পর্দায় বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের চিত্রায়নে কেন পরিবর্তন আনা জরুরি?
মুক্তির পরই হিটের খাতায় নাম লিখিয়েছে জেমস বন্ড সিরিজের ২৫ তম সিনেমা নো টাইম টু ডাই। কিন্তু, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রের তিন খলনায়ক চরিত্রের মধ্যে প্রত্যেকের চেহারাতেই 'বিকৃতভাব' ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হলিউড চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে সক্ষম, বিকলাঙ্গ, দগ্ধ কিংবা কোনো দুর্ঘটনায় বিকৃতির শিকার ব্যক্তিদের নেতিবাচক চরিত্রে চিত্রায়নের ধারাকেই নতুনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এই চলচ্চিত্র।
জেমস বন্ডের খলনায়কদের ইতিহাস ঘাটালে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ খলনায়কের চেহারাই ছিল বিকৃত। এছাড়া, অনেকেই ছিল শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার। বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের স্টেরিওটাইপ থেকে এতকালেও বের হতে পারেনি জেমস বন্ড ফ্র্যাঞ্জাইজি।
সিনেমায় খলনায়ক চরিত্রের বিপরীতে জেমস বন্ডের মতো প্রধান ও নায়কোচিত চরিত্রে অভিনয় করা প্রত্যেকেই শারীরিকভাবে সক্ষম।
শুধু জেমস বন্ডই নয় স্টার ওয়ার্স, ডিজনি ক্লাসিকগুলোও এখনও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়নের পুরোনো ধারাতেই আটকে আছে। কাহিনীর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতেও প্লটে যেন নতুন কিছু খুঁজে পাচ্ছে না তারা।
চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের চিত্রায়ন
পিটার প্যান কিংবা লায়ন কিংয়ের মতো অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রেও ক্যাপ্টেন হুকের পা নেই, স্কারের মুখে রয়েছে ক্ষত চিহ্ন। দুটো সিনেমাতেই তাদের প্রতিবন্ধকতাকে হাতিয়ার বানিয়ে তাদের চরিত্রের নামকরণ করা হয়েছে।
এছাড়া, ওন্ডার ওম্যানের ডক্টর পয়জন, হ্যারি পটারের ভল্ডেমর্ট কিংবা স্টার ওয়ার্সের কাইলো রেন ছাড়াও এমন আরো বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে। হরর ও সাইফাই সিনেমায় এ ধরনের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব চরিত্রের পেছনে থাকে এক ট্রাজিক অতীত। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তাদের মুখায়বের বিকৃতি বা শারীরিক অঙ্গহানি ঘটে। চরিত্রগুলো সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে খলনায়কের রূপ ধারণ করে।
বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের নিয়ে সরব অ্যাক্টিভিস্টরা একই ধারার এই চিত্রায়নকে হলিউডের অলসতা, একঘেয়েমি ও সময়ের থেকে পিছিয়ে পড়া চলচ্চিত্র বলছেন।
একইসঙ্গে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব চরিত্রে অভিনয় করা অভিনয়শিল্পীদের বাস্তব জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে তাদের মুখে কোনো ক্ষত নেই এবং তারা স্বাভাবিক জীবনযাপনে সক্ষম। হলিউডের এই বিষয়টিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন অনেকে।
পরিবর্তন কেন জরুরি?
বাস্তব জগতে এমন বহু মানুষ আছেন যারা অগ্নিদগ্ধ কিংবা এসিড আক্রান্তের শিকার। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কিংবা জন্মগতভাবেই অনেকের মুখায়ব আর দশজনের থেকে ভিন্ন। চলচ্চিত্রের এই নেতিবাচক উপস্থাপন তাদের জন্য ক্ষতিকর।
পর্দায় বারবার তাদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে সমাজে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণারই পুনঃউৎপাদন ঘটছে।
বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিরা তাদের প্রতিবন্ধকতা ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে কিংবা ভিন্নভাবে তার চিত্রায়ন দেখতে চান।
ডিজঅ্যাবিলিটি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ টম সেক্সপিয়ার বলেন, "কোনো চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, কাহিনির প্লট হিসেবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার প্রদর্শন খুবই সহজ শর্টকাট। এই চিত্রায়নগুলো যথাযথ নয়। এসব কাহিনি প্রতিবন্ধকতার শিকার মানুষদের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটাতেও ব্যর্থ। এ ধরনের স্টেরিওটাইপের প্রদর্শন সমাজের বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের প্রতি নেতিবাচক ধারণাকেই জোরদার করে। একইসঙ্গে, ডিজঅ্যাবিলিটি সম্পর্কে মানুষের মাঝে ভুল ধারণা ছড়ায়।"
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন চেঞ্জিং ফেসেসের তথ্য অনুসারে, মুখায়বে ভিন্নতা থাকা মানুষ আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি বোধ করেন। নিজেদের শারীরিক প্রতিচ্ছবি এবং আত্মমর্যাদা বোধ নিয়ে তাদের সংগ্রাম করতে হয়। সমাজ কিংবা পপুলার সংস্কৃতিতে তাদের চিত্রায়ন যথাযথ না হওয়ায় তারা মানসিকভাবে হীনম্মন্যতায় ভুগেন।
প্রতিষ্ঠানটি শারীরিকভাবে ব্যতিক্রম ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াতে "আই এম নট ইওর ভিলেইন" নামের ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে। পর্দায় সমানভাবে এই ব্যতিক্রম প্রদর্শনের লক্ষ্যেই তাদের লড়াই।
বিশেষভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের খলনায়ক বা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের চিরন্তন ধারা থেকে বের হয়ে আসা তাই জরুরি। স্রেফ খলনায়কের বাইরেও আকাঙ্খিত ব্যক্তি কিংবা নায়কোচিত চরিত্রে তাদের চিত্রায়নের সময় এসেছে।
- সূত্র: স্ক্রল ডট ইন