বিশ্বজিৎ থেকে আবরার: কিছুই বদলায়নি
এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরেও ছবিগুলো আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। নতুন করে ছবি না দেখেই লিখছি।
অপুষ্টিতে ভুগছে এমন একটি রোগা ছেলে মৃত্যুর হাত থেকে পার পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। রক্তে ভিজে গেছে তার শার্ট আর সস্তা গাঢ় রঙের ট্রাউজার। দৌড়ে বাঁচার জন্য এক পা ফেললেও সামনে এগোনোর পথ নেই। খুনিরা চাপাতি নিয়ে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে।
হাত তুলে সে চাপাতির কোপ থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।
ছেলেটি বিশ্বজিৎ। পেশায় দর্জি। সেদিন সে পুরান ঢাকার রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে ছিল। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্যরা তাকে জামাত-শিবিরের কর্মী ভেবে হত্যা করে।
ঘটনার বীভৎসতায় আমরা শিউরে উঠেছিলাম। হতবাক হয়ে পড়েছিলাম। আমরা ভাবতাম এমন জিনিস কেবল কঙ্গো কিংবা রুয়ান্ডায় ঘটে। কিন্তু ঘটনাস্থল ছিল বাংলাদেশ।
এরপর আবারও নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি। এবারের শিকার আবরার ফাহাদ।
মেধাবীদের ভেতরেও সেরা মেধাবীরাই বাংলাদেশের শীর্ষ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে পড়ার সুযোগ পায়। আবরার ছিল তাদেরই একজন। এমনকি তার হত্যাকারীরাও।
আবরারের মৃত্যুর প্রায় দুবছর পর হত্যাকাণ্ডে জড়িত ২০ বুয়েট শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। পাঁচজনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সময় দণ্ডপ্রাপ্ত এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যদের কোনো পার্থক্য ছিল না। তারুণ্যের উচ্ছ্বলতায় তারা মুখরিত ছিল। সামনে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। উদ্দীপনায় পরিপূর্ণ ছিল তাদের জীবন।
কিন্তু এরপর কোথাও একটা ভুল হয়। মেধাবী এই ছাত্ররাই বিপথে চলে যায়। ভুলটি ছিল তাদের ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেওয়া।
হঠাৎ করেই তারা পেয়ে যায় ক্ষমতার সুপ্ত চাবিকাঠি। ওপরে উঠার রাস্তা খুঁজে পায় তারা। ছাত্রলীগে যুক্ত হয়ে তাদের হাতে যেন ঐশ্বরিক ক্ষমতা চলে আসে। চেঙ্গিস খানের মতোই নিষ্ঠুর হয়ে উঠে এই শিক্ষার্থীরা। মধ্যযুগীয় শাসকদের মতো নির্দয় হয়ে পড়ে তাদের মন। স্বৈরাচারীর মতোই হয়ে ওঠে অসহিষ্ণু।
আর তাই আবরারকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করতে তারা একবারও দ্বিধাবোধ করে না।
তবে ২০১২ সালের ঘটনার সঙ্গে আবরার হত্যাকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে।
বিশ্বজিৎকে যখন হত্যা করা হয় তখন তাকে প্রথমে জামাত-শিবিরের কর্মী বলা হয়েছিল। পরবর্তীতে সরকার বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে।
কিন্তু এরপর গণমাধ্যমই বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের পরিচয় সামনে আনে। মুক্ত গণমাধ্যমের ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয়তা এখানেই। ধীরে ধীরে সরকার পিছু হটে।
কিন্তু আবরারের সময় কোনো মন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেনি।
আবরার হত্যার পর সংগঠনটি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ থেকে ১১ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে। দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েট উপাচার্য হামলাকারীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন।
রোগ শনাক্ত যথাযথ, কিন্তু ওষু্ধের প্রয়োগ ভুল
অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগ বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি নতুন নয়। আমাদের সামনে এমন অনেক উদাহরণ আছে।
তবে সংগঠন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার সত্ত্বেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এই অসুখের শিকড় আরও অনেকটাই গভীরে। বছরের পর বছর ধরে বহুবার নির্ণীত হয়েছে সেসব কারণ।
তবে তা পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে কোনো যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
২০১৭ সালে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্তদের আপিলের রায়ে হাইকোর্ট ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রধান কিছু কারণ চিহ্নিত করেন।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, আগেরদিন বিরোধীদলের অবরোধ প্রতিহত করতে ছাত্রলীগ নেতাদের উসকানির ফল ছিল বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড।
রায়ে আদালত সুনির্দিষ্ট কারণ হিসেবে দেখান, কিছু রাজনৈতিক নেতা চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, হত্যা এবং সহিংসতা ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।
আদালত এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব জাতীয় নেতাদের ওপর ন্যস্ত করেন।
হাইকোর্টের ভর্ৎসনার এক বছর পর বেপরোয়া বাস চালকের গাড়িচাপায় নিহত দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা স্কুল শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারধর করে ছাত্রলীগ।
অত্যুৎসাহী ছাত্রলীগ কর্মী যারা আন্দোলন বানচাল করতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
বিরোধীদল ও সাধারণ মানুষের ওপর ছাত্রলীগের আক্রমণের এরকম আরও বহু ঘটনার কথা আমরা জানি।
জাতীয় নেতাদের হাইকোর্ট যে আহ্বান জানিয়েছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
অপর একটি আইনি পদক্ষেপেও ছাত্র রাজনীতি আলোচিত হয়।
এক দশকেরও বেশি আগে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল থেকে ছাত্র সংগঠন পৃথক করতে নির্বাচনী আইন সংস্কারের প্রস্তাব এনেছিল।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল যে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক আচরণের অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা।
কিন্তু আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে আওয়ামী লীগ দেশের শাসন সংকটের কারণগুলো যথাযথভাবেই শনাক্ত করেছিল।
দলটি চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের অঙ্গীকার করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সন্ত্রাসমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
কিন্তু নির্বাচনের পর সব বদলে যেতে থাকে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপদ্রব শুরু হয়।
বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেতার পদ থেকে ইস্তফা দেন।
তবে ছাত্রলীগ কর্মীরা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকেনি। পরের বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক সতর্কবার্তা জারি করে এবং টেন্ডারবাজিসহ অন্যান্য অনিয়মের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সহিংস ঘটনা অব্যাহত থাকে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী আবরার হত্যাকাণ্ডের আগে দশ বছরে প্রায় ১৫০টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে ছাত্রলীগের অন্তত ৬০ নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। প্রায় একই সংখ্যক শিশু এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়।
সহিংসতামূলক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধ আয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শহর এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রবণতাই এসব সহিংসতার পেছনে দায়ী।
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের আইনবিরুদ্ধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জোরালো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
বরং দিন দিন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছেন।
সংঘাতমূলক রাজনৈতিক চর্চার ফাঁদ
আসলে এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। জাতীয় রাজনীতিতে যে সংঘাতমূলক রাজনৈতিক চর্চা হয়ে আসছে, সেটি ছাত্র রাজনীতির মধ্যে অসহিষ্ণুতা জন্মাতে সাহায্য করেছে।
স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসার জন্য লড়াই শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তারা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়। দুই দল প্রায়ই একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে।
এই একই আচরণের প্রতিফলন ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলের সম্পর্কের মধ্যেও দেখা যায়।
দুটি ছাত্র সংগঠনকেই তাদের মূল রাজনৈতিক দল বিরোধী পক্ষকে মোকাবিলার জন্য ব্যবহার করে। সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিতে কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো আন্দোলনের ক্ষেত্রেও মিছিল-মিটিং বা উত্তেজনা ছড়ানোর কাজে ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করা হয়।
এর প্রতিদান হিসেবে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ছাত্রলীগ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায় এবং সরকারের আশীর্বাদ ভোগ করে। অন্যদিকে, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন ছাত্রদলও একই রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছিল।
এদিকে দেশের আইনপ্রণেতারাও ধীরে ধীরে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের পক্ষপাতী হয়ে ওঠে।
২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় বিগত দশ বছর ছাত্রলীগের জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। এই সময়ে ক্যাম্পাসগুলো থেকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের অস্তিত্বই হারিয়ে গেছে বলা যায়। ছাত্রলীগ একইসঙ্গে বেপরোয়া ও লাগামহীন হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগের অন্য অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
যুবলীগের নেতাদের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা এবং টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে ধরপাকড়ের পর যুবলীগের চরিত্রের এই কালো অধ্যায় সবার সামনে ফাঁস হয়ে যায়।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর কিছু যুবলীগ নেতাকে তাদের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়।
কিন্তু গুটিকয়েক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতার বহিষ্কার এবং গ্রেপ্তারের মতো ছোটখাটো পদক্ষেপ নিলে এবারও হয়তো তার ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
কারণ আমাদের এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা যদি রয়ে যায়, তাহলে অপরাধী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের কোনো অভাব থাকবে না।
তাই দুয়েকজন অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া স্রেফ সাময়িক স্বস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ফল পাওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই রোগ বুঝে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।
লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
ভাষান্তর ও পরিমার্জন: তামারা ইয়াসমীন তমা ও খুশনূর বাশার জয়া
মূল লেখা : From Biswajit to Abrar: The course has not changed