সত্যায়িতকরণ: ভুয়া কাগজপত্রের পেছনে দায়ী যে অপ্রয়োজনীয় নিয়ম
একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন শাখাওয়াত হোসেন। গত সপ্তাহে তিনি বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন 'ডাক অধিদপ্তরের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় অস্থায়ী জনবল নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি পেয়ে আবেদন করেন। যেখানে তার সব শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের সত্যায়িত অনুলিপি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত অনুলিপি পাঠাতে বলা হয়। তাই তিনি কাগজপত্র সত্যায়িত করতে নিজের কাছে থাকা প্রথম শ্রেণির এক কর্মকর্তার সিল ব্যবহার করে নিজে নিজেই সত্যায়িত করে নেন।
শাখাওয়াত হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রতি সপ্তাহেই ২/১ টি আবেদন করছি আর অধিকাংশ আবেদনের কাগজপত্র জমা দিলেই তা সত্যায়িত বাধ্যতামূলক করে দিচ্ছে। এভাবে প্রতিনিয়ত এতো কাগজপত্র আমি ঢাকায় কার কাছ থেকে সত্যায়িত করবো?"
"এটা এক ধরনের অহেতুক কষ্ট তাই নিজে নীলক্ষেত থেকে এক প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার সিল বানিয়ে নিয়েছি সেটা দিয়েই নিজে নিজে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সত্যায়িত করে নিচ্ছি।"
অন্য এক চাকরির আবেদনকারী শামসুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এ আধুনিক যুগে এমন প্রাচীন পদ্ধতি একেবারেই অহেতুক। কাগজপত্র সত্যায়িত করতে যদি কোনো কর্মকর্তার কাছে কয়েকদিন পর পরই যেতে হয় তবে সে নিজেও বিরক্ত হবে। এছাড়া চাকরির ভাইবার সময় মূল সনদ তো সাথে নিতে হচ্ছেই।"
শুধু তারাই নন এমন অভিজ্ঞতা অধিকাংশ চাকরি প্রার্থীদেরই। আবার সত্যায়িত করতে গিয়ে কেউ কেউ হয়রানিরও শিকার হচ্ছেন কিংবা দালালদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে ফেইক সিল বানিয়ে নিয়ে স্বাক্ষর নকল করে নিজে নিজেই সত্যায়িত করে নিচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজেও ফেইক কাগজপত্র ব্যবহার করছেন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সত্যায়িত বিষয়টি একেবারেই অপ্রয়োজনীয় যা পুরোনো পদ্ধতি, এমন ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত।
চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া এবং নিয়মিত বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করা অন্তত ২৫ জন চাকরি প্রার্থীর সাথে কথা হলে সবাই-ই জানান তারা অন্তত একবার হলেও ভুয়া ডকুমেন্টসের শরণাপন্ন হয়েছেন কিংবা নিজে নিজেই সত্যায়িত করেছেন। অনেকেই বাধ্য হয়ে এসব ভুয়া ডকুমেন্টসের শরণাপন্ন হয়েছেন।
বিভিন্ন সময় এসব ভুয়া ডকুমেন্টস ব্যবহারের কারণে জেল জরিমানারও সম্মুখীন হচ্ছে অনেকে, আবার অধিকাংশই থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মঙ্গলবার রাজধানীর বিআরটিএ ভবনে ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করাতে আসেন জামিউল হক। অন্যান্য কাগজপত্রের সাথে ন্যাশনাল আইডি কার্ড এর সত্যায়িত ফটোকপি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক থাকায় তিনি সেখানে এক দালালকে ধরে ২০০ টাকা দিয়ে সত্যায়িত করে নেন।
জামিউল টিবিএসকে বলেন, "জানতাম শুধু ফটোকপি দিলেই হবে। কিন্তু, সত্যায়িত করা ছিল না কাগজপত্র। তবে দালাল টাকার বিনিময়ে কোনো প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার কাছে না গিয়েই মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই সত্যায়িত করে দিলো। এমন সত্যায়িতের দরকার কি?"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঐ দালাল টিবিএসকে বলেন, আমাদের কাছে কর্মকর্তাদের সিল বানানো আছে আর লোকও ঠিক করা আছে। নিজেরাই সত্যায়িত করে দিতে পারি।
রাজধানীর নীলক্ষেতে সিল বানানোর দোকান রয়েছে শতাধিক। সবগুলো দোকানেই গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী সিল বানিয়ে দিচ্ছেন তারা। তবে মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিদের সিল বানান না বলে জানান তারা।
লিফানা ফটোস্ট্যাট ও সিল দোকানের তসলিম হোসেন টিবিএসকে বলেন, "আমাদের এখান থেকে ডাক্তারদের সিল বেশি বানিয়ে নেওয়া হয়। অনেকেই ডাক্তারদের প্যাড কিংবা স্বাক্ষর নিয়ে আসেন। অধিকাংশই বলেন ডাক্তারকে উপহার দিবেন সিল বানিয়ে। তাই বাধ্য হয়ে বানিয়ে দেই। আমাদের ক্রোস চেকের তো সুযোগ নেই।"
সিটি ট্রেড সলিউশনের নাসির হোসেন টিবিএসকে বলেন, তার দোকানে অনেক ছাত্রই আসেন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের সিল বানাতে। তারা এসে পরিচয় দেন তারা হয় তার আত্মীয় কিংবা কাছের কেউ। আবার কেউ কেউ ফোন কলেও কথা বলিয়ে দেন।
"এখানে ভুয়া তথ্য যাচাই করার সুযোগ নেই, এছাড়া আমাদেরও তো ব্যবসা চালাতে হবে," বলেন তিনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অধিশাখার অতিরিক্ত সচিব মো: আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর টিবিএসকে বলেন, "সত্যায়িতকরণ অনেক বছর ধরে চলে আসছে। এখন যুগের ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। তাই জনমতের ভিত্তিতে এ বিষয়টি নিয়ে সরকার চিন্তা করতে পারে।"
তবে, কেউ যদি ভুয়া কাগজপত্র কিংবা সত্যায়িতের বিষয়ে জালিয়াতি করে তাহলে সেটার দায় তারই, বলেন তিনি।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার টিবিএসকে বলেন, "সত্যায়িতের এ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত আর এটা তুলে দেওয়া কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় না। বলে দিলেই হয় সত্যায়িতের বিষয়টির দরকার নেই।"
জনপ্রশাসন এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আগে যখন ফটোকপির ব্যবস্থা ছিল না তখন মানুষ হাতে লিখে কাগজপত্র জমা দিতো কিন্তু এখন তো আর সেটার দরকার নেই। এটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এ ব্যবস্থা শুধু শুধু মানুষকে ভোগান্তি দিচ্ছে। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে ভুয়া সিল ব্যবহার করছেন কিংবা দালালের দ্বারস্থ হচ্ছেন।