চীনের মূল্য সংকোচন: চীনা মিরাকলের দিন কি শেষের পথে?
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন এ বছরের জুলাই মাস থেকে মূল্য সংকোচনের মুখে পড়েছে। চীনের ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) বিগত দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ কমে এসেছে। চীনে এখন চলছে ঋণাত্মক মূল্যস্ফীতি।
পণ্যের দাম কমে আসা ক্রেতাদের জন্য সুখবর, বিশেষ করে যখন সারাবিশ্বেই মূল্যস্ফীতির জন্য মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। কিন্তু গোটা অর্থনীতির মূল্যস্তর কমে আসা কি ভালো কথা? অর্থনীতিবিদদের মতে না। বিশেষ করে অপ্রত্যাশিত মূল্য সংকোচন অত্যন্ত খারাপ লক্ষণ। আর যখন তা দেখা দেয় চীনের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশে, তখন সেটা কেবল আর অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে আটকে থাকে না, বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়।
মূল্য সংকোচন কী?
ধরুন, আপনার তৈরি পণ্যের দাম কমে যাচ্ছে। তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি আর আগের মতো বেশি পণ্য উৎপাদন করতে চাইবেন না; কারণ আপনার অল্প দামে পণ্য বিকিয়ে পোষাচ্ছে না। আপনি আপনার কারখানার শ্রমিক ছাঁটাই করবেন অথবা তাদের বেতন কমিয়ে দেবেন। ফলে বেকারত্ব বাড়বে, মানুষের হাতে অর্থ কমে যাবে। এভাবেই অর্থনীতি সংকটের পাকে পড়বে।
মূল্য সংকোচনের ফলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে যায়। ঋণের প্রকৃত মূল্য বেড়ে যায়। যেমন, আপনি যদি এক লাখ টাকা ঋণ করেন, বছরে ১০ শতাংশ মূল্য সংকোচনে সেই ঋণের আসল পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। ফলে ঋণগ্রহীতার ওপর চাপ বাড়ে, অনেক ঋণগ্রহীতা দেউলিয়া হয়ে যেতে পারেন।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, মূল্য সংকোচন একটা দুষ্টচক্র তৈরি করে। নিম্ন চাহিদার ফলে পণ্য উৎপাদন কমে যায়। এতে শ্রমিকের চাহিদা হ্রাস পায়, বেকারত্ব বাড়ে, আয় কমে। এর ফলে পণ্যের চাহিদাও আরও কমে যায়।
মূল্য সংকোচন সাধারণত আধুনিক অর্থনীতিতে দেখা যায় না। ১৯৩০-এর দশকে গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় আমেরিকাতে মূল্য সংকোচনের কারণে ২৫ শতাংশ বেকারত্ব বেড়েছিল। ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে জাপান মূল্য সংকোচনে পড়লে দেশটির প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ১ শতাংশের নিচে। এ সময়টাকে জাপানের হারানো দশক বলা হয়, যার ধাক্কা এটি এখনো সামলে উঠতে পারেনি। ২০১০-এর দশকে ইউরোজোন সংকটের সময়ও মূল্য সংকোচন দেখা যায় — গ্রিসের ঋণ সংকটের ধাক্কা গিয়ে লাগে আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি ও সাইপ্রাসে।
মূল্য সংকোচনের কারণ
চীনা অর্থনীতি কোভিড-১৯-এর আগে থেকেই মন্থর হয়ে আসছিল। কিন্তু কোভিডের পর থেকে এর গতি একেবারেই শ্লথ হয়ে আসে। দীর্ঘদিন ধরে চলা কোভিড লকডাউন দেশটির অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে; উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এর সঙ্গে যোগ হয় চীনের সবচেয়ে বড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এভারগ্রান্ড-এর দেউলিয়া হয়ে যাওয়া। ২০২২ সাল থেকেই এটি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছিল।
ওদিকে চীন থেকে পশ্চিমাবিশ্বে রপ্তানিও কমে যায়। চীনা ইউয়ানের দাম ডলারের বিপরীতে বাড়ার কারণে চীনা পণ্যের দাম বাড়ে। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধও সাহায্য করেনি চীনকে। পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর চীন থেকে বেরিয়ে আসার ফলে বড়সড় ধাক্কা খায় এটির অর্থনীতি। এছাড়া চীনা কর্তৃপক্ষের প্রণোদনা না দেওয়াও আরেকটি কারণ।
মূল্য সংকোচনের অভ্যন্তরীণ প্রভাব
মূল্য সংকোচনের ফলে চীনা ক্রেতাদের আচরণ বদলে যেতে পারে। সাধারণত যখন ক্রেতারা মনে করেন, কোনো পণ্যের দাম ভবিষ্যতে কমবে, তখন তারা ওই পণ্য কেনা কমিয়ে দেন। মূল্য সংকোচনের এই প্রত্যাশা অর্থনীতির মূল্যস্তর কমিয়ে দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে চীনের বিনিয়োগকারীরা মনে করতে পারেন, বিনিয়োগ করলেও তা উঠে আসবে না। ফলে সার্বিক বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। প্রকৃত ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক খাতে দেউলিয়া বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
মূল্য সংকোচন পরিস্থিতে চীনা মালিকেরা তাদের কর্মীদের বেতন বাড়াবেন না, উল্টো কর্মী ছাঁটাই করতে পারেন খরচ কমানোর জন্য। এমনটা হলে দেশটির বেকারত্ব আরও বাড়বে। ২০২৩ সালের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী, চীনে তরুণদের মাঝে বেকারত্বের হার ছিল ২১ দশমিক ৩ শতাংশ।
এছাড়া কমে যেতে পারে সম্পদের মূল্যও। চীনের ব্যাংকিং খাতেও চাপ সৃষ্টি হতে পারে। ইতোমধ্যে ঋণ সংকটে রয়েছে দেশটি। সবমিলিয়ে সরকারের রাজস্ব কমারও বড় সম্ভাবনা তৈরি হবে। এতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে চীনা অর্থনীতিকে সচল করার সুযোগ কমে আসবে।
আর দীর্ঘদিন এমন অবস্থা চললে জীবনযাত্রার মান কমে যাবে। ফলে তখন দেখা দিতে পারে সামাজিক অস্থিরতা।
মূল্য সংকোচনের বৈশ্বিক প্রভাব
মূল্য সংকোচনের ফলে বিশ্ববাজারে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা অনেকটাই অনির্দিষ্ট। তবে চীনা অর্থনীতি বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রায় ৩০ শতাংশ একাই নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই দেশটির অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে এলে বিশ্ব অর্থনীতির গতিও মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
মূল্যস্তর কমে যাওয়ার পরও যদি চীনা উৎপাদনকারীরা আরও বেশি রপ্তানি করতে থাকেন, তাহলে চীনা রপ্তানি বাড়বে। ফলে চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো কম দামে পণ্য পাবে। কিন্তু মূল্যস্তর হ্রাসের ফলে লাভ কমে যাওয়ার চিন্তায় দেশটির উৎপাদনকারীরা রপ্তানি কমিয়ে দিলেও বৈশ্বিক বাণিজ্যে তার বিরুপ প্রভাব পড়বে।
মার্কিন ডলারের বিপরীতে চীনা ইউয়ানের পতনের কারণে চীনা পণ্যের রপ্তানির প্রতিযোগী-সক্ষমতা কমে যাচ্ছে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে। ফলে এসব ক্রেতারা আরও কম মূল্যে ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ড থেকে পণ্য কিনতে পারেন।
চীনের চাহিদা কমে গেলে চীনে রপ্তানি করা দেশগুলোর ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে। অস্ট্রেলিয়া, জার্মানির মতো দেশগুলোর রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এই মূল্য সংকোচন আসলে স্বল্পমেয়াদী। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে যে সংকট শুরু হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা এটা। চীনা অর্থনীতি এত বহুমুখী যে, এ অস্থায়ী সংকটে এটি তেমন অকূল পাথারে পড়বে না। তাই চীনা অর্থনীতির মিরাকল এখানেই শেষ হচ্ছে না।
তবে এ কথাও অস্বীকার করা যাবেনা — চীনের অর্থনীতির সুদিন অনেকটাই কমে আসছে, এর সোনালী দিন ক্রমশ অতীতে আশ্রয় নিচ্ছে। তাই এ মূল্য সংকোচন যদি তেমন দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সৃষ্টি নাও করে, তাও সামনের দিনগুলো চীনের জন্য আর আগের মতো গৌরবময় হবে না।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।