বাঙালির পড়া
'পড়া' আমার একটি প্রিয় বিষয়। আপাতত আলবার্তো মাঙ্গুয়েলের প্রবাদপ্রতিম গ্রন্থ 'আ হিস্ট্রি অফ রিডিং' বইটার কথা ভুলে যেতে চাই। এই বইটি মূলত পাশ্চাত্য দুনিয়ার 'পড়া' নিয়ে। আমার বিষয় বাঙালির পড়া।
হরিচরণে 'পড়া' ধাতুর নানা অর্থ। পাঠ করা, উচ্চারণ করা, অভ্যাস করা, অভিমন্দ্রিত বা মন্ত্রপাঠে শক্তিসম্পন্ন করা, বিদ্যা শিক্ষা করা, উপদেশ করা এবং গণনা করা (অঙ্ক পড়া)। তবে আমাদের আলোচনায় 'পড়া' বলতে যে ক্রিয়ার কথা বলা হচ্ছে তা একটি লিখিত বয়ান চোখ দিয়ে পাঠ করা। সেটা উচ্চারিত হতে পারে না-ও পারে। নিরীক্ষণ এখানে আবশ্যিক শর্ত। নিরীক্ষণের মধ্যে পড়ার সঙ্গে দেখা জড়িয়ে আছে।
'শ্রীকান্ত'-এ দেখি, 'শীতের রাতে তিনি লেপের মধ্যে হাত-পা ঢুকাইয়া কচ্ছপের মত বসিয়া বই পড়িতেন, আর আমাদিগকে কাছে বসিয়া তাঁহার বহির পাতা উল্টাইয়া দিতে হইত।'
বনফুলের 'জঙ্গম' উপন্যাসে দেখি, কালীচরণ বকসি এমন তন্ময় হয়ে একটা উপন্যাস পাঠ করছিল যে সিগারেটের ছাই ঝাড়ার অবসর ছিল না। তা লম্বা পোড়া ছাইটা যখন বইয়ের ওপর পড়ল,তখন ফুঁ দিয়ে ছাই পরিষ্কার করতে গিয়ে মোমবাতিটা নিভে গেল।
রবীন্দ্রনাথের 'নিষ্ফল উপহার'-এর গুরু 'পাঠসুখে' এতটাই আচ্ছন্ন যে 'সহসা একটি বালা শিলাতল হতে/ গড়ায়ে পড়িয়া গেল যমুনার স্রোতে' তাতে গুরু 'না তুলিল মুখ'।
তিনটি গল্পে তিনজন পাঠক, প্রথমজন অল্পবুদ্ধি আরামপ্রিয় যুবক, দ্বিতীয়জন নেশাখোর প্রৌঢ়, তৃতীয়জন ঈশ্বরসন্ধানী ভক্ত। তাদের পাঠের বিষয়ও আলাদা। প্রথমজন নিশ্চয় রহস্য বা রোমাঞ্চ সিরিজের কোনো বই, দ্বিতীয়জন উপন্যাস এবং তৃতীয়জন কোনক ধর্মগ্রন্থ পড়ছে। একটাই ঐক্য তাদের মধ্যে আর তা হচ্ছে 'পড়া'।
বিবিধ কারণে আমরা পড়ি। কখনও বাধ্যতামূলক আবার কখনও স্বাধীন ইচ্ছার প্রকাশ। বিভিন্নভাবে আমরা পড়ি। কখনও সরবে, কখনও নীরবে আবার কখনও আধো স্বরে। পড়ার পরিবেশ ভিন্ন। কখনও জনসমক্ষে, কখনও বন্ধুবান্ধব ও প্রিয়জনের অন্তরঙ্গ পরিবেশে আবার কখনও নির্জনে একেবারে একা। পড়ার উদ্দেশ্যও আমাদের আলাদা। কেউ জ্ঞানের জন্য, কেউ বিনোদনের জন্য, কেউ তৃপ্তির জন্য, কেউ নিজের স্বাতন্ত্র্য ঘোষণার জন্য এবং কেউ আবার নিদ্রাকর্ষণের জন্য।
'পড়া' ক্রিয়াটি একমাত্রিক নয়। জটিল ও বহুমাত্রিক। এর দুটো দিক আছে। একটা এই 'পড়া'-র বিবর্তনের ইতিহাস ও অন্যটি 'পড়া'-কে জড়িয়ে নানান সামাজিক চিন্তাভাবনা ও অভিপ্রায়।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন তাঁর অভিধানে 'পড়া'-র সঙ্গে একটি জিনিস যোগ করেছেন। আর তা হলো 'শোনা'।' পাঠ করা ও গুরুপদেশ 'শোন'। আমাদের শরৎচন্দ্রের 'বড়দিদি' গল্পের কথা মনে পড়বে যেখানে সাত বছরের প্রমীলাকে যখন সুরেন্দ্রনাথ বলল Do not move, প্রমীলা পড়তে লাগল Do not move.
বাঙালি শিক্ষিত পরিবারগুলিতে বহুদিন থেকে 'পড়া' সামাজিক জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া হিসাবে পরিগণিত হত। স্বর্ণকুমারী দেবী লিখছেন, 'মাতাঠাকুরানীও কাজকর্মের অবসরে সারাদিনই একখানি বই হাতে লইয়া থাকিতেন'। 'চোখের বালি'-তে আমরা 'বই-পড়া' শুনিতে আসবার কথা দেখি। কিংবা 'চতুরঙ্গ'-এ 'স্কটের একটা গল্প বাংলা করিয়া' পড়ে শোনাবার কথা পাই।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়ির মহিলাদের ফরাসি গল্পের অনুবাদ পড়ে শোনাতেন। 'গোরা' উপন্যাসে পরেশবাবু 'আলোটি জ্বালাইয়া' এমার্সনের বই পড়ছিলেন। 'গৃহদাহ'-তে বীণাপাণি অচলাকে 'সদ্যপ্রাপ্ত একখানা মাসিকপত্র' থেকে ছোটগল্প পড়ে শোনাচ্ছে।
বিনোদিনী পড়ছিলেন 'বিষবৃক্ষ'। নভেল নামে চিহ্নিত এই বইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিশেষত একজন নারীর পড়ায় অনেক বিধিনিষেধ ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রর 'প্রাচীনা ও নবীনা'য় আছে নবীনাদের চারিত্রিক দোষের মধ্যে একটি হলো 'সীতার বনবাস' পড়া। রবীন্দ্রনাথের গল্পে হৈমবতী 'কৃষ্ণকান্তের উইল' পড়তে চায় অথচ তার স্বামী ফকির চায় স্ত্রী 'ভাগবতগীতা' পরুক।
'সুবর্ণলতা'-র নায়িকা রবীন্দ্রনাথের 'প্রভাতসংগীত' পড়ছে আর তাতে পতি দেবতাটির মনে হচ্ছে, 'এ যে দেখছি রসের সাগর।' যারা পড়তে জানে তারাও ভয় পায় মেয়েদের পড়াকে। 'বস্তা বস্তা নাটক-নভেল' পড়াকে তাচ্ছিল্য করে। অথচ 'অলীকবাবু'-র হেমাঙ্গিনীর মনে হয় নভেলে থাকে 'জ্ঞানের কথা'। অশিক্ষিত দাসীকে লেখাপড়া শেখাতে চায় হেমাঙ্গিনী যাতে সে 'নভেল পড়ার সুখ' পায়।
'গোপনপাঠ' নানারকম হতে পারে। পর্নোগ্রাফি থেকে শুরু করে সরকারি কাগজপত্র, বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট, সাধক সম্প্রদায়ের গোপনীয় রচনা, রাজনৈতিক ইস্তেহার, ব্যবসায়ী নথি। অনেকসময় টেক্সটকে রাষ্ট্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এগুলি সবই 'পড়া' -র বিভিন্ন দিগন্ত।
ছাত্রছাত্রীরা আবার লুকিয়ে পড়ার বইয়ের বাইরে একধরনের বই পড়ে থাকে। 'পাগলা দাশু'-তে মাস্টার মশাই এমন একটা বই উদ্ধার করেন। 'যশোবন্ত দারোগা'। 'ক্লাস সেভেনের মিস্টার ব্লেক'-এ 'নেসফিল্ডের গ্রামার'-এর নিচে যে বই পান তাতে শিক্ষক 'ফেরববাজি' পেয়েছ বলে মারতে শুরু করেন।
তবে জীবনানন্দর গল্প উপন্যাসে পড়া সবার থেকে আলাদা। বলা নেই কওয়া নেই 'বই' গল্প শুরুই হচ্ছে বাবা ও ছেলের বই পড়া নিয়ে। বাবা একটা বই পড়ার কথা বলেন তো ছেলে একটা। এইভাবে গল্প এগোয়।আমরা ডিকেন্স, রাসকিন, তলস্তয়, হাক্সলি, প্লেটো, বালজাক ও ওয়ালটার পেটারের নাম দেখে যোগসূত্র খুঁজতে চেষ্টা করি।
বুদ্ধদেব বসুর 'তিথিডোর'-এর নায়িকা যখন বইয়ের পাতা ওলটায়, পাতাগুলো খশখশ করে বলে 'এসো এসো', কালো অক্ষরগুলো বলে 'শোনো শোনো'। যেন প্রেমিক প্রেমিকাকে ডাকছে। নরেশ গুহর কবিতায়, বিলিতি অ্যান্টিকে ছাপা সদ্য কিনে আনা বই 'বুক ভরা গন্ধ দেয়'।
'পড়া' হচ্ছে মানব ইতিহাসে সেই বিরল গোত্র যার কোনো দোসর নেই।
আমার দুই প্রিয় লেখকের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর লেখায় একটি চরিত্র নিটশের খোঁজ করছে।
আমার দ্বিতীয় প্রিয় লেখকটির নাম জীবনানন্দ দাশ। তাঁর সৃষ্ট একটি চরিত্র মালার্মের খোঁজ করছে।