রসায়নবিদের রাজনীতি: অখণ্ড বইয়ের খণ্ডিত পাঠপ্রতিক্রিয়া
মহাজগতের কথা ও একটি জীবনস্মৃতি, শিরোনামের বই। বইটির তিনটি পর্ব। প্রথম পর্বে ছয়টি প্রবন্ধ, দ্বিতীয় পর্বে দুটি ছোটগল্প এবং তৃতীয় পর্বে আত্মকথা। বইটির লেখক রসায়নবিদ বজলুল করিম আকন্দ সম্ভবত রসের ভাণ্ডার বলেই একই বইয়ে নানান স্বাদ উপভোগের এমন সুযোগ দিতেন না। সেজন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই।
লেখক বজলুল করিম আকন্দ নানারকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকলেও কিছুটা অন্তর্মুখী মানুষ বলে মনে হয়। আমাদের গ্রামের বাড়ি একই উপজেলার পাশাপাশি ইউনিয়নে এবং বসবাসও করছি ঢাকায়, কিন্তু এই বই পড়ার আগে তাঁর গ্রামের বাড়ি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তবে তাঁকে পেয়েছি আরও দুজনের লেখায়। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের 'লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি' বইতে বজলুল করিম আকন্দ নামে একজনের সাক্ষাৎকার আছে। যার অফিস কক্ষে ১৯৭৪ সালে সিরাজ সিকদার গোপন সভা করেছিলেন এবং এই সূত্রেই তাঁর সাক্ষাৎকার সন্নিবেশিত করেছেন মহিউদ্দিন আহমদ।
আরেকজনের লেখাতেও বজলুল করিম আকন্দকে পেয়েছি, রইসউদ্দিন আরিফের 'আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন' ও 'প্রবাহিত জীবনের গল্প' নামক স্মৃতিতর্পণে। আনন্দমোহন কলেজে রইসউদ্দিন আরিফের ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত হবার মূল কারিগর ছিলেন বজলুল করিম আকন্দ, এটি দুজনেই স্বীকার করেছেন আলাদা আলাদা লেখা ও সাক্ষাৎকারে। এখানে রইসউদ্দিন আরিফের সম্যক পরিচয় প্রদান করা সমীচীন। রইসউদ্দিন তালুকদারও ময়মনসিংহের মানুষ, আনন্দমোহন কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। পাকিস্তান আমলেই থানা শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মজগতে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখেছেন নতুন সমাজ গড়ার, নতুন বাংলাদেশ বানানোর; তিনি তো আর গতানুগতিক চাকুরিতে থিতু হতে পারেন না। রইসউদ্দিনও পারেননি। যোগ দেন সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টিতে। পরবর্তীতে নাম বদলে হন রইসউদ্দিন আরিফ। সিরাজ সিকদারের পরে তিনিও সর্বহারা পার্টির একাংশের শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হয়েছিলেন।
এবার আসল আলাপে যাই। বিভিন্নজনের বইতে পাওয়া বজলুল করিম আকন্দ ও আমার আলোচ্য বইয়ের লেখক যে একই ব্যক্তি, তা এই বই পাঠেই প্রথম জানা হলো। অথচ বইয়ের পাতায় নয়, বরং একই এলাকার মানুষ হিসেবে জীবনের পাতাতেই আরও আগে জানাশোনা থাকা স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। হয়ত আমারই সীমাবদ্ধতা! সকলেরই একটি নিজস্ব গণ্ডি থাকে, গণ্ডির মধ্যে আলাদা গুরুত্ব থাকে। পরিবার ও সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ প্রত্যেকেরই নিজস্ব বিচরণক্ষেত্র থাকে। বজলুল করিম আকন্দ বা অন্য কেউ-ই এর বাইরে নন। তাঁর আত্মকথন পড়ে অনেকগুলো পরিচয়ে তাঁকে জানা হয়েছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক মানুষ, সংবেদনশীল ও বিজ্ঞানমনস্কতা তাঁকে আলাদা করেছে। পাশের বাড়ির একজনকে জানার এই যে অপার সুযোগ, এটি দিয়েছে প্রিয় বই, প্রিয়তম আত্মজীবনী। অতঃপর এই বই-বন্ধনের ভূমিকা পর্ব শেষে বন্দনায় প্রবেশ করছি।
২.
শেষের কথা আগে, অর্থাৎ তৃতীয় পর্ব 'একটি জীবনস্মৃতি' দিয়ে আলোচনা শুরু করি। প্রত্যেক মানুষেরই একাধিক পরিচয় থাকে- সন্তান, স্বামী, পিতা, দাদা-নানা, চাচা-মামা, ফুপা-খালু ইত্যাদি। এসবের বাইরে বৃহত্তর সমাজে নানানভাবে কর্মময় পরিচিতি অর্জন করে। বজলুল করিম আকন্দও ব্যতিক্রম নন। কেউ হয়ত ষাটের দশকে আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে চেনেন-জানেন। শিশুবেলায় মাতুলালয়ের মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবেও তাঁর বন্ধুরা মনে রাখতে পারেন। বড়গাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রকালের বন্ধুরা জানেন একভাবে, একাধিক উচ্চ বিদ্যালয়ের বন্ধু-পরিচিতজনেরা জানেন আরেকভাবে। বিসিএসআইআর (বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ)-এর সহকর্মীরা জানেন রসায়নবিদ হিসেবে, ধানমন্ডি লেকের হাঁটাবাহিনি জানেন অবসরভোগী সফিস্ট হিসেবে। আর তাঁর বই 'মহাজগতের কথা ও একটি জীবনস্মৃতি' এর পাঠকেরা জানেন মননশীল লেখক হিসেবে।
ময়মনসিংহ অঞ্চল শিক্ষা ও সংস্কৃতির উর্বর ভূমি। আর্ট মানে শিল্পের সমঝদার হলেও কলকারখানার শিল্প, অর্থাৎ বাণিজ্যের উদ্যোক্তা হবার প্রবণতা খুবই কম। সাহিত্যের নানান শাখায় অনেকেই খ্যাতি অর্জন করেছেন। রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রেও প্রভাব নেহায়েত কম নয়। কিন্তু আত্মজীবনী লেখাতেই যেন সকল অনীহা ও কৃপণতা। অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথাকে এতোটা গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন কি? অথবা অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভাষায় 'কোন বাঙালি আজ পর্যন্ত আত্মজীবনী লেখেনি, কেননা আত্মজীবনী লেখার জন্যে দরকার সততা। বাঙালির আত্মজীবনী হচ্ছে শয়তানের লেখা ফেরেশতার আত্মজীবনী।'
এরপরেও আত্মজীবনীর গুরুত্ব অপরিসীম, একথা অনস্বীকার্য। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে আত্মজীবনী জাতীয় লেখালেখি করেছেন খুব কম মানুষ। সেই স্বল্পসংখ্যক নামের সাথে যুক্ত হলেন বজলুল করিম আকন্দ। তাঁর পিতা এম এ গণি আকন্দও আত্মজীবনী লিখেছেন, পিতা-পুত্রের আত্মজীবনী লেখার সংখ্যা আরও কম; এই অত্যল্পের মধ্যেও তাঁরা স্থান করে নিয়েছেন। তাঁদের অভিবাদন!
প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, একসময় বলা হতো বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধ্যে ধানীখোলা ইউনিয়ন সবচেয়ে অগ্রসর জনপদ। আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কালাম শামসুদ্দীনের মতো কৃতবিদ্য ব্যক্তিত্বদের জন্মস্থান ও পূর্বপুরুষের ভিটা ধানীখোলায়। সাহিত্যিক ও শিক্ষক গোলাম সামদানী কোরায়শী'র আত্মজীবনী 'সিন্ধুর এক বিন্দু' পড়ে জেনেছি পঞ্চাশের দশকে তিনিও কিছুদিন ধানীখোলার একটি মসজিদে ইমামতি ও একটি হাই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছিলেন। 'একটি জীবনস্মৃতি' পড়ে জানা হলো বজলুল করিম আকন্দও চল্লিশের দশকে, তাঁর শিশুকালে বৎসরাধিককাল ধানীখোলার পলাশতলীতে অবস্থিত মাতুলালয়ে, ঐতিহ্যবাহী তরফদার পরিবারে প্রতিপালিত ও একটি মাদ্রাসায় শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন।
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা ধানীখোলার কিংবদন্তি এখানেই শেষ নয়! ব্রিটিশ আমল থেকে এখন অব্দি এক ধানীখোলা ইউনিয়ন থেকেই পাঁচজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং একজন নিখিল পাকিস্তানের মন্ত্রী হয়েছিলেন। সাংবাদিকতা, সাহিত্য, রাজনীতিসহ সকল অঙ্গনে ধানীখোলার ধন্যপুরুষদের(স্ত্রী/পুরুষ উভয় অর্থে) সরব উপস্থিতি বিরাজমান। জনান্তিকে বলে রাখি, ময়মনসিংহ জেলার যে সাতজনের লেখা আত্মজীবনীর সন্ধান পেয়েছি, এরমধ্যে আলোচ্য বইটির লেখকসহ চারজনের বাড়ি বর্তমান ত্রিশাল উপজেলায়। উল্লেখ্য, আলোচ্য বইয়ের লেখকের ইউনিয়ন ১২নং আমিরাবাড়ী একদা ফুলবাড়ীয়া উপজেলাধীন (পূর্বতন থানা) ছিল। জন্ম-উপজেলা হেতু ত্রিশালের প্রতি একটু পক্ষপাত প্রকাশ করতেই পারি!
৩.
বন্দনা-গীত সমাপনান্তে এবার মূল অংশের আলোচনায় যেতে পারি। লেখক বজলুল করিম আকন্দের পিতা ছিলেন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। লেখক জানিয়েছেন, তাঁর পিতা এম এ গণি আকন্দ চাকুরি থেকেই অবসর নিয়েছিলেন ১৯৬৫ সালে। অনুমান করি, দশ সন্তানের পিতা গণি সাহেব বিশের দশকে চাকুরিতে যোগ দিয়ে থাকবেন। এতেই প্রতীয়মান হয় যে, একটি পশ্চাৎপদ জনপদের অগ্রসর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন বজলুল করিম আকন্দ।
এখানে বাঙালি মুসলমানের অগ্রযাত্রার প্রসঙ্গ চলে আসে। বাঙালি মুসলমানের অগ্রসর পরিবারগুলোর প্রথম প্রজন্ম ছোটখাটো কেরানি বা সিপাহির চাকরি, স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক, এমনকি গোবরে পদ্মফুল হয়ে জন্মানো কঠোর পরিশ্রম করা ও জায়গীর থেকে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া অগ্রপুরুষের সংখ্যাও কম নয়।
লেখক জানিয়েছেন, আমার দাদা আলিম উদ্দিন আহম্মদ পল্লীচিকিৎসক ছিলেন। একসময় এলাকাটি খুব অবহেলিত ছিল। কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয়, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ইত্যাদি রোগবালাই লেগেও থাকত। তিনি (দাদা) অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা দিতেন। পল্লীবাসীর সেবার উদ্দেশ্যেই তিনি কলিকাতা থেকে ডাকযোগে মডার্ন প্র্যাকটিশনার নামে পাঁচখণ্ড ডাক্তারি বই সংগ্রহ করে এলাকায় প্র্যাকটিস শুরু করেন। নিজ গ্রামে তিনি একটি সরকারি কালাজ্বর সেন্টারও পরিচালনা করতেন এবং সেখানে ডাক্তার ব্রহ্মচারী আবিষ্কৃত ব্রহ্মচারী ইনজেকশন দিয়ে কালাজ্বরের চিকিৎসা দিতেন। এতে এলাকায় কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব অনেকটা হ্রাস পায়। এতেই প্রতীয়মান হয় লেখকের পূর্বপুরুষ প্রাণ ও প্রকৃতির কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ সংযুক্তি হলো- ময়মনসিংহের ত্রিশাল, গফরগাঁওসহ কিছু এলাকায় কালাজ্বর এখনও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে, শতবর্ষের প্রচেষ্টায় এখনও পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব হয়নি। লেখকের মাতামহের পরিবারও সমাজসেবায় নিবেদিত বলে ত্রিশালবাসী ওয়াকিবহাল। এম এ গণি আকন্দের আত্মজীবনী 'স্মৃতি সতত বিরাজে' এখনও সংগ্রহ করতে পারিনি, নইলে বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত (Privileged) পরিবারটির অগ্রযাত্রা সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য যুক্ত করা সম্ভব হতো।
সেকালের উঠতি মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই এম এ গণির পরিবারের একটি অংশ গ্রামের বাড়িতে, একাংশ পড়ালেখার জন্য গফরগাঁও বা ময়মনসিংহে এবং সংসারকর্তা নিজে কর্মস্থলে অবস্থানের কথা জানিয়েছেন পুত্র বজলুল করিম আকন্দ। লেখকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের অনেকটা সময় কেটেছে বড়গাঁও নামক গ্রামে। এখানেই দুটি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এই গ্রামটি ত্রিশাল (তৎকালীন ফুলবাড়ীয়া), ভালুকা ও গফরগাঁও উপজেলার ত্রিমোহনায় অবস্থিত— যা লেখকের ভাষায়, 'এটি ত্রিশাল থানার অন্তর্ভুক্ত হলেও মূলত গফরগাঁও, ভালুকা ও ত্রিশালের সংযোগস্থলে ক্ষিরু নদীর তীরে অবস্থিত। এই নদীর তীরেই আমাদের বাড়ি'। এখান থেকে গফরগাঁও-এর যোগাযোগ ও যাতায়াত সহজ ছিল। এখনও ত্রিশালের চেয়ে ভালুকা উপজেলা সদরের সাথে যাতায়াত সহজ। এমন একটি নিভৃত পল্লীগ্রামের সন্তান বজলুল করিম আকন্দ।
তিনি চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের গ্রামের যে চিত্রকল্প এঁকেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে পরিবেশের উল্লেখ করেছেন, চারপাশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে দৃশ্যকল্পের উল্লেখ করেছেন, তা যেন আমিও চাক্ষুষ করতে পারছি। লেখক জানিয়েছেন, মঞ্চনাটক, যাত্রা, ঘেটু (ঘাডু) গান, মেলা, মাঠে ফুটবল, দাড়িয়াবান্দা, ভলিবল, হাডুডু ইত্যাদি খেলা, বরশি-জালি-বানা-বাইর নানান প্রক্রিয়ায় মাছ ধরা, হাঁস-মুরগি-কবুতর-গারু-ছাগল ইত্যাদি লালন-পালনে যুক্ত থাকা, এসবই ছিল শৈশবের নিত্যকর্ম। স্কুলড্রেস ও স্কুলব্যাগের প্রশ্নই আসে না, যেকোনো পোশাকে নগ্নপদে স্কুলে যাওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক রেওয়াজ। প্রতিবছর পুরানো বই কেনার কথাও বলতে ভোলেননি। গ্রন্থকারের প্রায় চল্লিশ বছর পরে, একই জনপদে আমার অভিজ্ঞতাও কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় একই। ব্যতিক্রমটা এই যে, স্কুল লাইব্রেরির অতীত জৌলুশের কথা শুনেছি কিন্তু প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি! এতে অনুমিত হয় যে, এই ভূখণ্ডের অগ্রযাত্রা অত্যন্ত শ্লথগতি সম্পন্ন।
বড়গাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতি উল্লেখ করেছেন, 'এ সময় ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। এতে ঢাকায় সালাম, বরকত ও জব্বারসহ অনেকে শহিদ হন। সে সময় আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের রক্ত চাই, নাজিমুদ্দিনের কল্লা চাই, ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে শান্তিগঞ্জ ও ধীতপুর বাজার পর্যন্ত চলে যেতাম।' যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ, তাৎক্ষণিক খবর পৌঁছানোর সুযোগ নেই, তবুও জাতিসত্ত্বার আন্দোলন অজপাড়াগাঁ-তেও স্পর্শ করেছিল, শিশুদের চেতনাকে শাণিত করে তুলেছিল। আমাদের সময়কালে নব্বইয়ের ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের সময়েও গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে মিছিল-স্লোগানের শামিল হয়ে একই চিত্র প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। সময়ের দূরত্ব চল্লিশ বছর হলেও অনুভূতিগুলো ফিরে ফিরে আসে, একই চেতনায় সিক্ত হয়ে।
৪.
বড়গাঁও প্রাইমারি স্কুল, শিবগঞ্জ বি দাস হাই স্কুল, গফরগাঁও ইসলামিয়া হাই স্কুল হয়ে অবশেষে পিতার কর্মস্থল বাজিতপুর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ১৯৬১ সালে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকেই আইএসসি ও বিএসসি সম্পন্ন করে চাকুরিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই কয়েকটি বছরের গল্প একেবারে ছোট নয়, কিংবা নয় অপ্রয়োজনীয়। কলেজে পড়াকালেই ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন এবং একপর্যায়ে কলেজ শাখা ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি লিখেছেন, 'এ সময় ছাত্র রাজনীতি সক্রিয় ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই এনএসএফ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মতো সংগঠনগুলো এখানে সক্রিয় হতে শুরু করে। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপসু)-এর সাথে বন্ধু আতিক ও বাচ্চু জড়িয়ে পড়ে। ময়মনসিংহ জেলায় ইপসু খুব সংগঠিত ছিল না। তাই এখানে ইপসুকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আবদুর রশিদ ও আলমগীর খালেদ ঢাকা থেকে এসে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়। আমাদের বন্ধু আবু সাইদও আমার সাথে ইপসুর সদস্য হয়ে যায়। ময়মনসিংহে ইপসু ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আনন্দমোহন কলেজ, মুমিনুন্নেসা কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা কমিটি গঠিত হয়। আমাকে আনন্দমোহন কলেজ শাখার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন ছাত্রলীগ থেকে সেখানে মাসুদ পারভেজ ও এনএসএফ থেকে রাজিউদ্দিব আহমেদ বাচ্চু সভাপতি ছিল।'
এখানে উল্লেখিত নামগুলোর একটু পরিচিতি দেয়া যেতে পারে। আবদুর রশিদ পরবর্তীতে বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আবু সাইদ, কর্নেল তাহেরের সহোদর ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। মাসুদ পারভেজ, মানে চিত্রনায়ক সোহেল রানা।
ছাত্ররাজনীতি করে এনএসএফ-এর গুণ্ডাদের হাতে হয়রানির পাশাপাশি মামলায় কারাভোগও করেছেন বজলুল করিম আকন্দ। তিনি জানিয়েছেন, 'সে সময় ময়মনসিংহে এনএসএফের খুব দাপট। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন ময়মনসিংহের মোনায়েম খান। তাঁর পেটোয়া বাহিনী ছিল ভয়ংকর। যে কাউকে যে-কোনো জায়গায় তারা পেটাতে দ্বিধা করত না। ওদের দাপটে অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ভয়ে তটস্থ থাকত। ওরা কথায় কথায় ছুরি ও কিরিচ মেরে দিত, হকিস্টিক ছিল তাদের হাতের লাঠি। এ সময় আনন্দমোহন কলেজের সুদর্শন ছাত্র আশরাফ (যুবরাজ) এনএসএফের দেলুয়ায়ের ছুরির আঘাতে আহত হয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায়। আরেক ঘটনায় একদিন সন্ধ্যার দিকে বিদ্যালয়ী গার্লস হাইস্কুলের পাশের গলিতে সুখেন্দু নামের এক হিন্দু যুবক বাচ্চুর ধারালো কিরিচের আঘাতে নিহত হয়। অপরাধীরা সরকারি দলের হওয়াতে সেদিন কারও বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি।'
এরকম আরও কিছু ঘটনা এবং ছাত্র ইউনিয়নের প্রোগ্রাম ভণ্ডুল করার কথাও জানিয়েছেন লেখক। ষাটের দশকে আইয়ুব-মোনায়েম খানের এনএসএফ সারা বাংলায় এক তাণ্ডব-পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরে তাদের ব্যাপক উপস্থিতির প্রমাণ অনেকের লেখায় পাওয়ায় যায়। কিন্তু ময়মনসিংহের মতো তৎকালীন মফস্বল শহরে তাদের উপস্থিতির প্রমাণ তেমন কারও লেখায় পাইনি। ষাটের দশকে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ছিলেন পি এ নাজির (পিয়ার আলি নাজির) ও মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, এই দুজন সিএসপি আমলার আত্মজবানী 'স্মৃতির পাতা থেকে' ও 'প্রশাসনে নিবেদিত এক কর্মকর্তার আত্মস্মৃতি' বই দুটিতে বরং মোনেম খান ও এনএসএফ-এর ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছি। ষাটের দশকে কিছুদিন আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, তাঁর 'নাই বা হলো পারে যাওয়া' আত্মজবানীতেও প্রায় অনুরূপ বয়ান পেয়েছি।
পক্ষান্তরে, তৎকালীন একাধিক ছাত্র ও ছাত্রনেতার মৌখিক বয়ানে পেয়েছি আনন্দমোহন কলেজ ও শহরে এনএসএফ-এর তাণ্ডবের কথা। এর সত্যতা ইতোপূর্বে পেয়েছিলাম রইসউদ্দিন আরিফের আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন বইতে, এখন পেলাম রইসউদ্দিন আরিফের বন্ধু বজলুল করিম আকন্দের লেখায়। দুজনের প্রায় একই অভিজ্ঞতা হলেও বজলুল করিম আকন্দ শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই নন, এনএসএফের গুণ্ডাদের হয়রানির শিকার হয়ে কারাভোগও করেছিলেন। এখানেই আদালত ও রাজনীতির প্রসঙ্গে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সৈয়দ আবদুস সুলতান, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ জাতীয় নেতাদের কথাও উল্লেখ করেছেন। ষাটের দশকে আনন্দমোহন কলেজের ছাত্ররাজনীতি ও ময়মনসিংহের মূলধারার রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহীদের কাছে বইটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
৫.
পারিবারিক বাস্তবতায় বিএসসি পাশ করেই লেখককে চাকুরিতে যোগ দিতে হয়েছিল। দশ ভাইবোনের মধ্যে লেখক ছিলেন ৬ষ্ঠ সন্তান। পিতা অবসরে গেছেন। এমতাবস্থায় দ্রুতই ময়মনসিংহে নতুন প্রতিষ্ঠিত কায়েদে মিল্লাত হাইস্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। স্কুলটি মূলত বিহারীদের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বেশিদিন থাকেননি, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অদম্য ইচ্ছা তাঁকে ঢাকা শহরে নিয়ে এসেছে। ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে বিসিএসআইআর-এ যোগ দেন। তবে সহসাই তাঁর এমএসসি পড়া হয়ে উঠেনি। পরে ১৯৭৭-৭৮ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত রসায়নে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু মাঝখানের সময়টুকু শুধুই চাকুরি করেননি। চাকুরির পাশাপাশি রাজনীতির সাথে যোগাযোগ রক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতে সম্পৃক্ত থাকা, পরিবারের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখা এবং শিল্প-সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চার নানান সাহিত্য-সাময়িকী প্রকাশে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে, পাকিস্তানে বেড়ে উঠেছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হয়েছেন। একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় সায়েন্স ল্যাবে ঝুঁকি নিয়ে বোমা তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বন্ধুকৃত্যের অংশ হিসেবে পরোক্ষভাবে সর্বহারা পার্টির একটি গোপন বৈঠকের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এজন্যই মহিউদ্দিন আহমদ এখানে বজলুল করিম আকন্দের সেই সংশ্লিষ্টতার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অনুধাবন করে তাঁর বইতে সাক্ষাৎকার যুক্ত করেছেন।
লেখকের শ্বশুর এবং আপন মামা আবদুস সালাম তরফদার ছিলেন ত্রিশাল উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালের সভাপতি। দল তাঁকে ১৯৭৯ সাল ও পরে আরও দুইবার মনোনয়ন দিয়েছে, ১৯৮৬ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শ্বশুরের নির্বাচন সম্পর্কে লিখেছেন, 'তিনি ছিলেন খুব সাদাসিধে প্রকৃতির লোক। নির্বাচনী ব্যয় বহন করার মতো টাকা তাঁর ছিল না। তাই প্রতিটি নির্বাচনে দল থেকে তাঁকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হতো। যেমন-প্রথমটিতে ১ লক্ষ, দ্বিতীয়টিতে ২ লক্ষ এবং তৃতীয়বার ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁকে ৩ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন।'
অনেকেই বলেন যে, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ টাকার অভাবে হেরেছিল, এটা বজলুল করিম আকন্দের প্রদত্ত তথ্য সেটা মিথ্যা প্রমাণ করে। টাকার অভাবে নয়, বরং সুকৌশলে হারানো হয়েছিল। এর একটা কারণের কথা জানিয়ে গ্রন্থকার লিখেছেন, 'এ নির্বাচনে তাঁরই (শ্বশুর) বিজয়ী হওয়ার কথা, কিন্তু হলো উল্টোটা। মাত্র ৫১১ ভোটে হেরে গেলেন। কারণ, জাহাজ মার্কা পেয়েছিলেন একজন প্রার্থী। আর জাহাজ ছিল ব্যালট পেপারের একদম শুরুতে। এতে অনেক ভোটার নৌকা ভেবে জাহাজে ভোট দিয়েছিলেন।' শুধু লেখক নয়, আমার নিজের দেখা অভিজ্ঞতাও ভিন্ন নয়।
বিসিএসআইআর-এর ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বজলুল করিম আকন্দ অবসর সম্পর্কে লিখেছেন, '২০০৩ সালের ১ ডিসেম্বর আমি অবসরে যাই। অথচ আমার কোনো প্রস্তুতি নেই। কোথায় যাবো, কী করবো কিছুই ঠিক করা হয়নি।'
লেখা থেকেই জানা যায়, ধানমন্ডি লেকে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করেন এবং এখানেই অনেক অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকদের সাথে মোলাকাত হয়। সুরসম্ভার নামক একটি আড্ডা-চক্রের সাথেও সাংগঠনিকভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন। মৃদঙ্গ নামক একটি সঙ্গীত বিষয়ক সংগঠন, বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ, বিজ্ঞাননেত্র ইত্যাদি ছাড়াও বিসিএসআইআর অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এরই মধ্যে গণফোরামের সাথে জড়িয়েছেন। ধানমন্ডি থানা শাখা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন। এ সম্পর্কে লিখেছেন, 'ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) গ্রুপে ছিলাম। আমার নেত্রী আওয়ামী লীগে আছেন। আমার আওয়ামী লীগেই থাকার কথা, অথচ আমি এখন গণফোরামে।'
আমরাও জানি তাঁর পুরো পরিবার একটি আওয়ামী পরিবার হিসেবে এলাকায় পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর পরিবার স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনিই জানিয়েছেন, 'আমার মেজ ভাই অ্যাডভোকেট রুহুল আমিন ছিলেন ময়মনসিংহ বারের উকিল ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক। সে-সময় ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া। পরে ওকালতি ছেড়ে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেন। অবসরের পূর্বে তিনি সরকারের যুগ্মসচিব হয়েছিলেন।'
ইপিসিএস তালিকা সাক্ষ্য দিচ্ছে ১৯৬৮ সালে মো. রুহুল আমিন পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। আমার জানামতে, ত্রিশাল উপজেলায় তিনিই একমাত্র ইপিসিএস কর্মকর্তা। সিএসপি কেউ ছিলেন না।
৬.
১৮০ পৃষ্ঠার বইটির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে আছে বিজ্ঞান বিষয়ক ছয়টি প্রবন্ধ ও দুটি ছোটগল্প। ছোটগল্প দুটি পড়িনি, তাই মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। প্রবন্ধগুলোতে লেখকের বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আগ্রহ ও মনীষার ছাপ স্পষ্ট। যারা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ অবগত, তাদের কাছে হয়ত প্রবন্ধগুলো নতুন মাত্রা যোগ করবে না। কিন্তু সাধারণ পাঠকের কাছে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে অবশ্যই কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বিশদ আলোচনায় না গিয়ে শুধু প্রবন্ধের শিরোনামগুলো যুক্ত করছি। যথা— রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন, হকিং বিকিরণ ও একটি চিঠি, আলবার্ট আইনস্টাইন ও মহাবিশ্ব, সৃষ্টি-রহস্যের খোঁজে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, স্টিফেন হকিংঃ এ কালের কিংবদন্তি, মহাবিশ্ব ও এর সম্ভাব্য পরিণতি। শুধু প্রাবন্ধিক নয়, আমাদের কাছেও আনন্দের বিষয় হলো স্টিফেন হকং-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর সাথে বজলুল করিম আকন্দের পত্রালাপ হয়েছে, যার উল্লেখ আছে সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে। পাঠক প্রবন্ধগুলো পাঠে আনন্দ পাবেন বলে বিশ্বাস করি।
শেষকথা
প্রবন্ধ ও আত্মকথা, উভয় ক্ষেত্রেই লেখকের বিজ্ঞানমনস্কতা ও রসবোধের প্রাঞ্জল উপস্থিতি পাওয়া যায়। একজন রসায়নবিদের যথার্থই রসিক রচনা, যা বইটিতে আলাদা মাত্রা যুক্ত করেছে। বইটির মাত্র অর্ধেক অংশে লেখকের আত্মকথা স্থান পেয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, গ্রাম ও চাকুরিস্থল উভয় স্থানেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর জানিয়েছেন লেখক। এরপরেও যে ঘাটতিটুকু পাঠকের কাছে খচখচ করবে তা হলো- পরিবার, গ্রাম ও চাকুরিস্থল সম্পর্কে আরও বিশদে লিখতে পারতেন। বিশেষ করে, বিসিএসআইআর সম্পর্কে সর্বসাধারণের জানার পরিধি খুবই কম। লেখকের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল সম্পর্কে বরং তিনি খুবই কম লিখেছেন, আরও বিশদে লিখতে পারতেন বলে মনে করি। বিসিএসআইআর যার হাত ধরে জন্ম ও বিকাশ লাভ করেছে, বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদার লেখা 'স্মৃতিপটের আলেখ্য' বইটি ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত আর কারও স্মৃতিচারণমূলক লেখা পড়ার সুযোগ হয়নি। এরমধ্যে কিছুটা জানালেন রসায়নবিদ বজলুল করিম আকন্দ।
বইটির প্রকাশক লেখকের স্ত্রী মেহের নিগার পারভীন এবং প্রাপ্তিস্থান হিসেবে রকমারীর কথা উল্লেখ আছে। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার স্মৃতিকথা নিয়ে এত বড় পাঠপ্রতিক্রিয়া কেন? আমার কাছে এর একটি মাত্র উত্তর আছে, গ্রন্থকারের মতো আমিও ত্রিশালের জল-কাদায় শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে বয়স বাড়িয়েছি, মাটির টান তো থাকবেই...
লেখক: অনুসন্ধিৎসু পাঠক ও রাজনৈতিক কর্মী
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।)