বিপ্লবের স্মৃতি বিজরিত দেয়ালগুলো কেন আমরা পুনরায় রঙ করছি?
আমি কিছুদিন আগে একটি ফেসবুক পোস্ট দেখে চমকে যাই। সেখানে ঢাকার দেয়ালে রঙ করার জন্য তহবিলের আহ্বান করা হয়েছে। মূলত শিল্পীদের একটি গ্রুপ উদ্যোগটি নিয়েছিল। যারা কি-না দেয়ালে লেখা অমার্জিত সব স্লোগান মুছে সেখানে অবিলম্বে গ্রাফিতি আঁকতে চেয়েছিলেন। যাতে করে দেয়ালে ঐ লেখালেখির জায়গায় আরও 'সুন্দর' ও 'অর্থপূর্ণ' কিছু জায়গা পায়। তারা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নানা শিল্প সেখানে ফুটিয়ে তুলতে চায়। যা কি-না ঐ সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ করা ক্ষোভ ও অবজ্ঞা প্রতিস্থাপন করবে।
কিন্তু আহ্বানটি পড়ার সময় আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগে। সেটা হচ্ছে, কেন আমাদের বিপ্লবের দেয়ালগুলিকে আবার রঙ করতে হবে?
ঢাকার দেয়াল আমাদের জাতির ক্ষোভের গল্প বলছে। এগুলো প্রতিবাদী লোকদের স্মৃতি বহন করছে। যারা কি-না হতাশার মুহূর্তে সোচ্চার হয়েছিল এবং মাঠে নেমেছিল। তাই এগুলি শুধু লেখাই নয়, বরং প্রতিরোধের ভাষা। এগুলো মানুষের ভেতর থেকে আসা কণ্ঠস্বর; যা অন্যরাও শুনতে চেয়েছেন। দেয়ালগুলো সংগ্রাম, আবেগ, ক্রোধ ও পরিবর্তনের জন্য লড়াই করা মানুষের হতাশাকে ফুটিয়ে তোলে।
সকল বিপ্লবে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেয়ালে যে শব্দগুলো 'অশ্লীল' কিংবা 'অমার্জিত' বলে মনে হতে পারে তা বরং একটি জাতির ক্রোধ প্রকাশ করে। এই একটি গভীর অনুভূতিকে ফুটিয়ে তোলে যা একেবারেই নিজস্ব। এগুলো এমন মানুষদের কণ্ঠস্বর ফুটিয়ে তোলে যারা আর সত্য বলতে ভয় পায়নি, তা যতই কঠোর হোক না কেন।
দেয়ালে থাকা শব্দগুচ্ছগুলো শুধু শব্দ নয়; সেগুলো একটি সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশের মূর্ত প্রতীক। এটি এমন একটি আন্দোলন যা মুছে ফেলা উচিত নয়।
সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পর দেয়ালগুলো হয়ে উঠেছে ক্ষোভ, বেদনা ও বিচারের দাবি প্রকাশের ক্যানভাস। স্লোগান, অমার্জিত বাক্য ও দ্রুত আঁকা ছবি যেন এই বিপ্লবের স্পন্দন। অমার্জিত ভাষা কিংবা তাৎক্ষণিক আঁকা গ্রাফিতি সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। যদিও সেগুলো মার্জিত, রাজনৈতিকভাবে সঠিক বা নান্দনিকভাবে খুব একটা আনন্দদায়ক নাও হতে পারে, তবে তারা মানুষের আবেগের সবচেয়ে বিশুদ্ধ অভিব্যক্তি।
একেবারে মার্জিত আচরণ থেকে বিপ্লবের জন্ম হয় না। বরং গভীর হতাশা থেকেই তা উদ্ভূত হয়। যাদের দীর্ঘকাল ধরে নীরব থাকতে হয়েছিল তাদের দুঃখ সেখানে প্রকাশ পায়।
তাই বিপ্লবের দেয়াললিখন খুব বেশি পরিশুদ্ধ হবে এমনটা ভাবা উচিত নয়। বরং সেগুলো অনুভবের বিষয়। এখানেই বাংলা ভাষার শক্তি নিহিত। এটি সমৃদ্ধ ও অকৃত্রিম হওয়ায় আবেগের গভীরতা বহন করে; যা অন্য ভাষা একইভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঢাকার দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা স্লোগান। যেমন, 'লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না!', 'লাঠি গুলি টিয়ারগ্যাস, জবাব দিবে বাংলাদেশ' ইত্যাদি।
বেশিরভাগ স্লোগানই মার্জিত কিংবা নান্দনিক হওয়ার জন্য তৈরি করা হয় না। বরং সেগুলো প্রতিরোধের স্পৃহা, হতাশা ও ক্রোধ থেকে জন্ম নেয়।
বিপ্লব সাধারণত অগোছালো, বিশৃঙ্খল ও অনেক ক্ষেত্রে সহিংস হয়ে থাকে। এগুলো খুব বেশি পরিমার্জিত হয় না এবং এমনটা হওয়ার কথাও না। ঢাকার দেয়ালগুলোতে আঁকা তাৎক্ষণিক গ্রাফিতি ও স্লোগান এই আন্দোলনের রক্ত, ঘাম ও অশ্রুর স্মারক।
তাহলে কেন আমরা দেওয়ালগুলো পুনরায় রং করার প্রয়োজন বোধ করছি? কেন রাগ ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি মুছে ফেলতে হবে?
সম্ভবত এটি বিশ্বের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি আরও 'গ্রহণযোগ্য' রুপে উপস্থাপনের একটি প্রয়াস। কিন্তু তা করতে গিয়ে এই বিপ্লবের অর্থ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
গ্রাফিতি ও স্লোগান যতোটা তীব্র ভাষার হোক না কেন এটি আমাদের ইতিহাসের অংশ। এগুলো বিপ্লবের ভাষা। তাই এগুলো সংরক্ষণ করা উচিত।
সারা বিশ্বের বিপ্লবের দিকে তাকান। বার্লিনের দেয়াল এখনও বিভক্ত শহরের বেষ্টনী হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
কায়রোতে তাহরির স্কয়ারের গ্রাফিতি স্বাধীনতার জন্য মানুষের লড়াইয়ের স্মারক হিসাবে রয়ে গেছে। আমরা মিশরে এমন প্রতিক্রিয়া দেখেছি কেননা সেখানে এক বছর পরে বিপ্লবী দেয়ালগুলো মুছে ফেলা হয়েছিল।
এগুলি কেবল ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়। এগুলি বিপ্লবের জীবন্ত অংশ। এদিকে এখনও আমরা ভাবছি যে, আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের উপর রঙ করবো কি-না!
এক্ষেত্রে আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে যে, আমরা কী মুছে ফেলতে চাইছি? কঠিন সব শব্দ? আমাদের অস্বস্তি? এমন সত্য যা আমাদের জন্য সুখকর ছিল না?
বর্তমানে ঢাকার দেয়াল শুধু কংক্রিট কিংবা রঙের চেয়েও বেশি কিছু। এগুলো এমন একটি প্রজন্মের কণ্ঠস্বর যারা কি-না নীরব থাকতে অস্বীকার করেছে। এগুলো এমন লোকদের স্মৃতি বহন করে যারা ভুক্তভোগী এবং এখন কথা বলার শক্তি খুঁজে পেয়েছে। সেই কণ্ঠস্বরগুলো সবচেয়ে অকৃত্রিমভাবে সকলের সামনে উঠে এসেছে।
শেষ পর্যন্ত বিপ্লবকে রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তনের বাইরেও চিন্তা করতে হবে। এটি কণ্ঠহীনদের কণ্ঠস্বর প্রদান করে, নিপীড়ন দূর করে এবং একটি নতুন ভবিষ্যত নির্মাণ করে।
স্লোগান আর গ্রাফিতিতে ঢাকা দেয়ালগুলো সেই ভবিষ্যতেরই অংশ। এগুলো এমন এক ধারণা বহন করে যে, পরিবর্তনের পথ বেশ বন্ধুর। এক্ষেত্রে রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে তা অর্জন করতে হয়।
বিপ্লবের দেয়ালগুলিতে পুনরায় রঙ করা কেবল সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ নয়। বরং এটি একটি মুছে ফেলার প্রচেষ্টা। এটি কঠিন বাস্তবতা থেকে নিজেদের সরিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা, কষ্টকে সহজে মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা ও ইতিহাসের এমন একটি সংস্করণ উপস্থাপন করা যা সহজে ভুলে যাওয়া যায় এমন। কিন্তু বিপ্লব তো সহজে অর্জিত হয়নি। বরং সেগুলো ছিল বিশৃঙ্খল, বেদনাদায়ক ও বাস্তব অনুভূতি।
তাহলে আমাদের বিপ্লবের দেয়ালগুলোকে নতুন করে রং করার দরকার কেন? সম্ভবত আমাদের এমনটা করার দরকার নেই। এগুলোকে ঠিক সেভাবেই রাখা উচিত যেমনটা আছে। যা কি-না ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, অকৃত্রিম ও জনগণের কণ্ঠস্বরের সরাসরি অভিব্যক্তি ও প্রতিরোধের স্মারক। এক্ষেত্রে দেয়ালগুলো এতদিন ধরে সহ্য করে আসা মানুষদের সত্যই তুলে ধরুক। যারা কি-না এতদিন লড়াই করেছেন এবং আগামীতেও লড়াই চালিয়ে যাবেন।