ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচের আগে জেনে নেওয়া যাক দুই দেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস
ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বৈরথের আঁচ পড়ছে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরেও। ক্ষণে ক্ষণে রাজনীতি এসে যেন চোখ রাঙাছে এ দুই দলের ম্যাচের আগে।
ইউএস সকার ফেডারেশন ইরানের পতাকা থেকে 'আল্লাহ' শব্দটি বাদ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করায় তা নিয়ে ফিফা'র কাছে অভিযোগ জানিয়েছে ইরানের ফুটবল ফেডারেশন। সংবাদ সম্মেলনে ইরানি সাংবাদিকদের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছেন মার্কিন কোচ।
ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক অনেক বছরের। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের বুধবারের (৩০ নভেম্বর) গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা এ দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস তুলে ধরেছে।
১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থান
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ওয়াশিংটন-তেহরানের দ্বন্দ্বের শুরু সেই ১৯৫৩ সালে যখন সিআইএ'র ইন্ধনে ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান।
ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্তের পর অভ্যুত্থানের মুখে পড়েন মোসাদ্দেক। এ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা সিআইএ স্বীকার করে ২০১৩ সালে।
অভ্যুত্থানের ফলে ইরানের ক্ষমতায় আসেন স্বৈরতান্ত্রিক শাহ মোহাম্মদ রেজা পহলভী। তার আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে দুই দশকের বেশি নিবিড় সম্পর্ক ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইরানিদের অসন্তোষের জন্ম হয় এ অভ্যুত্থানের পরই, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব
১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব শুরু হয়। এ বিপ্লবের ফলে ওই অঞ্চলের ইতিহাসের দিক বদলে যায়।
পহলভীর বদলে ইরানের ক্ষমতায় আসে ধর্মভিত্তিক সরকার। আর এ সরকার ওয়াশিংটনের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়েই যাত্রা শুরু করে। পহলভী মিশর হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান।
ইসলামি বিপ্লবের সমর্থন করা ইরানি শিক্ষার্থীরা ১৯৭৯ সালে তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস দখল করে টানা ৪৪৪ দিন ধরে ৫২ মার্কিন কূটনীতিক ও নাগরিককে জিম্মি করে রাখে।
১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ওই জিম্মিসংকটের মধ্যেই তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। এখনো ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কূটনৈতিক যোগাযোগ চালু নেই।
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুতা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায়। যুদ্ধে গোপনে বাগদাদকে সাহায্য করে যুক্তরাষ্ট্র।
পরোক্ষ শত্রুতা
১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পরোক্ষভাবে অনেকবার মোকাবিলার ঘটনা ঘটে। ১৯৮৩ সালে বৈরুতে মার্কিন মেরিন ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলার ঘটনায় ২৪০ জন মার্কিন সশস্ত্র সদস্য নিহত হন।
এ বোমা হামলার জন্য কেউ দায় স্বীকার না করলেও মার্কিন রাজনীতিবিদেরা এটির সঙ্গে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর সংযোগ ছিল বলে মনে করেন।
১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে 'সন্ত্রাসের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক' তালিকায় যোগ করে।
১৯৮৮ সালে মার্কিন নৌবাহিনী একটি ইরানি যাত্রীবাহী বিমানকে ভূপাতিত করে। এতে বিমানে থাকা ২৯০ জন মারা যান। ওয়াশিংটন তখন এ ঘটনাকে 'ভয়াবহ মানবিক দুর্ঘটনা' হিসেবে বর্ণনা করেছিল।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফুটবলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার ম্যাচে ইরানি খেলোয়াড়েরা যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়দের সাদা গোলাপ উপহার দেয়। ওই ম্যাচ ইরান জিতেছিল ২-১ গোলে।
'শয়তানের অক্ষ'
'ওয়ার অন টেরর' শুরুর পর আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের আগমন ঘটে। এ দুই দেশের সঙ্গেই ইরানের সীমান্ত রয়েছে।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ উত্তর কোরিয়া ও ইরাকের পাশাপাশি তেহরানকেও তখন 'শয়তানের অক্ষ' হিসেবে অভিহিত করেন।
২০০০-এর দশকে ইরান পারমাণবিক প্রোগ্রাম শুরু করে। এরপর এটিই ওয়াশিংটন ও ইরানের মধ্যকার শত্রুতার প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।
ইরান কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না বলে দাবি করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
ইরানের পারমাণবিক চুক্তি
বিশ্বের অন্যান্য পরাশক্তি দেশের সহযোগে ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তোলার বদলে তেহরান এর পারমাণবিক কর্মসূচি কমাতে রাজি হয়।
কিন্তু চুক্তি মানেনি যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ সাল থেকেই খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ চুক্তির বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি হতে থাকে। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মাথায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে সরে গিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জোরালো করেন।
এর প্রতিবাদে নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচি বাড়িয়ে তোলে ইরান। ২০২০ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে ইরাকে হত্যা করলে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
তবে ওই হামলার পেছনে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালিয়ে প্রত্যুত্তর দেয় ইরান। এ উত্তেজনার মাঝে তেহরান জানায়, দেশটির বাহিনী ভুলবশত একটি বেসামরিক বিমানকে ভূপাতিত করার ঘটনায় ১৭৬ জন নিহত হয়েছেন।
অচল অবস্থা
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জেসিপিওএ চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
তবে দুই দেশের মধ্যে অনেকগুলো পরোক্ষ আলোচনা হলেও এখনো এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি।
এদিকে বাইডেন প্রশাসন ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিকেই মেনে চলছে। বর্তমানে ইরানে বিক্ষোভ চলায় যেকোনো ধরনের কূটনৈতিক আলোচনার পথ একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে।
মাশা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভে অংশ নেওয়াদের ওপর অত্যাচার চালানোর অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র অনেক ইরানি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধও ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে নাজুক করেছে। ইরানের বিরুদ্ধে মস্কোকে ড্রোন সরবরাহের অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
তাই এমন পরিস্থিতিতে বুধবারের ইরান যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচ দুই দেশের সম্পর্ককে ভালো করতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
তা সত্ত্বেও অনেকে আশা করছেন, এ খেলা রাজনীতিকে ছাপিয়ে যাবে এবং হয়তো দুই দেশের মানুষকে আরেকটু কাছাকাছি আনবে।