প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব: সিনোহাইড্রো-স্টাইল
চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশনের দায়িত্বে নির্মীয়মাণ একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ সম্পন্ন করার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে ছয়বার। এ গাফিলতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে 'অদক্ষ', 'অসতর্ক', 'ধীর'—এই তিনটিসহ অন্তত এক ডজন নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর আগে বিদ্যুৎ বিভাগ গত মার্চে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় নির্মীয়মাণ ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, চীনা ঠিকাদাররা যথাযথ ডিজাইনে নির্মাণকাজ করেনি। ফলে ইকুইপমেন্ট ও যন্ত্রাংশে মরিচা ধরেছে। এর ফলে প্রকল্পের অনেক আইটেমই নতুন করে পুনঃস্থাপন করতে হবে। অথচ প্রকল্পটির ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিনোহাইড্রোকে ঠিকাদারকে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এবং কাজের গতি বাড়াতে অনুরোধ করা হলেও এখনও অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিদ্যুৎ বিভাগের উদ্যোগে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও চীনা দূতাবাসের সঙ্গে গত এক বছরে একাধিক সভা করেও প্রকল্পের বাস্তবায়নগতি বাড়ানো সম্ভব হয়নি।
এর ফলে প্রকল্পের সময়সীমা ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হলেও ১,০৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কমিশনিংয়ের কাজ কবে শুরু হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৭ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল ২০১৯ সালে। সরকারি খরচে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাস্তবায়নকারী সংস্থার দায়িত্বে আছে বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেড।
সিনোহাইড্রোর ধীরগতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে অতীতেও বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকেই দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নয়ন প্রকল্প ও পদ্মা সেতুর নদীশাসন প্রকল্প। এসব প্রকল্পে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ম লঙ্ঘন তো করেছেই, ব্যয়ও বাড়িয়েছে। তবু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ পেতে অসুবিধা হয়নি প্রতিষ্ঠানটির।
২০১৪ সালে আফ্রিকায় বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে সিনোহাইড্রোকে সাময়িক কালোতালিকাভুক্ত করেছিল বিশ্বব্যাংক।
জার্মান সরবরাহকারীর সঙ্গে মতবিরোধ
বিদ্যুৎ বিভাগের চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে হয়েছে, ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রোকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদার হিসেবে ২০১৮ সাল মিরসরাইয়ের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ পায় সিনোহাইড্রো। ১৫ মাসের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির।
বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইকুইপমেন্ট সরবরাহে জার্মান প্রতিষ্ঠান এমএন এনার্জি সলিউশনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে সিনোহাইড্রো। কিন্ত চীনা প্রতিষ্ঠানটি পরে এমএএনের গাইডলাইন অনুযায়ী নির্মাণকাজ করেনি। ফলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সিনোহাইড্রোর মতানৈক্য দেখা দেয়। এর ফলে এমএএনের কমিশনিং টিম একাধিকবার প্রকল্প এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদনে জানানো হয়, নির্মাণকাজের শুরু থেকেই প্রকল্পে ছিল পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবল, তদারকি ব্যববস্থা এবং মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এছাড়া এ প্রকল্পে যথাযথভাবে নকশা ও স্পেসিফিকেশন মানা হয়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জার্মান সরবরাহকারী এমএএন এ পর্যন্ত সিনোহাইড্রোকে উচ্চ অগ্রাধিকার, মাঝারি অগ্রাধিকার ও নিম্ন অগ্রাধিকারের মোট ৪৪৪টি আইটেমভিত্তিক পাঞ্চ লিস্ট দিয়েছে। এর মধ্যে চীনা ঠিকাদার মাত্র ১৮৭টি আইটেম সম্পন্ন করতে পেরেছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রে স্থাপিত ইঞ্জিনগুলো কমিশনিং কাজ শুরু করার আগে অবশ্যই উচ্চ ও মাঝারি অগ্রাধিকারভুক্ত আইটেমের রেকটিফিকেশন সম্পন্ন করতে হবে। তা না হলে প্রথমদিনই বন্ধ হয়ে যাবে উৎপাদন। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এমএএনের গাইডলাইন অনুযায়ী যে কাজগুলো এখনও অসমাপ্ত, সেসবের মধ্যে রয়েছে—গ্যাস পাইপলাইনের প্রস্তুতি, ফায়ারফাইটিং সিস্টেম কমিশনিং, রাস্ট রিপ্লেসমেন্ট ও একটি ইঞ্জিনের জন্য পাইপলাইনের ডায়ামিটার রিঅ্যাডজাস্ট করা।
বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, জার্মান সরবরাহকারী ও চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকবার মতানৈক্য দেখা দেয়, যার জেরে এমএএনের কমিশনিং টিম একাধিকবার প্রকল্প এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
প্রকল্পটির কাজ শেষ করার লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব, ঢাকাস্থ চীনা রাষ্ট্রদূত, চীনা দূতাবাসের অন্যান্য প্রতিনিধি, সিনোহাইড্রোর প্রতিনিধি, এমএএন কর্মকর্তা ও বি-আর পাওয়ারজেনের অংশগ্রহণে যথাক্রমে ২০২১ সালের ৬ মে এবং ২০২২ সালের ৬ মার্চ দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ওই দুই সভায় অতি দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করতে চীনা ঠিকাদারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্ত তাতেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি বলে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কাজে গতি বাড়াতে না পারায় ঠিকাদারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ
২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩৯ কোটি টাকা। যার মধ্যে ২৫.৫০ কোটি টাকার অর্থছাড় হয়েছে, কিন্তু ভৌত কাজের ধীরগতির কারণে অর্থব্যয় হয়েছে ১৩ কোটি টাকার মতো।
প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি না থাকায় ঠিকাদার বিল দাখিল করে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না। এছাড়া কিছু আইটেম বা যন্ত্রাংশ না থাকায় প্রকল্পের বরাদ্দের পুরো অংশ ব্যয় করা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় কাজের দীর্ঘসূত্রত ও প্রকল্প সম্পন্ন না করার জন্য ঠিকাদারের বিরুদ্ধে চুক্তি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি চীনা প্রতিষ্ঠানটি আদৌ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে পারবে কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয় বৈঠকে। এই অবস্থায় প্রয়োজনে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়েও কথা হয় বৈঠকে।
এ বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে মতামত জানতে ই-মেইলে সিনোহাইড্রো করপোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফখরুজ্জামান বলেন, গত ১৮ মে এমএএনের দল পুনরায় প্রকল্প সাইটে ফিরেছে। জার্মান সরবরাহকারী যেসব আইটেমের কথা বলেছে, সেগুলো পুনঃস্থাপন করতে হবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে। সিনোহাইড্রোও কাজ করছে।
'চীনা ও জার্মান প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে নতুন করে মতবিরোধ না হলে আগামী এক বছরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।
অতীত রেকর্ডও সুবিধার না
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে প্রশস্তকরণ প্রকল্পের কাজ হেলাফেলায় করেছে সিনোহাইড্রো। ১৯২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়ক নির্মাণের সিংহভাগ কাজই পেয়েছিল চীনা প্রতিষ্ঠানটি।
২০১০ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল মাত্র তিন বছরে। কিন্ত ৫ বছর অতিরিক্ত সময় নেয় প্রতিষ্ঠানটি, যার ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ব্যাপক ভোগান্তিতে পোহাতে হয় মানুষকে।
ওই সময় তৎকালীন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও যোগাযোগ সচিব এম এন সিদ্দিক একাধিকবার প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণের কাজের জন্য সিনোহাইড্রো পরে বাংলাদেশের কাছে প্রাথমিক চুক্তির চাইতে বাড়তি ৫১১ কোটি টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে কাজ করবে না, এ দাবিতে ওই সময় প্রায় চার মাস কাজ বন্ধ রাখে প্রতিষ্ঠানটি। পরে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকের পর তারা কাজ শুরু করে।
চুক্তি অনুযায়ী নতুন রাস্তা নির্মাণের পাশাপাশি পুরোনো রাস্তা মেরামতের কথা থাকলেও সিনোহাইড্রা মেরামতের কাজ করেনি।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আরো জানান, প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজকে জিম্মি করে পদ্মা সেতুর নদীশাসনের কাজও দাবি করেছিল। পদ্মা সেতুর নদীশাসনের কাজ তাদের দেওয়া হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করবে বলে জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
পরে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসনের কাজও বাগিয়ে নেয় সিনোহাইড্রা। চুক্তি অনুযায়ী চার বছর, অর্থাৎ ২০১৮ সালের মধ্যে এই কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা হয়নি।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক টিবিএসকে বলেন, প্রকল্প কাজে আমাদের সক্ষমতার অভাবে বিদেশি ঠিকাদাররা তার ফায়দা লুটছে।
তিনি বলেন, 'ঠিকাদাররা প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা দিয়ে নিম্নমানের কাজ, যেনতেনভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এবং বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ করে। এটা বন্ধ করতে হলে আমাদের নিজেদের সিস্টেম আগে পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যদি নিজে ঠিক থাকি, তাহলে কোনো ঠিকাদারই যেনতেনভাবে ভুল নকশায় এবং দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে না।'