বই পড়ার নীরব বিপ্লবে আপনাকে স্বাগতম
২১ জুলাই, শুক্রবার। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর তিনটায় গড়িয়েছে। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা কাটিয়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষ একে একে জড়ো হতে শুরু করেছে রমনা পার্কে — হাতে রকমারী বই। শুধু বই-ই নয়, কেউ কেউ সঙ্গে এনেছেন চা, ফলমূল কিংবা শতরঞ্জি। কেউ আবার পোষা প্রাণীটিকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য সকলের একটাই: প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে বই পড়ে বিকেলকে উপভোগ করবেন। তবে বই পড়তে এসে হবে না উচ্চস্বরে বাক্যালাপ। নীরবে চলতে থাকবে বই পড়ার কর্মযজ্ঞ।
সম্প্রতি ঢাকায় শুরু হয়েছে নীরবে বই পড়া বা সাইলেন্ট বুক রিডিং-এর কার্যক্রম। ঢাকার মতো যান্ত্রিক শহরের বুকে বই পড়াকে জনপ্রিয় করতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে 'ভলান্টিয়ার অপরচুনিটিজ' নামক একটি সংগঠন। চলতি বছরের জুলাই মাসের তৃতীয় শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে এটি শুরু করেছে এমন আয়োজন।
স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে রমনা পার্ককে। তবে কোনো কারণে রমনা পার্কে আয়োজন করতে সমস্যা হলে বিকল্প উপায় হিসেবে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি। খোলা প্রকৃতির মধ্যে বসে পাঠক যাতে প্রিয় লেখকের বইয়ে ডুব দিতে পারে তার জন্যই নেওয়া হয়েছে এমন উদ্যোগ।
রিডার্স ব্লক থেকেই সূত্রপাত
নীরবে বই পড়া উদ্যোগের নেপথ্যে আছেন মিথুন দাস কাব্য। ভলান্টিয়ার অপরচুনিটিজ সংগঠনের কান্ডারিও তিনি। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া এ সংগঠনটি মূলত তরুণদের নিয়ে কাজ করে।
মিথুনের মতে, তরুণদের মধ্যে শহুরে যান্ত্রিকতায় বই পড়ার নেশা অনেক কমে গেছে। অনেকেই রিডার্স ব্লকে আক্রান্ত। কথায় কথায় নিজের উদাহরণ টানেন তিনি। মিথুন বলেন, 'এক সময় আমি দুই-আড়াই হাজারের বেশি বই পড়েছি। এরপর কাজের জগতে প্রবেশের পর প্রতি মাসে একটি করেও বই পড়া হতো না। এক সময় খেয়াল করলাম, আমি আর বই পড়ে আগাতে পারছি না।'
নিজের সমস্যা উপলব্ধি করে মিথুন বুঝতে পারলেন, বই পড়া নিয়ে এমন সমস্যা শুধু তার একারই নয়, আরও অনেকের মধ্যেই আছে। এরপর শুরু হয় এক নতুন ভাবনা। ভলান্টিয়ার অপরচুনিটিজ-এর সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলেন, নিজেদের মধ্যেই আগে বই পড়ার অভ্যাস চালু করবেন।
প্রথম দিকে মিথুন সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে আয়োজিত মিটিংগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য বই পড়ার কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছিলেন। তার ধারণা ছিল, বদ্ধ ঘরের ভেতরে সদস্যদের নিয়ে মিটিংয়ের আয়োজন করলে তাতে মনোযোগের অভাব থাকে। তাই বেছে নিয়েছিলেন খোলা প্রকৃতিকে। যেখানে তারা বসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও করতে পারবেন আর বই পড়াও হবে।
ততদিনে ভারতের বেঙ্গালুরুর কাবোন পার্কে নীরবে বই পড়া কর্মসূচি নজরে আসে মিথুনের। বলা যায়, তার ভাবনায় অনেকটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে ব্যাঙ্গালোরের কাবোন রিডস। পাশের দেশে এমন উদ্যোগ দেখে মিথুন সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেন, এমন কর্মসূচি কেবল নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। সেই ভাবনা থেকেই নীরবে বই পড়ার কার্যক্রম উন্মুক্ত করে দেন সবার জন্য।
মিথুন বলেন, 'বিভিন্ন পাঠচক্রে অংশ নিতে হলে অনেকসময় সদস্য হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এমন কিছু সীমাবদ্ধতা আমাদের মধ্যেও ছিল। যখন আমরা ভারতের কনসেপ্ট দেখি, তখন আমাদের মনে হয় বই পড়ার কর্মসূচি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়।'
পাঠকমুখর নীরবে বই পড়া কর্মসূচি
রমনা পার্কে শুরু হওয়া নীরবে বই পড়া কার্যক্রমে নিজেদের সদস্যের বাইরে কতজন অংশ নেবেন তা নিয়ে শুরুতে কিছুটা সন্দিহান ছিলেন মিথুন। কিন্তু তার সন্দেহকে ভুল প্রমাণ করে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে অনেক পাঠক অংশ নেন বই পড়ার এই উদ্যোগে। ৫০ থেকে ৬০ জনের এক মিলনমেলা হয়েছিল প্রথম দিনই।
প্রকৃতির নির্জনতায় বই পড়ার অভিজ্ঞতা পাঠকের কাছেও অন্যরকম। চারপাশে গাছপালা, মাথার ওপরে আকাশ, মৃদু-মন্দ বাতাস, পাখির ডাক-এর মাঝে নীরবতায় বই পড়া পাঠকের কাছেও অনন্য অভিজ্ঞতা। মাদুর কিংবা চাটাই বিছিয়ে বসে বই পড়ার পাশাপাশি অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে নিম্নস্বরে আলাপচারিতার সুযোগও অনেকের হয়েছে।
আগত ব্যক্তিরা কী পড়বেন তা অবশ্য নির্ধারিত করা ছিল না। গল্প, উপন্যাস, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ক্লাসের বই কিংবা গবেষণাপত্র যেকোনো কিছুই পাঠক চাইলে পড়তে পারেন। আগত সবার পরিচয় একটাই — তারা পড়তে ভালোবাসেন।
বই পড়ায় কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম এখানে নেই। যে যার ইচ্ছামতো শুয়ে-বসে যেকোনো বই এখানে পড়তে পারেন। কেউ চাইলে সঙ্গে করে বিছানার চাদর, হালকা খাবার, চা, পানি ইত্যাদিও নিয়ে আসতে পারেন। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলে চা পানের সুযোগও এখানে রয়েছে। এমনকি বই না পড়ে ঘুমালেও এখানে কেউ কিছু বলবে না। অনেকে অবশ্য ছোট ছোট শিশুদেরও নিয়ে এসেছেন। বই পড়ার পাশাপাশি মনের মাধুরি মিশিয়ে শিশুদের ছবিও আঁকার দৃশ্যও দেখা গেছে নীরবে বই পড়ার কার্যক্রমে।
অংশ নিতে নেই কোনো শর্ত
বই পড়ার নীরব বিপ্লব সকলের জন্য উন্মুক্ত। প্রবেশের জন্য নেই কোনো শর্ত। যেকেউ চাইলেই অংশ নিতে পারবেন। তবে ভলান্টিয়ার অপরচুনিটিজ প্রতি সপ্তাহে বিষয়টিকে সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন এবং নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার লক্ষ্যে একটি গুগল ফর্ম এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু রেখেছে।
মিথুন বলেন, 'ফেসবুকে ফর্ম দেই যাতে আমরা যোগাযোগ করে তাকে সময় জানাতে পারি। ছোট ছোট নির্দেশনাগুলো দেওয়ার জন্য আমরা যোগাযোগ করি। প্রথমদিকে কীভাবে সবকিছু হবে এই নিয়ে কিছু সমস্যা থাকে। আমি মনে করি, ধীরে ধীরে এই সমস্যা আর থাকবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'গ্রুপ থাকার একটা সুবিধা আছে। কে কী বই পড়ছে, কেউ যদি আসতে না পারে তা নিয়ে আফসোস করছে- এগুলো গ্রুপে ম্যাসেজ দিয়ে সবাই লিখছে। বই পড়ার একটা কমিউনিটি তৈরি হচ্ছে গ্রুপের মাধ্যমে।'
পড়ার পাশাপাশি সামাজিকতা তৈরি
পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ততা তৈরির পর পাঠকের অজান্তেই কথা বলা নিয়ে সচেতনতা তৈরি হতে দেখা গেছে। কেউ কথা বললেও আওয়াজের দিকে সচেষ্ট থেকেছেন। পাশের মানুষটি যাতে বিরক্তবোধ না করেন সেদিকে লক্ষ ছিল বেশি।
এ কার্যক্রমের মাধ্যমে বই পড়ার পাশাপাশি সামাজিকতা তৈরি হচ্ছে বলে জানান মিথুন দাস। তিনি বলেন, 'এখানে অনেকেই তো অপরিচিত। তাই কে কী বই পড়ছেন, কোথা থেকে আসছেন, কেমন লাগছে — ছোট ছোট আলাপচারিতা এখানে হয়। বই পড়ার পাশাপাশি পাশের মানুষটাকে দেখা, তাকে খাবার সাধা — এগুলোর মাধ্যমে মানুষের সামাজিকতা প্রকাশ পেয়েছে। সামাজিকতা না থাকলে আসলে মানুষের আগ্রহও থাকে না।'
সবুজ প্রকৃতির মাঝে বই পড়ায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা অনেক পাঠকের কাছেই নতুন। মুক্ত পরিবেশে এমন আয়োজন দেখে আপ্লুতও হয়েছেন অনেকে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত মিনহাজ অংশ নিয়েছেন এই কার্যক্রমে। তিনি বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই অ্যাকাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়তাম। আমার পড়া শুরু হয় তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানার মাধ্যমে। কিছুদিন আগেই দেখেছি ভারতে সাইলেন্ট বুক রিডিং চালু হয়েছে। হঠাৎ করেই ফেসবুকে আমাদের দেশে বই পড়ার কার্যক্রম নিয়ে পোস্ট দেখে মনে হলো গিয়ে দেখি কেমন হয়।'
মিনহাজ আরো বলেন, 'শুক্রবার রমনা পার্কে আসার আগে আমি ভেবেছিলাম বেশি মানুষ হবে না। কিন্তু গিয়ে দেখি যে যার মতো ছোট ছোট গ্রুপ করে নীরবে বই পড়ছে। ঘরের পরিবেশ এবং প্রকৃতির মাঝে বই পড়ার আনন্দের পার্থক্য আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম।'
রায়হান জহির নামক একজন লেখকও নীরব পাঠচক্রে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, 'মুক্ত পরিবেশে বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়ায় আয়োজকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এমন কার্যক্রম যেন চলমান থাকে। বই পড়ার বড় কমিউনিটি তৈরি হলে আমরা নতুন নতুন পাঠক আর লেখক দুটোই পাব।'
সামাজিক ট্যাবু ভাঙতে নীরব বিপ্লব
যেকোনো স্থানে বই পড়া নিয়ে সামাজিকভাবে আমাদের দেশে এক ধরনের ট্যাবু প্রচলিত আছে। জনবহুল এলাকায় বসে বই পড়লে বইপড়ুয়া ব্যক্তিকে নিয়ে টিটকারি করা, আড়ালে-আবডালে হাসাহাসির প্রবণতা দেখা যায়। সে জায়গা থেকে সর্বসমক্ষে বই পড়ার এ নীরব বিপ্লব সমাজের প্রচলিত ধারণা ভাঙার ক্ষেত্রেও কাজ করবে বলে মনে করেন মিথুন দাস।
তিনি বলেন, 'পাবলিক প্লেসে কেউ কোনো বই নিয়ে এসে মনোযোগ দিয়ে পড়লে অনেকেই ওই ব্যক্তিকে নার্ড ভাবে। অনেক সময় নেতিবাচক মতামতও প্রকাশ করে। আমাদের দেশে সবার সামনে এজন্যই অনেকেই বই সঙ্গে নিয়ে চলতে চায় না।'
পাঠক হাফসা জাহান বলেন, 'গাড়িতে ট্রেনে বা রাস্তায় বই বের করে যখন পড়ি মানুষ এত অদ্ভুত নয়নে তাকায়! অথচ মোবাইলে যারা উচ্চস্বরে ভিডিও দেখে তাদের নিয়ে কোনো ভাবান্তর নেই। সবুজ পার্কে বই পড়ার এই যে ট্রেন্ড, এটা হয়তো আমাদের দেশে যারা বই পড়াকে স্বাভাবিক শখ বা কাজ হিসেবে নেয় না তাদের চিন্তার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাবে।'
অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নীরবে বই পড়ার কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রকাশ করতে দেখা গেছে। অনেকে বলছেন, নীরবে বই পড়ার কর্মসূচি পালন করা কিংবা বই পড়তে পড়তে ছবি তোলা আদতে লোক দেখানো। তবে এ উদ্যোগ নিয়ে ইতিবাচক মানুষের সংখ্যাই বেশি।
পাঠক মহসিন আহমেদ বলেন, যারা লোক দেখানো বলছেন, তাদেরও উচিত এটিকে সমর্থন করা। বসে বসে ফোন ব্যবহার করলে সেটাকে তো সবাই স্বাভাবিকভাবেই নিতো। তাহলে বইয়ের বেলায় কেন নয়?'
বইপ্রেমী সায়মার মতে, লোক দেখানো হলেও এটার দরকার আছে। এ কর্মসূচিকে নিয়মিত চালু রাখতে পারলে ধীরে ধীরে লোক দেখানোর মানুষ কমবে বলে মনে করেন তিনি। 'কারণ তাদের এত ধৈর্য নেই। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে সেখানে বই বের করে পড়াটা স্বাভাবিক হবে। এখন মোবাইলের বদলে বই বের করলে মানুষ এমনভাবে তাকায় মনে হয় যেন আমি এলিয়েন,' বলেন সায়মা।
ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য জেলায়ও
ভলান্টিয়ার অপরচুনিটিজকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বগুড়ায়ও নীরবে বই পড়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নারী সংগঠন 'শী লিডস'-এর উদ্যোগে আগস্ট মাসের প্রথম শুক্রবারে আয়োজন করা হয়েছে নীরবে বই পড়ার কর্মসূচি। মিথুনের বিশ্বাস একদিন সারাদেশে বই পড়ার সংস্কৃতি তৈরি হবে এবং এমন কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়বে।
ভালো অভ্যাসের তালিকায় বই পড়াকে সবসময়ই উপরে রাখতে চান মিথুন দাস। তিনি বলেন, 'কতজন অংশ নেবে বা কতজন মানুষ পড়ল, তার থেকেও বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যারা পড়তে যাচ্ছি বা আমরা যারা এই উদ্যোগটাকে নিয়ে সামনে এগোতে চাচ্ছি তা কতটা মানসম্মত হচ্ছে। বিষয়টা এমন না যে, ভারতে শুরু হয়েছে, তাই আমরাও করব।'
মুক্ত পরিবেশে বই পড়ার সংস্কৃতি যাতে ছড়িয়ে পড়ে সেটাই কামনা মিথুন দাসের। এমন একটা দেশের স্বপ্ন দেখেন মিথুন যেখানে নিজের শখ নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারবে। যে যার খুশি মতো নাচবে, গাইবে কিংবা ছবি আঁকবে — কেউ তাকে নিয়ে কোনোরকম মন্তব্য করবে না।