ইরানের বিজ্ঞানী হত্যার পর কোন দিকে যাবে ট্রাম্প?
সম্প্রতি ইরানের খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ মাহবাদী'র গুপ্তহত্যার ঘটনায় ইরান-পাশ্চাত্য উত্তেজনার পারদ বেশ চড়ে গিয়েছিল।
গত শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানী তেহরানের কাছে দামাভান্দ অঞ্চলের আবসার্দ শহরের একটি সড়কে এক সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন ইরানী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবন সংস্থা প্রধান, ইসলামী বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, ইমাম হুসাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ড. মোহসেন ফাখরিজাদেহ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০০ বিজ্ঞানীর একজন।
১৯৫৮ সালে ইরানের কোম শহরে জন্ম নেয়া এই বিজ্ঞানী বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরানের পারমাণবিক, চিকিৎসা, অণুজীববিজ্ঞান সহ প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক কারিগরী ও প্রযুক্তিগত গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন এবং এসব ক্ষেত্রে অসংখ্য বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। সম্প্রতি কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজ্ঞানী ফাখরিজাদেহ পরিচালিত একটি গবেষণা কেন্দ্র থেকেই সর্বপ্রথম ইরানের জনগণের জন্য করোনাভাইরাসের টেস্ট কিট উৎপাদন করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমির হাতামি। অর্থ্যাৎ নিঃসন্দেহে বলা যায় ফাখরিজাদেহ হত্যাকাণ্ড ইরানের পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় এক বড় ক্ষতি।
এই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহের তীর চলেছে পশ্চিমাবিশ্বের মিত্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের দিকে। এমন হত্যাকাণ্ডের প্রধান লক্ষ্য ইরানের কৌশলগত গবেষণাকর্ম বাধাগ্রস্ত করা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া যাতে দেশের কৌশলগত গবেষণা বন্ধ হয়ে যায় এবং ইরান যাতে এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে না পারে; এমনটাই দাবী করেছে ইরানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ২০১৮ সালে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মোহসেন ফাখরিজাদেহকে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী 'আমাদ' (১৯৮৯-২০০৩) পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। ফাখরিজাদেহকে আমাদ এর প্রধান হিসেবে বর্ণনা করে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, "ফাখরিজাদেহ'র নামটি মনে রাখবেন।" এছাড়াও ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ২০১৮ সালেই এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ইরানের এই শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "আমি ফাখরিজাদেহকে ভালো করেই চিনি। তিনি নিজেও জানেন না আমি তাকে কত ভালোভাবে চিনি। আমি যদি তাকে রাস্তায়ও দেখি তবে চিনতে পারব।"
অর্থাৎ পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মোহসেন ফাখরিজাদেহ অনেক আগে থেকেই ইসরায়েলের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন।
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ বাকেরি হুঁশিয়ারি জানিয়ে বলেন, মোহসেন ফাখরিজাদেহ হত্যার কঠিন প্রতিশোধ নেবে তেহরান। তিনজন মার্কিন কর্মকর্তা, যাদের দুইজন গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত তারা জানিয়েছেন এই হত্যাকাণ্ডের সাথে ইসরায়েল জড়িত, যা এই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ইরানের ৪ জন বিজ্ঞানী গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। ইরানের দাবি, এই সকল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইরায়েলের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের এমন অভিযোগ সরাসরি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেনি।
মূলত ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই চায় না ইরান পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হোক। এ লক্ষ্যেই ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই জার্মানিসহ জাতিসংঘের ৫ টি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ও ফ্রান্স) ও ইরানের মধ্যে 'জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন' নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পি ৫+১ চুক্তি নামেও পরিচিত। এই চুক্তির পর ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক কিছুটা উন্নতির পথে আগালেও ওবামা প্রশাসনের আমলে স্বাক্ষরিত হওয়া এই চুক্তি থেকে ২০১৮ সাথে ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে আসে। যার ফলে ফের সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হতে থাকে এই দুই দেশের মধ্যে। ইসরায়েল বরাবরই এই চুক্তির বিরোধীতা করে আসছিলো এবং ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের এমন চাওয়াকেই সফল করেছে।
তবে গত ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আবারো 'জয়েন্ট কম্প্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন' চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। যদি ইরান সম্মতি জানায় তাহলে পি ৫+১ রাষ্ট্রসমূহ ইরানের সাথে আবারও চুক্তিতে ফিরে যাবে এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মি. বাইডেন। ২০১৮ সাথে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বের হয়ে গেলে ইরানও ধাপে ধাপে চুক্তি প্রত্যাহার করে নেয়। তবে এ বছরের জানুয়ারিতে ইরান সরকারও পুনরায় চুক্তিতে ফেরত যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এর মাধ্যেমেই নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শাসনামল শুরু হলে পুনরায় পরমাণু চুক্তিতে ফিরে গিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ইরানের সম্পর্কের উন্নতির কিছুটা আশা দেখা দিয়েছে।
কিন্তু নতুন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণে এখনো বাকি রয়েছে প্রায় ৪৫ দিন। আর এর মধ্যেই গত সপ্তাহে ঘটে গেলো এমন নিন্দনীয় হত্যাকাণ্ড যা পরবর্তীতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের পূর্বের চুক্তিতে ফিরে যাওয়াকে অনেকটাই অনিশ্চিত করে তুলেছে। ফাখরিজাদেহ'র জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ই ইরানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন এই হত্যাকাণ্ডের কঠিন প্রতিশোধ নিতে এবং তারা ঘোষণাও দিয়েছেন পশিচামাদের সাথে আলোচনা বা সমঝোতা এখন অসম্ভব। ইসরায়েল বরাবরই এমনটাই চায়। ট্রাম্পের মধস্থ্যতায় কিছুদিনের ব্যবধানেই মধ্যপ্রাচ্যে তথাকথিত শান্তি স্থাপনে 'ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি'সহ সুন্নি প্রধান দেশ বাহরাইন ও সুদানের সাথে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। অন্যদিকে শিয়া প্রধান ইরান সবসময়ই ইসরায়েলের শত্রু রাষ্ট্র যাকে কিছুদিন পরপরই কোনো না কোনো ঘটানায় উস্কে দিয়ে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ইসরায়েল।
তবে মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ৫ জন বৈজ্ঞানিক হত্যা, চলতি বছরের শুরুতে মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের পি ৫+১ চুক্তি থেকে বের হয়ে এসে ইরানের উপর আবারও অবরোধ আরোপ করা এইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ইরান পাশ্চাত্য বিশ্বের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি এবং অধিক পরিমাণে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধের হুমকি দিয়ে গেলেও কার্যত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ধৈর্য প্রদশর্ন নীতি ইরান বিচক্ষণতার পরিচয়। কারণ ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সিদ্ধান্তে পারমাণবিক অস্ত্রের উছিলা দেখিয়ে ইরাকে আক্রমণ চালায় পশ্চিমা বিশ্ব, সেই ঘটনার কথা ইরান হয়তো মনে রেখেছে। ইরাকের কি পরিণতি হয়েছে তা এখন বিশ্ববাসীর সামনে স্পষ্ট, এবং ইরানের কাছেও। আফগানিস্তান ও সিরিয়াতেও মার্কিন এবং ন্যাটো বাহিনী অবস্থান করছে।
২০১৮ সালের পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া এবং ট্রাম্পের হাতে পেন্টাগনের ক্ষমতা থাকতে থাকতেই ইসরায়েল কর্তৃক ইরানের বৈজ্ঞানিক হত্যা, মূলত আরও খারাপ কোনো ঘটনার ইঙ্গিতবাহী কিনা তা আরও কিছু দিন গেলে বোঝা যাবে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে ইরান আগ্রাসী মনোভাব দেখালেই ইসরায়েল ওয়াশিংটনকে তেহরানের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগে চাপ দিত, এ ব্যাপারটা স্পষ্টই ছিল। ইসরায়েল ট্রাম্প প্রশাসন থাকতে থাকতেই ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করতে চায়। বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর ইসরাইলের এই প্রচেষ্টা সফল হবে না। নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইতোমধ্যেই ইরানের ব্যাপারে তার অবস্থান পরিষ্কার জানিয়েছেন, তিনি পূর্বের চুক্তিতে ফিরতে চান। যেখানে ট্রাম্প প্রশাসন পি ৫+১ চুক্তিকে 'পচনশীল ও ক্ষয়িঞ্চু' আখ্যা দিয়েছে, বাইডেন মনোনীত যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টনি ব্লিনকেনও ইরানের সঙ্গে 'শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী' পারণবিক চুক্তিতে যাওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসন তার শেষ সময়ে ইসরায়েলের মদদে ইরানের ব্যাপারে কী ধরনের সিদ্ধান্তে আসবে তা এখনো অনিশ্চিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ইরানকে চূড়ান্তভাবে উস্কে দিতে এবং ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ দিনগুলোয় কঠোর সিদ্ধান্তে গ্রহণে প্ররোচিত করতেই ইসরায়েল এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সেই সাথে বাইডেন কর্তৃক ওয়াশিংটন-তেহরান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঘোষণাও কট্টরপন্থী ট্রাম্পকে যেকোনো ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করতে পারে, যা নিকট ভবিষ্যতে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ককে আরো হুমকির মুখে ফেলবে। এখন দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার পালাবদলে বাইডেন প্রশাসন এমন নাজুক পরিস্থিকে কতটা সামলে নিতে পারে এবং এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেয়।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।