বাঘ ইকো ট্যাক্সি: জুলাই থেকে উৎপাদনে যাবে দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার
এমন একটি পরিবহন কল্পনা করুন যা পরিবেশবান্ধব; যাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলেও তেমন গরম অনুভূত হয় না; যাতে চড়লে আপনি অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় নিরাপদ বোধ করেন। কেমন হবে যদি এধরনের একটি পরিবহনে চড়তে আপনার তেমন খরচও না হয়?
শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে এমনই একটি পরিবহন। জুলাই মাসে উৎপাদনে যাচ্ছে দেশের নিজস্ব উৎপাদিত প্রথম বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার 'বাঘ ইকো ট্যাক্সি'।
থ্রি-হুইলারটি বাজারে আনছে বাঘ মোটরস। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই বিক্রি শুরু করবে তারা৷
বাঘ মোটরসের মালিক কাজী জসিমুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, "আমরা গাজীপুরে একটি কারখানা স্থাপন করেছি এবং এই জুলাইয়ে উৎপাদনে যাব।" আগামী সপ্তাহগুলোতে চীন থেকে কিছু মেশিনারি আসবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। জুন মাস জুড়ে ইনস্টল করা হবে সেসব।
তিনি বলেন, বর্তমান কারখানার ক্ষমতা মাসে ৫ হাজার ইউনিট।
এছাড়া, সড়কে চলার অনুমতি পাওয়া দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার বাঘ ইকো ট্যাক্সি। মার্চ মাসে গাড়িটিকে রাস্তায় চলার অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)।
উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি নিরাপদ এই গাড়ির দাম ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা, জানান বাপ্পি।
শুধুমাত্র বাঘ ইকো ট্যাক্সির জন্য তৈরি একটি রাইড-শেয়ারিং অ্যাপ্লিকেশন চালু করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বাঘ মোটরসের তৈরি সব যানবাহন কোম্পানির দ্বারা ডিজাইন করা একটি ইকোসিস্টেমের অধীনে থাকবে যাতে সমস্ত থ্রি-হুইলারগুলোতে তারা সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে।
বর্তমানে, গাড়িটির দুটি মডেল রয়েছে। একটির ক্ষমতা ১৫০০ ওয়াট এবং অন্যটির ক্ষমতা ১৮০০ ওয়াট।
অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তাকে
বিআরটিএ-র কঠোর পরীক্ষা এবং স্ক্রিনিং পাস করার পর সড়কে চলার জন্য সরকারি অনুমোদন পায় বাঘ ইকো ট্যাক্সি; যেখানে এধরনের অন্যান্য বেশিরভাগ যানবাহনই অবৈধ বলে বিবেচিত হয়।
যদিও সরকারি অনুমোদন পাওয়া সহজ ছিল না। অনুমোদন পেতে প্রায় দুই বছর সময় লাগে কোম্পানির।
মালিক বাপ্পি বলেন, "২০২০ সালের এপ্রিলে আমরা ১১টি যানবাহন তৈরি করি। তারপর থেকেই আমরা গাড়িগুলো সড়কে চলার জন্য সরকারি অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। অবশেষে মার্চ মাসে আমরা অনুমোদন পাই।"
বাপ্পি জানান, পরিবেশবান্ধব ডুয়াল পাওয়ার-ব্যাটারি এবং সৌরচালিত থ্রি-হুইলারটি যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের জন্য একটি আরামদায়ক বিকল্প হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
গাড়িটির নিরাপত্তা বিষয়ক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো, যাত্রীর সিটের সাথে রাখা 'প্যানিক বাটন'। এই বাটনে চাপ দিলে তৎক্ষণাৎ গাড়ির গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটারে নেমে আসবে।
এরপর বিশ মিনিটের জন্য অচল হয়ে যাবে গাড়িটি। একইসঙ্গে এই বাটন কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করতে সক্ষম। গাড়িটির জন্য তৈরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে একটি সংকেত পাঠাবে বাটনটি; যাতে করে কর্তৃপক্ষ ট্যাক্সির কার্যকারিতা নিষ্ক্রিয় করতে পারে।
থ্রি-হুইলারটিতে রয়েছে নিরাপত্তা ক্যামেরাও; যা একটি কেন্দ্রীয় সার্ভারে সমস্ত ভিডিও রেকর্ড ও সংরক্ষণ করবে। এছাড়া, রয়েছে এমবেড করা রিয়াল-টাইম জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম।
বাপ্পি জানান, তারা একটি মনিটরিং সিস্টেম তৈরি করেছেন যা থ্রি-হুইলারের রিয়াল-টাইম অবস্থান দেখাবে। একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে এর রক্ষণাবেক্ষণের বিবরণ দেখতে পাবেন তারা।
গাড়িটি তৈরির বিষয়ে বাপ্পি বলেন, তারা গাড়িটি তৈরিতে উচ্চ-গ্রেডের ইস্পাত ব্যবহার করেছেন যা সাধারণত বড় যানবাহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। গাড়ির সহনশীলতা এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয়েছে এটি।
এছাড়া, সাধারণ সিএনজি-চালিত থ্রি-হুইলার এবং হিউম্যান-হলারের চেয়ে বড় চাকা থাকবে বাঘ ইকো ট্যাক্সিতে। পাশাপাশি অ্যান্টি-লক ব্রেক সিস্টেম (এবিএস) সহ একটি হাইড্রোলিক ব্রেকিং সিস্টেমও থাকবে।
পরিবেশবান্ধব এই গাড়িটি লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার করবে।
বর্তমানে এধরনের যানবাহনে ব্যবহৃত ব্যাটারি সীসা এবং অ্যাসিড দিয়ে তৈরি, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হয় না বলেও উল্লেখ করেন বাপ্পি।
অন্যদিকে, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি পরিবেশবান্ধব এবং প্রায় সাত বছর স্থায়ী হয়, তিনি বলেন।
গাড়িতে ব্যবহৃত একটি ৪৮০ ওয়াটের সোলার প্যানেল দিনের বেলায় ৪০ শতাংশ চার্জ সঞ্চয় করতে পারে। যার ফলে অতিরিক্ত ৪০ কিলোমিটার যেতে পারবে গাড়িটি।
গাড়িটিতে ড্যাশবোর্ড মনিটরিং সিস্টেম, চুরি-বিরোধী প্রযুক্তি এবং গতি পর্যবেক্ষণসহ আরও অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
আরামদায়ক যান
দেশের রাস্তায় বর্তমানে চলা থ্রি-হুইলারগুলোর দুটি প্রধান ত্রুটি রয়েছে। যানবাহনগুলো চলার সম্য উচ্চ শব্দ করার পাশাপাশি সেগুলো অস্বস্তিকরভাবে গরম।
বাঘ ইকো ট্যাক্সিতে এই দুটি বিষয় সমাধানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ চালিত এই গাড়িটি প্রায় শব্দহীন। অন্যদিকে, এর অভ্যন্তরীণ বায়ুচলাচল ব্যবস্থা এবং ফ্যান এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে ভেতরের তাপমাত্রা কখনোই ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না হয়।
এমনকি ট্যাক্সির যাত্রীরা যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় গাড়িতে থাকা সীমাহীন ইন্টারনেট পরিষেবাও পাবেন। এছাড়া যাত্রীদের জন্য রয়েছে একটি ট্যাবলেট, যা বিনোদন বা অফিসিয়াল কাজের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
যদি কোনো যাত্রীর ফোন বা ল্যাপটপের ব্যাটারি শেষ হয়ে যায়, তাহলে তাদের জন্য রয়েছে একটি চার্জার ক্যাবিনেটও।
বাঘ ইকো ট্যাক্সি সবার জন্য সহজলভ্য করার জন্য তারা একটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ্লিকেশনের কথা ভাবছেন বলে জানান বাপ্পি। তবে চাহিদা এবং অ্যাপ তৈরির সুযোগ বিবেচনা করে অ্যাপ তৈরি নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, "বিভিন্ন এলাকা বা জোনে চললেও এই ইজিবাইকের জন্য অভিন্ন রং ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।"
কম খরচে যাত্রা
যেখানে অন্যান্য পরিবহনে খরচ বেড়েই চলেছে সেখানে যাত্রীদের জন্য স্বস্তি হিসেবে আসতে পারে বাঘ ইকো ট্যাক্সি।
ট্যাক্সিগুলো চলতে খরচ হয় কম। প্রতি কিলোমিটারে গাড়িটি চলতে খরচ হতে পারে ১.৩৩ টাকারও কম। সম্পূর্ণ চার্জে ১৫০০ ওয়াটের গাড়িটি ৯০ কিলোমিটার চলতে পারে। এতে চালকের খরচ হয় ১২০ টাকা।
১৮০০ ওয়াটের গাড়িটি যেতে পারে ৮০ কিলোমিটার।
চার্জ করার জন্য বাঘ মোটরস একটি দ্রুত চার্জিং প্রযুক্তি তৈরি করেছে। গাড়ির ৬০ ভোল্টের ব্যাটারি সম্পূর্ণ চার্জ হতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগবে।
শিগগিরই তারা গাড়িটিতে একটি মোশন-চার্জিং সিস্টেম যুক্ত করবে। এতে করে গাড়িটি চলমান অবস্থায় এর ব্যাটারি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হবে।
বাপ্পি বলেন, বিদ্যমান ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকগুলোর অনেকগুলো অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করে চার্জ করা হচ্ছে, কিন্তু ইকো-ট্যাক্সির ক্ষেত্রে তা করার কোনো সুযোগ নেই।
"এটি শুধুমাত্র আমাদের তৈরি চার্জিং পয়েন্টে চার্জ করা যাবে। চার্জিং পোর্টে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সহ একটি মাইক্রোচিপ ইনস্টল করা হয়েছে। একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পোর্টটি খোলা হবে। গাড়ির মালিক নির্দেশ দিলেই চার্জিং শুরু হবে।"
প্রতিটি চার্জিং সেশনের জন্য ডিজিটালভাবে বিল পরিশোধ করার পরই চার্জ শুরু হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকলে রাতে গাড়ি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ করার জন্য একটি ব্যাটারি ব্যাংক স্থাপন করা হবে।
"আমাদের সব লেনদেন ডিজিটালভাবে করা হবে এবং আমরা ইতোমধ্যে ৪৯টি ব্যাংকের সাথে এই বিষয়ে চুক্তিতে পৌঁছেছি," বলেন বাপ্পি।