চীনের নতুন মানচিত্র: ভূরাজনৈতিক পাওয়ার-প্লে?
গত ২৮ আগস্ট চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয় '২০২৩ সালের চীনের আদর্শ মানচিত্র' প্রকাশ করেছে। ওই মানচিত্রে দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত নাইন-ড্যাশ লাইন এবং ভারতের সমগ্র অরুণাচল প্রদেশকে চীনের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মানচিত্রটি নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। ভারত বলছে, এ মানচিত্র বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন, 'আমরা এ ভিত্তিহীন দাবিকে প্রত্যাখান করি।' দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বলেছেন, 'চীন এর আগেও মানচিত্রে এমন সব স্থানকে অন্তর্ভুক্ত করেছে যা তাদের নয়। এটা তাদের পুরোনো স্বভাব।'
তবে চীনের দাবির বিপরীতে ভারতের প্রতিবাদকে একটু দুর্বলই বলা চলে। সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলো বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো প্রসঙ্গে প্রতিবাদের সময় আরও সরবে নিজের অবস্থান জানান দেয় দিল্লি।
এদিকে ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া বলছে এ মানচিত্র তাদের সমুদ্রসীমা ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে অস্বীকার করে। তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেফ লিউ বলেছেন, 'চীন কখনোই তাইওয়ান শাসন করেনি। চীনা সরকার যতই সত্যকে বিকৃত করতে চাক না কেন, তারা তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বকে মুছে দিতে পারবে না।'
এ অঞ্চলে চীনের সীমান্ত নিয়ে গোলযোগ আজকে নতুন নয়। তবে এবারই প্রথম এমন উস্কানিমূলক মানচিত্র প্রকাশ করল চীন, যেখানে ভারত, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চীন সাগরের বিশাল অঞ্চল নিজেদের মালিকানায় দেখাল বেইজিং। চীন মানবাধিকার, উইঘুর সংকট, বাণিজ্যযুদ্ধসহ নানা রকমের বিবাদে জড়িয়ে আছে পশ্চিমের সঙ্গে। এরই মধ্যে চীনের এ পদক্ষেপ একটু অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়।
চীনের এ ধরনের আচরণের পেছনে বেশকিছু শক্ত কারণ রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে রয়েছে তেল ও গ্যাসের মজুত। চীনের মতো জ্বালানিনির্ভর দেশের জন্য এ রিজার্ভ অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া দক্ষিণ চীন সাগর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মেরিটাইম রুট। এ রুট নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে চীনের ভূরাজনৈতিক শক্তি ও প্রাধান্য বাড়বে।
অন্যদিকে অরুণাচল প্রদেশও ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বতের দক্ষিণে এ অঞ্চলে রয়েছে সুপেয় পানির বিশাল ভাণ্ডার, যা চীনের উত্তরের শিনচিয়াং বা ছিংহাইয়ের মত শুকনো অঞ্চলে পানি সরবরাহ করতে পারবে।
চীনের এ মানচিত্র প্রকাশ করার পেছনে আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। চীন এখন চারদিক থেকে পশ্চিমা চাপে রয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব চীনকে খানিকটা চিন্তিত করেছে। এছাড়া হয়তো চীন তার মিত্র রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া বা মায়ানমারকে জানান দিতে চায় — চীন দুর্বল নয়। পুরো বিষয়টি একটি ক্ষমতার চাল হতে পারে চীনের জন্য।
শেষ আরেকটি কারণ হতে পারে, চীন তার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো থেকে নজর আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দিকে ঘোরাতে চাইছে। চীনে মুদ্রা সংকোচন চলছে, চীনা অর্থনীতির প্রধানতম স্তম্ভ ম্যানুফ্যাকচারিং খাত টানা পাঁচমাস ধরে মন্দার মুখে। দেশটির অর্থনীতি ঋণসংকটে জর্জরিত। অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি সরানোর একটি ভালো উপায় হচ্ছে বহিঃশত্রু সৃষ্টি ও জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরির চেষ্টা করা।
চীন কি কোনো ধরনের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে? সত্যিকার অর্থে, চীনের জন্য যুদ্ধ মোটেও লাভজনক হবে না। যেকোনো সামরিক সংঘাত দেশটির মন্থর অর্থনীতির ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করবে। চীনের ঋণসংকট বেড়ে ক্রমশ প্রকট আকার ধারণ করেছে। একইসঙ্গে চীনা আবাসন খাতের ইকোনোমিক বাবল ফেটে যাওয়ার মুখে রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, চীন এখনো তার জ্বালানির জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়ার জ্বালানি নির্ভরশীলতা নেই, তাই যুদ্ধ শুরুর আগে এ নিয়ে মস্কোকে বেশি চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু চীনের ওই পর্যায়ের জ্বালানি সক্ষমতা নেই।
ইউক্রেনের মতো তুলনামূলক দুর্বল দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে রাশিয়া যেভাবে তার অর্থনীতি ও সেনাবাহিনীতে প্রবল ধাক্কা খেয়েছে, সেখানে চীন তাইওয়ানের মতো প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত, শক্তিশালী অর্থনীতি, শক্তিশালী সেনাবাহিনী, উন্নত সরঞ্জাম ও প্রতিরোধব্যবস্থায় সুসজ্জিত দেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে না এখনই।
আর ভারতের সঙ্গে চীনের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা একেবারেই কম। ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকা দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষে হাতাহাতি লড়াই হয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার সেভাবে হয়নি। কারণ হিমালয় পর্বতের এ দুর্গম অঞ্চলে যুদ্ধ করা লজিস্টিক দিক থেকে অত্যন্ত কঠিন। এখানে যুদ্ধ করতে সেনাবাহিনীকে রসদ সরবরাহ করতে হবে কার্গো বিমান আর মিলিটারি হেলিকপ্টার দিয়ে। চীন ও ভারত দুই দেশেরই এ সক্ষমতা এখনো সীমাবদ্ধ। কাজেই অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তে বাহাস হাতাহাতি আর বাকযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তবে চীনের আগ্রাসি নীতির সামনে ভারতকে বেশ নমনীয় ঠেকছে।
চীনা নৌবাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরে রীতিমত রাজত্ব করে বেড়ায়। সেখানে এটিকে থামানোর সক্ষমতা কারও নেই — ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম সব দেশের সম্মিলিত নৌবাহিনীও চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। যেখানে চীনের আধিপত্য বিনাযুদ্ধেই নিশ্চিত, সেখানে যুদ্ধ করবে কেন?
এছাড়া যুদ্ধ চীনের কৌশলগত লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে না। চীনের লক্ষ্য কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে তার পড়শিদের নতজানু রাখা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।