পেগাসাস: বাড়ছে ব্যবসা, বাড়ছে ইসরায়েলের প্রভাব
কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের সফল বাহন হিসেবে শক্তিধর রাষ্ট্রযন্ত্র অনেককাল ধরেই অস্ত্রকে ব্যবহার করছে। তবে ভয় দেখাতে নয়। বরং অস্ত্র বিক্রির বিনিময়ে কোনো দেশের কূটনীতির মোড় পরিবর্তন করে নিজ স্বার্থের পথে নিয়ে আসতে এমনটি করা হচ্ছে।
তেল আবিবভিত্তিক নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের স্টাফ রাইটার রনেন বার্গম্যান এবং দুই দফা পুলিৎজার বিজয়ী ওয়াশিংটনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক মার্ক ম্যাজজেনটি যৌথভাবে এক প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনে ইসরায়েলের সাইবার অস্ত্র কূটনৈতিক বিজয় অর্জনের ঘটনাবলী ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে। রনেন বার্গম্যানের সর্বশেষ বই 'রাইজ অ্যান্ড কিল: দ্য সিক্রেট হিস্টোরি অব ইসরাইল'স টারগেটেড অ্যাসাসিনেশন' সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। আর মার্ক ম্যাজজেনটির সর্বশেষ বইয়ের নাম- 'দি ওয়ে অব নাইফ: দ্য সিআইএ, এ সিক্রেট আর্মি, অ্যান্ড আ ওয়ার অ্যাট দ্য অ্যান্ডস অব দি আর্থ।'
মেক্সিকোর কাছে পেগাসাস বিক্রির মাধ্যমে ভাগ্য খুলতে থাকে এনএসও'র। দেশটি মাদক বিরোধী লড়াইয়ে সফলতা অর্জন করে পেগাসাসের বদৌলতে। পাশাপাশি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইসরায়েল বিরোধী নীতিকে বর্জন করে। তবে এনএসও নিয়ে কাজ করার সুযোগ ও বিপদ উভয়ই তুলে ধরে মেক্সিকোর উদাহরণ। ২০১৭ সালে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সিটিজেন ল্যাব পেগাসাস অপপ্রয়োগ নিয়ে প্রথম বোমাটি ফাটাল। কোমল পানীয়র অস্বাস্থ্যকর দিক তুলে ধরে এর ওপর বাড়তি কর বসানোর সামাজিক আন্দোলন চলছিল। এই আন্দোলনে জড়িতদের ফোন হ্যাক করতে পেগাসাস ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সিটিজেন ল্যাবের প্রতিবেদন জানায়। মানবাধিকার কর্মী, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের জড়িত ব্যক্তি এবং সাংবাদিকদের ফোন হ্যাকের বৃহত্তর তৎপরতার অংশ হিসেবে এ কাজ করে মেক্সিকো সরকার। ২০১৪ সালে ইগুয়ালাতে ৪৩ ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই গণহত্যার রহস্য উদঘাটনে জড়িত আইনজীবীদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরগিরি করতেও ব্যবহার হয় পেগাসাস। মেক্সিকো সরকারের কেউ এ কাজটি করেন। মার্কিন এফবিআই সমতুল্য মেক্সিকোর আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান ছিলেন টমাস জেরোন দে লুসিও। ছাত্র-গণহত্যা নিয়ে সরকারি বক্তব্য তিনিই দেন। এতে দাবি করা হয়, ছাত্র-গণহত্যায় জড়িত ছিল স্থানীয় একটি অপরাধচক্র। ছাত্র-গণহত্যায় মেক্সিকোর ফেডারেল সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি ধামাচাপা দিতে টমাস সচেষ্ট ছিলেন বলে সন্দেহকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে তদন্তের মুখে পড়েন খোদ টমাসই । তখনই উঠে আসে যে ধামাচাপা দেওয়ার তৎপরতায় তার হাতিয়ার হয়ত ছিল পেগাসাস। সরকারি দায়িত্বের অন্যতম অংশ হিসেবে সাইবারঅস্ত্র পেগাসাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার অনুমতি তার হাত দিয়েই যেত। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে, আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে পেনা নিয়েটোর স্থলাভিষিক্ত হলেন। মেক্সিকোর তদন্তকারীরা অভিযোগ করেন যে ইগুয়ালা গণহত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে নির্যাতন, অপহরণ এবং সাক্ষী-প্রমাণ গুম করার কারসাজিতে জড়িত ছিলেন জেরোন। মেক্সিকো ছেড়ে প্রথমেই কানাডায় এবং তারপরে ইসরায়েলে পালিয়ে যান। পর্যটক হিসাবে ইসরায়েলে ঢুকেছিলেন তিনি। এখনো সেখানেই রয়েছেন। মেক্সিকো তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলে তবে ইসরায়েল সাড়া দেয়নি তাতে।
গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি করার সদিচ্ছা আমেরিকার নেই। এতে এনএসও এবং ইসরায়েলের জন্য অন্যান্য সুযোগ সৃষ্টি হয়। আগস্ট ২০০৯-এ পানামার নির্বাচনে বিজয়ী হতে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন রিকার্ডো মার্টিনেলি। তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল "রাজনৈতিক দুর্নীতি দূর করার।" উইকিলিকসের প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তারবার্তা থেকে জানা যায়, মার্কিন কূটনীতিকদের কাছে "নিরাপত্তা হুমকির পাশাপাশি রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরিতে ব্যবহৃত নজরদারির সরঞ্জাম দেওয়ার জন্য দেনদরবার করেছিলেন।" পানামার মার্কিন মিশনের ডেপুটি চিফ উত্তরে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র "(পানামার) অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্তুতে আড়িপাতার কোনও প্রচেষ্টায় অংশ নেবে না।"
ভিন্ন রাস্তা ধরেন মার্টিনেলি। অধিকৃত ফিলিস্তিনের গাজায় ২০০৮-০৯ সালে ইসরায়েলি আগ্রাসনের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের গোল্ডস্টোন কমিশন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১০ সালে এ প্রতিবেদন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন করে পানামাসহ ছয় দেশ। জাতিসংঘে ভোটাভুটির এক সপ্তাহ পরে তেল আবিবে অবতরণ করেন মার্টিনেলি। লাতিন আমেরিকার বাইরে তার অন্যতম প্রথম সফর এটি। তিনি ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেসকে বলেন, পানামা সবসময় ইসরায়েলের পাশে থাকবে। "বিশ্বের রাজধানী- জেরুজালেমের অভিভাবকত্বে" ইসরায়েলের প্রশংসা করেন তিনি। তিনি বলেন, তার মন্ত্রী, ব্যবসায়ী এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতারা ইসরায়েলে এসেছেন শিখতে। তার মুখ থেকে আরো শোনা যায়, "আমরা অনেক দূরে এসেছি, কিন্তু পানামার ইহুদি হৃদয়ের কারণে আমরা (ইসরায়েলের) খুব কাছাকাছি রয়েছি।"
গোপনে, মার্টিনেলি ধুমসে নজরদারি এবং গোয়েন্দাগিরির সাজ-সরঞ্জাম কিনতে থাকেন। নেতানিয়াহুর সাথে একান্তে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠকে ইসরায়েলের কোম্পানিগুলো থেকে যে সব গোয়েন্দা ও সামরিক সরঞ্জাম কিনতে চান মার্টিনেলি তা নিয়ে আলোচনা করেন দুজনে। বৈঠকে যোগদানকারী এক ব্যক্তির মতে, ব্ল্যাকবেরির বিবিএম টেক্সট সার্ভিস হ্যাক করার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আগ্রহ দেখান মার্টিনেলি। সে সময় এ টেক্সট সার্ভিস খুবই জনপ্রিয় ছিল পানামায়।
দুই বছরের মধ্যে, ইসরায়েল তাকে অত্যাধুনিক সাইবারঅস্ত্র বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। এর আগে এমন সাইবারঅস্ত্র দুনিয়া দেখেনি। ২০১২ সালে পানামা সিটিতে এনএসও'র তৈরি সাইবারঅস্ত্র বসানো হয়। এরপর মার্টিনেলির সরকার অনেকবার ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দেয়। ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের মর্যাদা বাড়ানোর জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের পক্ষে ১৩৮ দেশের ভোট পড়ে। এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ইসরাইলসহ মাত্র সাতটি দেশ। এ দেশগুলোর কাতারে ছিল পানামাও।
পানামার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বিশ্লেষক ইসমায়েল পিট্টির আদালতে দেওয়া হলফনামায় স্বীকার করেন, এনএসও থেকে কেনা সাজ-সরঞ্জামগুলো "পানামাবাসী এবং পানামাবাসী নন এমন ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে" ব্যবহার হয়েছে। তিনি আরো বলেন, "আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই" রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ম্যাজিস্ট্রেট, ইউনিয়ন নেতা, ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে এটি প্রয়োগ করা হয়। সরকারি কৌশলীরা পরে আরো জানান, এমনকি পেগাসাস পরিচালনাকারী দলকে নিজ উপপত্নীর ফোন হ্যাক করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন মার্টিনেলি। ২০১৪ সালে মার্টিনেলি স্থলাভিষিক্ত হলেন তারই ভাইস প্রেসিডেন্ট জুয়ান কার্লোস ভারেলা। ভারেলা নিজেও মার্টিনেলির গুপ্তচরবৃত্তির লক্ষ্য ছিলেন বলে দাবি করেন। তবে তার আগে, মার্টিনেলির অনুগত কর্মীরা গুপ্তচরবৃত্তির ব্যবস্থা ভেঙে দেয় এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। (অবশ্য নভেম্বর মাসে পানামার আদালত তাকে আড়িপাতার অভিযোগ থেকে খালাস দেয়।)
এদিকে প্রতি বছর এনএসও'র বিক্রি দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে তা ৩০ মিলিয়ন, ৩০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৬০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এনএসও'র বিক্রি বৃদ্ধির এ হার বিনিয়োগকারীদের চোখে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বৈশ্বিক বিনিয়োগ সংস্থা ফ্রান্সিসকো পার্টনারস ২০১৪ সালে এনএসও'র ৭০ শতাংশ শেয়ারের জন্য ১৩০ মিলিয়ন ডলার দেয়। তারপর সার্কেলস নামের ইসরায়েলি আরেকটি সাইবারঅস্ত্র সংস্থাকে এনএসও'র একীভূত করে৷ সার্কেলস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতর এএমএএন'এর সাবেক এক প্রবীণ কর্মকর্তা। মোবাইল ফোনের একটি দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজ খদ্দেরকে বিশ্বের যে কোনো স্থানে মোবাইল ফোনের অবস্থান বের করার সুযোগ করে দেয়া সার্কেলস। অবশ্য এরও ১০ বছর আগে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা এ পদ্ধতি বের করেছিল। এনএসও'র সঙ্গে সার্কেলস একীভূত হওয়ায় নিজ খদ্দেরদের সেবা দেওয়ার পরিধি আগের চেয়েও বাড়ে।
একাধিক নতুন চুক্তির মাধ্যমে, পেগাসাস দুনিয়াজোড়া ডান ধারার নেতাদের একটি উদীয়মান প্রজন্মকে একত্রিত করতে সহায়তা করে। ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বরে সারা এবং বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বিটা সিডলো এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, উইটোল্ড ওয়াসজিকোভস্কিকে নিজ বাসভবনে নৈশভোজে স্বাগত জানান। এর কিছু পরেই পোল্যান্ড তার দেশের কেন্দ্রীয় দুর্নীতি দমন ব্যুরোর জন্য একটি পেগাসাস ব্যবস্থা কেনার জন্য এনএসও'এর সাথে একটি চুক্তি সই করে। সিটিজেন ল্যাব ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে জানায় যে পোলিশ বিরোধী দলের অন্তত তিনজন সদস্যের ফোন এই গোয়েন্দা যন্ত্র দিয়ে হামলা করা হয়েছে। সাইবারঅস্ত্র পেগাসাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ তখনো দেননি নেতানিয়াহু। এমনকি পোলিশ সরকার হলোকাস্ট বিরোধী কথিত আইন প্রণয়ন করেন। ইহুদি বিশ্ব এবং খোদ ইসরায়েল এই আইনকে হলোকাস্টকে অস্বীকার করা হিসেবে দেখে। পোলিশ প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি, নেতানিয়াহু নিজে উপস্থিত হয়ে এক সম্মেলনে বলেন, হলোকাস্টের জন্য যারা দায়ী তাদের মধ্যে "ইহুদি অপরাধীরা" আছেন। কিন্তু এতোসবের পরেও পোল্যান্ডের পেগাসাসের সংযোগ বাতিল হয়নি।
হিন্দু জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন নরেন্দ্র মোদি এবং ২০১৭ সালে তিনি ইসরাইল সফরে যান। তিনিই ইসরায়েল সফরকারী প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। কয়েক দশক ধরে ভারত "ফিলিস্তিনি কারণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ" বলে একটি নীতি বজায় রেখেছিল এবং ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক ছিল শীতল। মোদির সফরটি অবশ্য বিশেষভাবে সৌহার্দ্য ভরপুর ছিল। স্থানীয় সমুদ্র সৈকতে তাঁর এবং প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর একসঙ্গে খালি পায়ে হাঁটার দৃশ্যটি সতর্কতার সাথে মঞ্চস্থ হয়। সে সময় দুজনের মধ্যে বিরাজ করছিল উষ্ণ অনুভূতি। তাদের নেতৃত্বাধীন ইসরায়েল ও ভারত মোটামুটি দুই বিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং গোয়েন্দা সাজ-সরঞ্জাম বিক্রির একটি প্যাকেজের বিষয়ে সম্মত হয়। এ বিক্রির কেন্দ্রে ছিল সাইবার অস্ত্র পেগাসাস এবং একটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। কয়েক মাস পরে নেতানিয়াহু ভারতে বিরল রাষ্ট্রীয় সফরে যান। পাশাপাশি ২০১৯ সালের জুনে ভারত জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলে ইসরায়েলের সমর্থনে ভোট দেয়। ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংস্থাকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নে এ ভোটাভুটিতে ভারত না ভোট নেয়। এই প্রথম ফিলিস্তিন প্রশ্নে ভারত না ভোট দিল।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হাঙ্গেরির কাছে পেগাসাস বিক্রির অনুমোদন দেয়। প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চালান বলে প্রচার সত্ত্বেও এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বিরোধী ব্যক্তিত্ব, সামাজিক কর্মী, সাংবাদিক যারা তার বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করেছিলেন এবং তিক্ত শত্রুতে পরিণত হওয়া সাবেক ব্যবসায়িক অংশীদারদের পরিবার বিরুদ্ধে এই সাইবার অস্ত্র ব্যবহার করেন আরবান। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইসরায়েলের একনিষ্ঠ সমর্থক হলেন অরবান। জর্দান নদীর পশ্চিম তীরকে একতরফাভাবে সংযুক্ত করার ইসরায়েলি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেনি যে গুটিকয়েক দেশ, ২০২০ সালে তাদের মধ্যে হাঙ্গেরিও ছিল। একই বছরের মে মাসে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক গ্রুপ হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। পাশাপাশি গাজার জন্য মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। হাঙ্গেরি এবং অন্য ২৬ দেশ এ আহ্বানে যোগ দিতে অস্বীকার করে।
পেগাসাসের সাহায্যে জোট গঠন করা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ফলপ্রসূ হলো ইসরায়েল এবং তার আরব প্রতিবেশী দেশগুলোর জোট। ইসরাইল প্রথমে সাইবারঅস্ত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)' এর কাছে বিক্রির অনুমোদন দেয়। আমিরাতের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে একে গণ্য করা হয়। ২০১০ সালে মোসাদ চরেরা দুবাইয়ের একটি হোটেল ঘরে হামাসের এক পদস্থ কর্মকর্তাকে বিষ প্রয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলে সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আমিরাতের কার্যত শাসক, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ যত না হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষুব্ধ হয়েছেন তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হন আমিরাতের মাটিতে ইসরায়েলিরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে। এমবিজেড নামে সাধারণভাবে পরিচিত যুবরাজ এ ঘটনার পর ইসরায়েলের সাথে নিরাপত্তা সম্পর্ক বাতিল করার নির্দেশ দেন। পেগাসাস কেনার সুযোগ দেওয়া হলে শুধু অনায়াসে রাজিই হয়নি আমিরাত বরং ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নও করে।
আমিরাত নিজ অভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে পেগাসাস মোতায়েন করতে দ্বিধা করেনি। আমিরাত সরকারের স্পষ্টবাদী সমালোচক আহমেদ মনসুর। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটিজেন ল্যাব জানায়, মনসুরের ফোন হ্যাক করতে পেগাসাস ব্যবহার করা হয়। কোন দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে হ্যাক করা হয়েছিল তা প্রকাশ হওয়ার পর তড়িঘড়ি অ্যাপল তা বন্ধ করে দেয়। এ জন্য আপডেট দেওয়া হয়। কিন্তু ততদিনে মনসুরের ষোলআনা ক্ষতির ষোলকলা পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তার গাড়ি চুরি গেছে। তার ইমেল অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে গেছে। তিনি কোথায় যাচ্ছেন বা কোথায় থাকছেন তার ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক হিসাব থেকে ১৪০০০০ ডলার হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি চাকরি হারিয়েছেন। বরখাস্ত করা হয়েছে। রাস্তায় অপরিচিত কিছু মানুষ মনসুরকে আচ্ছা সে ধোলাই দিয়েছে। সে সময়ে তিনি বলেন, "আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে আপনার প্রতি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। আপনার পরিবার-পরিজন আতঙ্কে দিন কাটাতে শুরু করবে আর এটা নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে।" (মনসুরের কাহিনি এখানেই শেষ নয়। ফেসবুক এবং টুইটারে পোস্টের দায়ে ২০১৮ সালে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়)
দুবাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এলোমেলো পরিস্থিতি সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েল এবং আমিরাত নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক বছরের পর বছর ধরে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর করছিল। ইসরায়েল এবং আরব বিশ্বের মধ্যকার বিদ্বেষ বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির চালিকাশক্তি ছিল। এই সম্পর্ক এই অঞ্চলে একটি নতুন অস্বস্তিকর জোটের পথ তৈরি করে। পারস্য উপসাগরের ইসরায়েল এবং সুন্নি মুসলমান রাষ্ট্রগুলো তাদের চিরশত্রু শিয়া মুসলমান ইরানের বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হয়ে যায়। আরব রাজারা নিজেদের ফিলিস্তিনিদের রক্ষক এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে পাশে থাকার দাবি করছে। এ প্রেক্ষাপটে এমন জোটের কথা কয়েক দশক আগেও শোনা যায়নি। ফিলিস্তিনের প্রতি প্রতিশ্রুতি পরবর্তী প্রজন্মের আরব নেতাদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনা। তারা সুন্নি এবং শিয়াদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের মোকাবেলা করার জন্য তাদের বিদেশী নীতির অনেকটাই গঠন করেছে। তারা ইরানের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসাবে ইসরায়েলের সাথে অভিন্ন কারণ খুঁজে পেয়েছে।
অসুস্থ রাজার ছেলে এবং রাজ্যের প্রকৃত শাসক সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের চেয়ে এ ক্ষেত্রে আর কোনো নেতা বেশি গতিশীলতা দেখাতে পারেননি। ২০১৭ সালে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ সৌদি রাজতন্ত্র এবং বিশেষ করে যুবরাজ এমবিএসের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি সৌদি নিরাপত্তা সংস্থার কাছে পেগাসাস বিক্রির অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই মুহূর্ত থেকেই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা সংস্থার প্রবীণ সদস্যদের একটি ছোট দল বিষয়টি সরাসরি নেতানিয়াহুকে জানান।সৌদিদের সাথে আদান-প্রদানে নেতৃত্বের ভূমিকা নেন; "অতি গোপনীয়তার সাথে চরম পদক্ষেপ নেওয়ার" সাথে জড়িত এমন এক ইসরায়েলি এ কথা জানান। একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেন, (পেগাসাস দেওয়ায়) আশা ছিল যুবরাজ মোহাম্মদের প্রতিশ্রুতি এবং কৃতজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব হবে। ২০১৭ সালে পেগাসাস স্থাপনার চুক্তি সই হয় এবং চুক্তি মোতাবেক পেগাসাস স্থাপন করতে প্রাথমিকভাবে ৫৫ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে।
কয়েক বছর আগে, মার্কিন পররাষ্ট্র-নীতি নির্ধারণী সাবেক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সুনীতি বিষয়ক কমিটি গঠন করে এনএসও। এ কমিটিতে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট উভয় দলের সাবেক কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সম্ভাব্য খদ্দেরদের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার লক্ষ্যে গঠন করা হয় এ কমিটি। ২০১৮ সালে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর, সুনীতি কমিটির সদস্যরা এনএসও-এর সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রচারিত গল্প-কাহিনিগুলোর সমাধান করতে জরুরি বৈঠকের অনুরোধ করে। ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট খাসোগির উপর গুপ্তচরবৃত্তিতে পেগাসাস ব্যবহার হয়েছে সে কথা এনএসও'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শালেভ হুলিও স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করেন। কখনো কোনো অভিযোগ উঠলে জবাব দেওয়ার জন্য প্রতিটি সাইবার হামলার নথি পেগাসাস সংরক্ষণ করে। খদ্দেরের অনুমতিক্রমে এ সব নথি খতিয়ে দেখতে পারে এনএসও। হুলিও দাবি করেন যে তার কর্মীরা সৌদি নথিগুলো খতিয়ে দেখেছে এবং খাসোগির বিরুদ্ধে এনএসও'র কোনো পণ্য বা প্রযুক্তি ব্যবহারের আলামত খুঁজে পায়নি। তবুও সুনীতি কমিটি সৌদি আরবের পেগাসাস ব্যবস্থাকে বন্ধ করার জন্য এনএসওকে অনুরোধ করে। এনএসও সে অনুরোধ রক্ষা করে। সৌদি আরবে হ্যাকিং সিস্টেম পুনরায় চালু করার ইসরায়েল সরকারের পরবর্তী অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করার পরামর্শ এনএসওকে দেয় সুনীতি কমিটি। সৌদি আরবে পেগাসাস ব্যবস্থা তখন বন্ধই থাকে।
- সূত্র- নিউ ইয়র্ক টাইমস