আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প: মুনাফাই শেষ কথা?
এ এমনই এক সঙ্কট, যার সঙ্গে অন্য কোনো সঙ্কটের মিল নেই। এ এমনই এক সময়, যার সঙ্গে নেই মিল অন্য কোনো সময়ের।
এখন সময় হয়েছে মানুষের পাশে খাবার নিয়ে, আর্থিক সহায়তা এবং লড়াই করার সাহস যোগানোর জন্য দাঁড়ানোর। ব্যবসায় মানুষের চেয়ে লাভ-লোকসানের গুরুত্ব বেশি দেওয়ার সময় এটি নয়।
কিন্তু আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার মালিকেরা, দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায় সবাই, এই ঘোরতর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও আমাদের দেখাচ্ছেন তাদের নির্দয় চেহারা, গণহারে শ্রমিক ছাটাই করার মাধ্যমে।
এই যে এক নজিরবিহীন পরিস্থিতি, যার মুখোমুখি কোনোদিনই হননি শ্রমিকেরা, এমন পরিস্থিতিতের মালিকেরা শ্রমিকদের চাকরি কেড়ে নিচ্ছেন; বেঁচেবর্তে থাকার মতো ন্যূনতম যতটুকু টাকা তাদের দরকার, দিচ্ছেন তার চেয়েও কম।
তাদের এই অনুভূতিহীন কর্মকাণ্ড সেইসব আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাবিদের সেই উদাত্ত আহ্বানের একেবারেই পরিপন্থি, যারা জোরালভাবেই দাবি তুলেছেন, শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই বন্ধ করে দেওয়া নয়, বরং মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেও পঙ্গু করে দেওয়া এই করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারির কালে কোনোভাবেই ব্যবসা থেকে শ্রমিক ছাটাই করা চলবে না। অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে মোকাবেলা করারও ডাক দিয়েছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ পেনি গোল্ডবার্গের প্রস্তাব জানা যাক।
যে কোনো মূল্যেই শ্রমিক ছাটাই এড়িয়ে যেতে বলেছেন তিনি। বলেছেন, 'সম্ভব হলে খণ্ডকালীন কিংবা অল্প কয়েক ঘণ্টার জন্য কাজ চালু রাখুন। শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার মতো টাকা যদি কোম্পানির কাছে না থাকে, তাহলে টাকা না দিন, কিন্তু তাদের ছাটাই করবেন না।'
তার মতে, কারও চাকরি রেখে দেওয়াটা (এমনকি যদি সেটি কেবলই কোনো চাকরির বিভ্রম হয়েও থাকে) তাকে অতি প্রয়োজনীয় মানসিক সমর্থন জোগাবে এবং তাকে ভাবাবে, আমরা সবাই এই পরিস্থিতিতে একসঙ্গে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রয়েছি। অন্যথায়, আমরা শুধু একটা মন্দা পরিস্থিতিই ডেকে আনব না, বরং জনশৃঙ্খলাও সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়বে।
আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের সিনিয়র ফেলো মেগান গ্রিনি মনে করেন, এই বৈশ্বিক মহামারির সময়ে কোনোমতেই শ্রমিক ছাটাই করা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে না।
তিনি বলেন, সবচেয়ে নাজুক শ্রমিকদের ক্ষতি যত কম হয়, সেটি নিশ্চিত করার প্রতি রাজনীতিবিদদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। শ্রমিক ছাটাই এড়িয়ে একটি ওয়ার্ক-শেয়ারিং প্রোগ্রাম বা কাজ ভাগ করে নেওয়ার ব্যবস্থা চালুরও পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি উল্লেখ করেন, 'অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডে ওয়ার্ক-শেয়ারিং ভীষণ সাফল্যের সঙ্গে কাজে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ছাটাই করার বদলে, বরং তাদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা যায়।'
কিন্তু আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার মালিকেরা তাদের এই নির্দয় কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ মেয়াদি পরিণতিকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না।
এমনকি কারখানা থেকে শ্রমিক ছাটাই না করতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) যে আহ্বান জানিয়েছে, সেটিকেও তারা পাত্তা দিচ্ছেন না। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এই সংস্থাটি অবশ্য সেই অনুরোধ জানানোর পর একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে আছে। গণহারে কর্মী ছাটাই থেকে কারাখানাগুলোকে নিবৃত্ত করতে মালিকপক্ষের সঙ্গে জোরাল কোনো মধ্যস্থতা করেনি এটি।
সোজাসাপ্টা বলতে চাই, মালিকদের এই কর্মকাণ্ডকে আমরা 'বেআইনি' অভিধায় অভিহীত করতে পারব না; কেননা, শ্রম আইন ২০০৬-এর বিধানকে অবলম্বন করে গণহারে ছাটাইয়ের অধিকার তাদের রয়েছে।
আইনি বিধানটি কী বলে?
শ্রম আইনের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে, 'অগ্নিকাণ্ড, আকস্মিক বিপত্তি, যন্ত্রপাতি বিকল, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ, মহামারি, ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা অথবা মালিকের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত অন্য কোনো কারণে প্রয়োজন হইলে, কোনো মালিক যে কোনো সময় তাহার প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা বা শাখাসমূহ আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন এবং যে কারণে উক্তরূপ বন্ধের আদেশ দেওয়া হইবে তাহা বিদ্যমান থাকা পর্যন্ত এই বন্ধের আদেশ বহাল রাখিতে পারিবেন।'
শ্রমিক ছাটাই থেকে মালিকদের লাভ কী হবে?
অনুচ্ছেদ ১৬ অনুসারে, শ্রমিকদের 'উল্লিখিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হইবে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মোট মূল মজুরী এবং মহার্ঘ ভাতা এবং এডহক বা অর্ন্তবর্তী মজুরী, যদি থাকে, এর অর্ধেক এবং তাহাকে লে-অফ করা না হইলে তিনি যে আবাসিক ভাতা পাইতেন, তাহার সম্পূর্ণের সমান৷'
ফলে মালিকপক্ষের কর্মকাণ্ডকে আমরা বেআইনি বলতে পারি না। কিন্তু তাদের এই কর্মকাণ্ড কি নৈতিক? কোনো কর্মদাতা কি তার কর্মচারিকে এমন সঙ্কটকালে ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন?
এই মালিকগণ, অতীতে যারা বিরাট সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন এইসব শ্রমিকের কারণেই- যারা বছরের পর বছর ধরে, ক্লান্তিহীনভাবে নিজ নিজ মালিকের জন্য কাজ করে গেছেন, এখন এই দুরাবস্থায় পড়ে যাওয়া সেই শ্রমিকরাই তাদের কাছে আচমকা বোঝা হয়ে উঠলেন, যে, তাদের প্রতি এমন নির্দয় হয়ে ওঠলেন মালিকেরা। তারা যেন এখন এই ভাইরাসটির মতোই বিপজ্জনক। এ কারণে তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার মালিকেরা তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করতে উঠে পড়ে লেগেছেন!
গত বছর যে খাত থেকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক অর্থমুদ্রা এসেছে, যা কি না দেশের রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮৪ ভাগ, আচমকাই সেটি এত দুর্বল হয়ে গেল- নিজেদের শ্রমিকদের বিনা পারিশ্রমিকে এক মাসের বেতনও দিতে পারবে না! তারা কি দেউলিয়া হয়ে গেছেন; শ্রমিকদের ছাটাই করা ছাড়া টিকে থাকার কোনো রাস্তাই দেখছেন না?
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে সরকার যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, সেই টাকা প্রকৃত অর্থে করের টাকা- এ ব্যাপারেও এই মালিকদের ভাবলেশ নেই।
কারা এই করদাতা? তারা সাধারণ মানুষ ও সেইসব পোশাকশ্রমিক- যাদের হুট করেই চাকরি থেকে ছাটাই করে দেওয়া হয়েছে। তারা সেই শ্রমিক- যারা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে অসংখ্যবার রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন, এবং যখনই কিছু কেনেন, কর দেন। তার মানে, মালিকদের প্রণোদনা প্যাকেজটি শ্রমিকদেরই দেওয়া। বিগত বছরগুলোতেও যখনই সরকার তৈরি পোশাকশিল্প কারখানাগুলোকে কোনো আর্থিক সুবিধা দিয়েছে, সেই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকেই দেওয়া হয়েছে; তার মানে, সেই টাকা এই শ্রমিকদেরই।
কিন্তু তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার মালিকেরা সুবিধামতো সবকিছু ভুলে গেছেন এবং এই মহাসঙ্কটকালে নিজেদের শ্রমিকদের দিক থেকেই ফিরিয়ে নিয়েছেন মুখ।
এই বৈশ্বিক মহামারির প্রভাবে কর্মীসংখ্যা সামলানো দুরূহ হয়ে ওঠায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কোম্পানিও শ্রমিক ছাটাই করেছে। কিন্তু সেসব দেশের শ্রমিকেরা আমাদের শ্রমিকদের মতো এত অসহায় নন। চাকরি চলে গেলে বেকার শ্রমিকরা সরকারের কাছে এই সঙ্কটকালে সাহায্যের আবেদন করতে পারেন, কিংবা চাইতে পারেন বেকারভাতার সুবিধা।
কিন্তু আমাদের চাকরিহীন শ্রমিকদের জন্য 'সুবিধা' শব্দটির এখন একমাত্র অপশন হলো- অনাহারে থাকা।
- ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
মূল লেখাটি পড়তে চাইলে: Our RMG: Where only profits matter?