জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু আমাদেরকে কী শেখালো
ওটা বেংগা নামের এক কিশোরকে ১৯০৪ সালে কঙ্গো থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। উদ্দেশ্য তাকে চিড়িয়াখানায় রেখে পিগমী হিসেবে প্রদর্শন করা। নিউইয়র্কের ব্রংক্স চিড়িয়াখানার বানরদের জন্য রাখা খাঁচায় ওটা বেংগাকে রাখা হয়েছিল। একশো বছরেরও বেশি সময় পড়ে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডের পর সাংবাদিক পামেলা নিউকিরক এই নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর ঘটনাটি নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় বিশ্বব্যাপী। ব্রংক্স চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সমিতি এই ঘটনার জন্য এখন ক্ষমা চেয়েছে।
বিবিসি জানিয়েছে, ওটা বেংগাকে রাখা হয়েছিল বানরের সাথে। ফলে দর্শনার্থীদের অনেকেই বুঝতে পারতেন না এটা আসলে কী- মানুষ নাকি বানর? ছোটখাটো দেখতে, গায়ের রঙ কালো, দাঁত ছিল খুব তীক্ষè। সেসময় পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায দর্শকদের প্রধান আগ্রহ ছিল তার ধারালো দাঁত। খাঁচার বাইরে একটি নোটিসে লেখা ছিল: ''সেপ্টেম্বর মাসের প্রত্যেকদিন দুপুরে তাকে প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে।'' এমনকী নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় তাকে দর্শনার্থীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় বলে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। বিশেষ করে শিশুরা তাকে দেখে খুব মজা পেতো, হাসাহাসি করতো এবং জোরে চিৎকার করে উঠতো। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে তাকে দেখতে কোনো কোনোদিন খাঁচার আশেপাশে একসঙ্গে পাঁচশো লোকও জড়ো হতো।
১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে ২০ দিনের মতো চিড়িয়াখানায় প্রদর্শন করা হয়। অনেকের প্রতিবাদের পরে তাকে এতিমখানায় পাঠিয়ে দেয়া হলেও, বহু পথ ঘুরে ওটা বেংগা শেষপর্যন্ত হতাশা থেকে ২৮/২৫ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিল। যদিও চিড়িয়াখানার কিউরেটর এমিরেটাস উইলিয়াম বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে ১৯৭৪ সালে এসে বলেছেন ওটা বেংগার প্রতি নিউইয়র্কবাসীদের চরম উৎসাহ প্রদর্শনের নমুনা ছিল। একে বলা যায়, " বন্দী ও বন্দীকর্তার মধ্যে বন্ধুত্ব।"
ওটা বেংগার কাহিনী পড়ার পর আমার মনেহল বেটে মানুষ বা বামণদের নিয়ে কি আমরাও এরকম প্রদর্শনের কাজটা করি না? ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় বাঁদর নাচ দেখাতে একটা লোক আসতো। লোকটার সাথে বানরের সাথে সাথে একটা বামণ লোকও থাকতো। বানরের পায়ে রশি বাধা থাকলেও, বেঁটে লোকটির পায়ে কোন দড়ি ছিলনা। কিন্তু তাও কেন থাকতো সাথে? থাকতো এজন্য যে আমরা বানর খেলা দেখার সময় লোকটিকেও দেখতাম। মানুষটি এই শরীর নিয়ে সবার অনেক উত্তেজনা ছিল। নিউমার্কেটে যারা নভেলে আইসক্রিম খেতে গিয়েছেন বা ইফা ও বেইজিং এ চাইনিজ খেতে গিয়েছেন তাদের সবার মনে আছে নিশ্চয়ই গেট খোলার কাজটি ছিল এই খর্বাকায় মানুষগুলোর। উদ্দেশ্য একটাই মানুষ এদের দেখে আকৃষ্ট হয় ও মজা পায়। এছাড়াও আরো অনেকভাবে এদের প্রদর্শন করি আমরা। অনেকধরণের কাজ থাকলেও এদের গেটেই কাজটা দেয়া হয়, যাতে সবার চোখ পড়ে।
মার্কিন মুল্লুকের বর্ণবাদ নিয়ে এখন দুনিয়া কাঁপছে। থেমে থেমে সেখানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু আমরা কি আমাদের ভেতরে থাকা বর্ণবাদকে অস্বীকার করতে পারি? পারিনা। কারণ দিনরাত আমরা বর্ণবাদ, জাতিভেদকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি। কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে অবলীলায় বলে ফেলি ঐ যে কালো করে মেয়েটি বা ছেলেটি। বলি বউয়ের সবই ভাল, ভাল চাকরিও করে কিন্তু গায়ের রংটা চাপা। কেন এভাবে পরিচয় দেই? দেই এজন্য যে আমরাও ভিতরে-বাইরে বর্ণবাদকে আঁকড়ে ধরে আছি। আর তাইতো এই ২০২০ সালে এসেও কনে দেখার সময় মেয়ের গাত্রবর্ণ সবচেয়ে গুরুত্ব পায়।
অবশ্য অপরটিও ঘটে। আমেরিকায় থাকা পরিবারের একটি উচ্চশিক্ষিত মেয়ে যখন নামিবিয়ার কালো একজন আইনজীবিকে ভালবাসলো, তখনই দেখলাম পরিবার শুদ্ধ হৈচৈ বেধে গেলো। কেন একজন "কাললুকে" বিয়ে করতে হবে? আমেরিকাতে কি সাদা ছেলের অভাব পড়েছে? আমরা যে যেই পরিবেশে থাকি না কেন, যতোটাই পড়াশোনা করিনা কেন বর্ণবাদী এই মানসিকতা থেকে অনেকেই মুক্ত হতে পারছিনা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই আছে যারা কারো সাথে বন্ধুত্ব করার সময় সেই বন্ধুর বা তার পরিবারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার কথা বিচার করে।
আমি এমনও দেখেছি পরিবারে কালো বাচ্চার চাইতে ফর্সা বাচ্চার কদর বেশি। আমার এক খালা গল্প করেছিলেন তার বয়স যখন ১৪ বছর এবং তার বড় বোনের বয়স যখন ১৬ বছর, তখন তার বাবা একটি সোনার চেন এনে তার সামনেই বড় বোনের গলায় পড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, মা তুইতো ফর্সা, এই চেনটা তোর গলাতেই বেশি মানাবে। তাই তোকে আগে দিলাম, ওকে পরে বানিয়ে দিবো। এরকম গল্প কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক আছে। আর আছে বলেই রং ফর্সা করার ক্রীমের বাজার ক্রমশ উর্ধ্বমুখি। আমি একজন পরিচিত মেয়েকে বলেছিলাম এসব ক্রীম মেখোনা, তাহলে চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। ও বলল আপা ফর্সা না হইলে বিয়া হবেনা। আমি এমনও শিক্ষক দেখেছি, যিনি নিজমুখে স্বীকার করেছেন যে ফর্সা বাচ্চাদের উনি কালোদের চেয়ে বেশি নাম্বার দেন।
শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্যাতনে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ত্বক ফর্সাকারী কসমেটিকস কোম্পানিগুলো তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে এই পরিবর্তন কি আমাদের মানসিকতার ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন ঘটাবে? ভারত, বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ব্ল্যাক লাইফ নয়, বরং হোয়াইট স্কীন ম্যাটার করে, সেখানে কি এই আন্দোলন কোন কাজে দেবে? এতদিনের চেপে বসা এই ধরনের ভুল, কুরুচিপূর্ণ, বর্ণবাদি প্রচারণা কি বন্ধ হবে? ত্বক ফর্সাকারী পণ্য মানেই কিন্তু বর্ণবাদী চিন্তাপ্রসূত বিজ্ঞাপন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য কালো রঙকে শক্তি যোগানোর জন্য লিখেছেন, "কালো তা সে যতোই কালো হোক, আমি দেখেছি তার কালোহরিণ চোখ।" যদিও বাংলায় গান আছে যে "কালো যদি এতই মন্দ হয়, তাহলে চুল পাকিলে কান্দো কেন?" কাব্যে যতোই থাকুক, কিন্তু কেউ কি কখনো দেখেছে যে ত্বক কালো করার পণ্যের বিজ্ঞাপণ চলছে? কোন বিজ্ঞাপণে বলা হচ্ছে যে কালো হোন, তাহলে আপনিই বাজার মাত করবেন? না, কখনো তা শুনিনি। আমাদের পরিবারে বা সমাজে বরং উল্টোটাই শুনেছি। শুনেছি ত্বক ফর্সা করুন, তাহলে জয় করতে পারবেন বিশ্ব।
আমার একজন খুব বুদ্ধিমান ও মেধাবী পুরুষ সহকর্মী একবার বলেছিল তার অভিজ্ঞতা বলে দেশের কর্মক্ষেত্রে সুন্দর চেহারার বড়ধরণের প্রাধান্য আছে। যাদের চেহারা ভাল, তারা নাকি ইন্টারভিউ বোর্ডে এক পা এমনিতেই এগিয়ে থাকে। সেখানে মেধার পাশাপাশি তার মতো চেহারার ছেলেমেয়েকে সৌন্দর্যের সাথে পাল্লা দিতে হয়। কারণ সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। এজন্যই বাংলাভাষায় প্রবাদ আছে, " প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী।" ওর কথাটা আমি খুব একটা জোরেসোরে অস্বীকার করতে পারিনি সেদিন। কেন পারিনি এর স্বপক্ষে আমারও অনেক গল্প আছে।
এতো গেল গায়ের রং নিয়ে বৈষম্য। জাতভেদ কি বাংলাদেশে প্রকট নয়? খুব প্রকট বৈষম্য আছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি। বললে গল্পের মতো শোনাবে কিন্তু এই মানুষগুলো ভয়াবহভাবে জাত প্রথার কারণে নিগৃহীত হচ্ছে হোটেলে খেতে গেলে, কারো বাসায় নিমন্ত্রণে গেলে, বাচ্চা স্কুলে পড়তে গেলে এমনকী মারা গেলেও। আমরা কি জানি সুইপারের ছেলে বলে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তাকে দিয়েই প্রধান শিক্ষক সেদিনও স্কুলের টয়লেট পরিস্কারের কাজ করিয়েছিল, সম্ভবত কুষ্টিয়ায়। এতে অবশ্য পরে জনরোষ তৈরি হয়েছিল। এখনো যশোরে দলিত-হরিজনদের দাওয়াত দিলে মাটিতে কলাপাতায় করে খেতে দেয়া হয়। পানি দেয়া হয় মাটির বদনায়। খাওয়ার পর নিজেদেরই সেই জয়গা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দিতে হয়। এমনকী এখানে ধনী হিন্দু ও নি¤œজাতের হিন্দুদের শশ্মানও আলাদা করে দেয়া আছে। যে চিতায় উচ্চবংশীয়রা পুড়বে, সেই চিতায় নি¤œবর্ণের মানুষের জায়গা হবে কেন? আমাদের কাছে এসব অবিশ্বাস্য বা গল্পের মতো মনেহলেও আসলে পরিস্থিতি এমনই। এরাও নানাভাবে অত্যাচারিত হয় কিন্তু কোথাও কোন প্রতিবাদ হয়না।
আমেরিকায় কালো মানুষদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন কিন্তু নতুন কিছু নয়। বারবার এখানে কালোদের জীবন নিয়ে প্রশাসন, সমাজ বৈরিতা প্রদর্শন করে, বারবার কিছু মানুষ নড়েচড়ে উঠে। ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স নামে একটি বেসরকারি সংস্থার চালানো জরিপে দাবি করা হয়েছে যে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি মারা যায় কৃষ্ণাঙ্গরা। দেশটিতে পুলিশি নির্মমতার প্রতিবাদে গায়ক, খেলোয়ার ও তারকারা এই আন্দোলনকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন।
আমরা অনেকেই কালো মানুষদের অধিকার নিয়ে, তাদের প্রতি নিপীড়ণ নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু এই আমরাই অনেকে জানিনা আমাদের দেশের অনেক মানুষ শুধু জাতপ্রথার কারণে সব মানুষের সাথে এক গ্লাসে পানি বা চা খেতে পারেনা। তারা ক্রমাগত নির্যাতিত হচ্ছে সমাজ, প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় শক্তির দ্বারা। ক্ষমতাহীন বলে তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ্দ করা কোন ব্যাপারই না। আমাদের মতো দেশগুলোতে এই সাদা কালোর ভেদাভেদ, জাতপ্রথার বৈষম্য, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান একেবারে ঘরে ঘরে, নগ্নভাবে দেখা যায়।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সাড়া পড়েছিল, বাংলাদেশও এর সাথে ছিল। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষিত মানুষ বিশেষ করে তরুণরা এতে সমর্থন যুগিয়েছিল। আমরা আশা করবো এর চেয়েও আরো অনেক বেশি মানুষ বাংলাদেশের নিজস্ব জাতপ্রথা, বর্ণবাদ, শ্রেণী বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে। নিজেদের বাড়ির কালো মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে বলবে কালোই সুন্দর। বিয়ের কনে খোঁজার সময় কালোকেই অগ্রাধিকার দেবে। সুইপারের সন্তানকে দিয়ে বিজয় দিবসে তার নিজের স্কুলের টয়লেট পরিস্কার করাবে না। কোন মানুষের দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে না ঐ যে হিজড়া যাচ্ছে, ঐ যে মেয়েটি যৌনকর্মী। বলবেনা এরা গরীব, ওরা বড়লোক। ধর্মীয় মৌলবাদ, জাতপ্রথার মতো ঘৃণ্য ব্যবস্থাকে নির্মূল করার আন্দোলনে শামিল হবে --- সেদিনই আমরা বুঝবো জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু আমাদেরও কিছু শিখিয়েছে। মানসিকতার পরিবর্তনটাই জরুরি। আমরাও সেই শুভদিনের অপেক্ষায় আছি।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
৩১ আগষ্ট, ২০২০