে ১৪ শতাংশ ছাত্রশিবিরের কর্মী, ২ শতাংশ ছাত্রদল, ২ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের সাধারণ জনতা এবং ২ শতাংশ ছাত্রলীগ কর্মী নির্যাতিত হয়েছেন। এদের সবাই নির্যাতিত হয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে।
গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন সোচ্চারের প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার পোস্টডক্টোরাল রিসার্চ ফেলো ড. শিব্বির আহমদ।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৮৪ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ঘটেছে, যেখানে ভুক্তভোগীদের নির্দিষ্ট কক্ষে ডেকে এনে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতন শুরু হয়েছে ক্যাম্পাসের কোনো স্থানে এবং শেষ হয়েছে আবাসিক হলের নির্দিষ্ট নির্যাতনের কক্ষে। ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতন শুরু এবং শেষ হয়েছে ক্যাম্পাসেই।
সাক্ষাৎকার দেওয়া নির্যাতিত ৫০ জনের মধ্যে ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) এবং ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-গোপালগঞ্জের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক ও চট্টগ্রামের আইআইইউসি রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে আগস্ট মাসে। সোচ্চারের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে- ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে অতি রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে আগস্ট মাসে নির্যাতনের ঘটনা বেশি হয়ে থাকতে পারে।
ওয়েবিনারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকিব বলেন, "গত ১৫ বছর ক্যাম্পাসগুলোতে ছিল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের রাজত্ব। এটা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ মেরিটের ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে যোগ্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এর কারণেই বিগত সময়ে ক্যাম্পাসগুলোতে ন্যাক্কারজনক ঘটনাগুলো ঘটেছে।"
ক্যাম্পাসে নির্যাতনের ঘটনা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে জানিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চোধুরী বলেন, "শুধু গত ১৫ বছর নয়, গত ৫০ বছরে ক্যাম্পাসে নির্যাতনের সব ঘটনা বিশ্লষণ করলে দেখা যাবে, সমস্যাটা রাজনৈতিক। সুতরাং, এটা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে।"
আবরার ফাহাদ নাগরিকদের কনসার্নের বিষয়েই কথা বলেছিলেন জানিয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সভাপতি অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, "নদীর পানি, সীমান্ত হত্যা, গ্যাস ও বিভিন্ন চুক্তিতে বিগত সময়ে তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্রকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। গত ১৫ বছরে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে শুধুমাত্র তারাই লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশের এক্ষেত্রে প্রাপ্তি প্রায় শূন্যের কোটায়। আবরার ফাহাদ সে কথাই বলে গেছেন।"
আইন ও শালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার সংগঠন এইচআরএসএস এর প্রধান উপদেষ্টা নূর খান লিটন বলেন, "আবরার ফাহাদকে যেভাবে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে, সেই প্যাটার্নই ডিবি অফিসে প্র্যাকটিস হয়েছে। রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে সবকিছুকে নরমালাইজ (স্বাভাবিক) করা হয়েছে।"
এছাড়াও, ওয়েবিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর শেহরিন আমিন ভূঁইয়া, মানবাধিকার আইনজীবী ও সোচ্চারের লিগ্যাল ডিরেক্টর ব্যারিস্টার শাইখ মাহদি এবং বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও, গবেষণায় যুক্ত ছিলেন টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক মেহেদী হাসান ও ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় আরবানা-শ্যাম্পেইনের পিএইচডি গবেষক রাহনুমা সিদ্দিকা।