ইরাকে ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ অনুসন্ধান যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিল!
ইরাক যুদ্ধের বিশ বছর পার হয়েছে, তবে 'গণবিধ্বংসী অস্ত্রের' উপস্থিতি প্রসঙ্গে বিতর্ক এখনো থামেনি। এ অস্ত্রকে ওজর হিসেবে দেখিয়ে ইরাক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল যুক্তরাজ্য। সম্প্রতি বিবিসি'র সিরিজ শক অ্যান্ড ওয়ার: ইরাক ২০ ইয়ার্স অন-এ ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অনুসন্ধান নিয়ে নতুন অনেক তথ্য জানা গিয়েছে।
ব্রিটিশ বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬-এর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা যখন সহকর্মীর কাছে প্রথম জানতে পেরেছিলেন ইরাক আক্রমণের ব্যাপারে মার্কিনীরা জোর দিয়ে ভাবছে, তখন তিনি যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের এ খবরে আশ্চর্য হওয়ার কথা এখনো মনে করতে পারেন সিআইএ'র কর্মকর্তারাও।
সিআইএ'র তৎকালীন ইরাক অপারেশন গ্রুপ-এর প্রধান লুইস রুয়েডা স্মৃতিচারণ করেন, 'আমার তো মনে হয়েছিল (খবরটা শুনে) তারা ওই টেবিলেই হার্ট অ্যাটাক করবেন। উনারা নেহায়েত ভদ্রলোক ছিলেন বলে, নাহলে টেবিল ছেড়ে এসে হয়তো আমাকে চড়ই মেরে বসতেন।'
মার্কিনীদের এ মনোভাবের কথা দ্রুতই ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছায়। খবরটা ওই অফিসে কূটনৈতিকদের বদলে গোয়েন্দারা নিয়ে গিয়েছিলেন।
ওই সময়ের এমআই৬-এর প্রধান স্যার রিচার্ড ডিয়ারলাভের ভাষ্যে, "সম্ভবত আমিই সবার আগে প্রধানমন্ত্রীকে খবরটা জানিয়েছিলাম। 'শুনতে ভালো বা খারাপ যা-ই লাগুক, সবকিছু গোছাতে শুরু করুন কারণ মনে হচ্ছে ওরা (মার্কিনীরা) আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে।'"
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করতে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অজুহাতটি একেবারে অপরিহার্য কোনো বিষয় ছিল না। রুয়েডা বলেন, 'সাদ্দাম হোসেনের কাছে একটা রাবার ব্যান্ড আর পেপারক্লিপ থাকলেও আমরা ইরাকে আক্রমণ চালাতাম।'
অন্যদিকে ইরাকে আক্রমণের পক্ষে জনমত অর্জন করতে ব্রিটিশ সরকারের জন্য ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র তথা রাসায়নিক, জৈব ও পারমাণাবিক অস্ত্রই ছিল মূল অজুহাত।
অনেক সময়ই অভিযোগ উঠেছে, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের দাবি ব্রিটিশ সরকারের বানানো ছিল। কিন্তু ওই সময়ের মন্ত্রীরা বলেছেন, তাদের গোয়েন্দারাই অস্ত্র থাকার ব্যাপারে তাদেরকে নিশ্চিত করেছিলেন।
বিবিসি'র নিরাপত্তা প্রতিনিধি গর্ডন কোরেরাকে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেন, 'এটা বোঝা জরুরি যে আমি যেসব গোয়েন্দা তথ্য পাচ্ছিলাম সেগুলোর ওপরই আমি নির্ভর করছিলাম এবং আমার মনে হয় ওই তথ্যগুলো বিশ্বাস করার অধিকার আমার ছিল।'
ব্লেয়ার আরও জানান, আক্রমণের পূর্বমুহূর্তেও তিনি জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটি থেকে অস্ত্রের উপস্থিতি বিষয়ে আবারও নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন এবং কমিটি তাকে নিশ্চিত করেছিল। তবে ভুল তথ্য সরবরাহের জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমালোচনা করার পক্ষে নন ব্লেয়ার।
অন্য ব্রিটিশ মন্ত্রীরা অবশ্য বলছেন, ওই সময় তাদের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ ছিল।
তৎকালীন ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি জ্যাক স্ট্র বলেন, 'রিচার্ড ডিয়ারলাভকে আমি তাদের ওই গোয়েন্দা তথ্যের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে তিনবার জিজ্ঞেস করি। আমার কাছে অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হচ্ছিল পুরো বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু প্রতিবারই ডিয়ারলাভ আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, তার এজেন্টদের ওপর দিব্যি ভরসা করা যায়।'
তবে জ্যাক স্ট্র মনে করেন, এর দায়টা শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের ওপরেই বর্তায়। কারণ এরাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করেন।
ইরাকের ঘটনা তার কাছে গোয়েন্দা-ব্যর্থতা হিসেবে মনে হয় কি-না জিজ্ঞেস করলে স্যার রিচার্ডের উত্তর: 'না।' তিনি এখনো বিশ্বাস করেন কোনো প্রকারের অস্ত্র প্রকল্প ইরাকের অবশ্যই ছিল এবং সেগুলো পরে সীমান্ত দিয়ে সিরিয়ায় সরিয়ে নেওয়া হয়।
তবে অন্যরা ডিয়ারলাভের সঙ্গে একমত নন। যুক্তরাজ্যের তৎকালীন সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স কো-অর্ডিনেটর স্যার ডেভিড ওম্যান্ডের মতে পুরো বিষয়টি ছিল পুরোদস্তুর একটি ব্যর্থতা। তিনি বলেন, কনফার্মেশন বায়াসের দরুন সরকারি বিশেষজ্ঞরা মনে করতে শুরু করেছিলেন যে সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে।
এমআই৬-এর অভ্যন্তরীণ অনেকেও বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। পরিচয় গোপন রাখতে ইচ্ছুক ইরাকে কাজ করা সংস্থাটির একজন গোয়েন্দা বলেন, 'ওই সময় আমার মনে হয়েছিল, আমার যা করছি তা ভুল।'
'ইরাক তাদের গণবিধ্বংসী অস্ত্র প্রকল্প আবার শুরু করেছে এবং সেটি আশু হুমকি হয়ে দাঁড়াবে — এ বিষয়ে আমাদের কাছে নতুন বা বিশ্বাসযোগ্য কোনো গোয়েন্দা তথ্য বা মূল্যায়ন ছিল না,' ২০০২ সালের শুরুর দিকের সময়ের কথা ইঙ্গিত করে বলেন সাবেই ওই কর্মকর্তা।
ওই সময়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে থাকা তথ্যে সামঞ্জস্যের অভাব ছিল। ইরাকে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা এমআই৬-এর গোয়েন্দাদের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র সম্পর্কে একেবারেই শূন্য বা খুবই অল্প পরিমাণে তথ্য ছিল।
ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তখন নতুন সূত্র খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। ১২ সেপ্টেম্বর স্যার রিচার্ড গণবিধ্বংসী অস্ত্র সম্পর্কে নতুন একটি সূত্র নিয়ে ডাউনিং স্ট্রিটে যান। নতুন এ সূত্রটি ছিলেন একজন ব্যক্তি এবং তিনি দাবি করেছিলেন, সাদ্দাম তার অস্ত্রের প্রকল্প আবার নতুন করে শুরু করেছেন।
সূত্রটি শীঘ্রই আরও বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে জানানোর অঙ্গীকারও করেন। ওই সূত্র সবকিছু পরখ করে দেখেননি, এবং তার দেওয়া তথ্য বিশেষজ্ঞ দিয়ে যাচাই করা হয়নি। তারপরও সে সব তথ্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
বলা বাহুল্য, পরবর্তী মাসগুলোতে ওই সূত্র আর কোনো নতুন তথ্য সরবরাহ করেননি। শেষ পর্যন্ত ধারণা করা হয়, তিনি প্রাথমিক তথ্যগুলো বানিয়ে বলেছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তখন মান নিয়ন্ত্রণে খেই হারিয়ে ফেলেছিল বলে অনেকে অভিযোগ করেন।
খুব সম্ভবত নতুন এ সূত্রেরা অর্থের জন্য এসব বানোয়াট তথ্য ব্রিটিশদেরকে সরবরাহ করেছিলেন। অথবা হয়তো তারা সাদ্দামের পতন চেয়েছিলেন। বিবিসি'র গর্ডন কোরেরা ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে জর্ডানে সাদ্দাম হোসেনের গোয়েন্দা সংস্থা পরিত্যাগ করা একজন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। জাতিসংঘের পরিদর্শকদের চোখের আড়ালে জৈব অস্ত্র নিয়ে কাজ করার জন্য মোবাইল গবেষণাগার তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন বলে কোরেরার কাছে দাবি করেন ওই সাবেক ইরাকি গোয়েন্দা।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই ব্যক্তির দাবি জাতিসংঘে উপস্থাপন করেন মার্কিন সেক্রেটারি অভ স্টেট কলিন পাওয়েল। তবে খোদ মার্কিন সরকারের অভ্যন্তরেও অনেকে ওই তথ্য বিশ্বাস না করার পক্ষে ছিলেন। 'কার্ভবল' নামক ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের ব্যবহার করা আরেকটি সূত্রও গবেষণাগার প্রসঙ্গে ভুয়া তথ্য দিয়েছিলেন।
এ কথা মনে রাখতে হবে যে, এক সময় সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল। ২০০৩ সালের যুদ্ধের কয়েক সপ্তাহ আগে উত্তর ইরাকের হালাবজা নামক একটি গ্রামে গিয়েছিলেন কোরেরা। সেখানে ১৯৮৮ সালে স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর সাদ্দামের বাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা শুনতে পান তিনি। ওসব অস্ত্রের প্রকৃত নিয়তি কেবল যুদ্ধের পরেই জানা গিয়েছিল।
সাদ্দাম তার গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বেশিরভাগ ধ্বংস করে ফেলার জন্য ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে আদেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিল, এর ফলে জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের কাছ থেকে ইতিবাচক অনুমোদন পাওয়া যাবে। হয়তো পরে কখনো এ ধরনের অস্ত্র প্রকল্প আবার চালু করার পরিকল্পনা ছিল তার।
কিন্তু সাদ্দাম তার এসব অস্ত্রের সবটুকুই গোপনে ধ্বংস করেন। ফলে পরে যখন জাতিসংঘের পরিদর্শকেরা দেশটির কাছে অস্ত্র ধ্বংস করার প্রমাণ চাইল, তখন সাদ্দাম হোসেন কোনে প্রমাণ সরবরাহ করতে পারলেন না।
২০০২ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘের পরিদর্শকেরা পুনরায় ইরাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজতে শুরু করেন। এসব পরিদর্শকের অনেকেই এ প্রথমবারের মতো বিবিসি'র কাছে মুখ খুলেছেন। তাদের অনেকেই জানান, পশ্চিমা গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে তারা অনেক স্থানে পরিদর্শনে যেতেন। এসব গোয়েন্দা তথ্যে ওসব স্থানে ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগারের সম্ভাব্য অবস্থানের কথা বলা হতো। কিন্তু পরিদর্শকেরা গিয়ে কেবল মাকড়সার জাল জড়িয়ে থাকা আইসক্রিম ট্রাক দেখতে পেতেন।
'আমার ভবিষ্যৎ আপনার হাতে,' ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে কিছুটা ঠাট্টা করে স্যার রিচার্ডকে টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন। 'ব্যাপারটা হতাশাজনক ছিল,' স্যার রিচার্ড স্মৃতিচারণ করেন।
ইরাকে কোনো কিছু খুঁজে না পাওয়ায় জাতিসংঘের পরিদর্শকদের 'অযোগ্য' হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি। তখন জাতিসংঘের রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্র পরিদর্শন পরিচালনা করতেন হ্যান্স ব্লিক্স। ২০০৩ সালের আগ পর্যন্ত তারও মনে হয়েছিল সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল।
কিন্তু গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে করা অনুসন্ধানগুলো যখন কোনো ফল দিলো না, তখন পুরো বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেন ব্লিক্স। উত্তর খোঁজার জন্য তিনি আরও সময় চেয়েছিলেন, কিন্তু কখনো তা পাননি।
'শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সামরিক সংঘাত এড়াতে আমি চেষ্টা করেছিলাম,' বিবিসিকে বলেন টনি ব্লেয়ার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এক ভিডিও কলে তাকে আসন্ন আক্রমণ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আক্রমণ পরবর্তী ঘটনাবলিতে যুক্ত থাকার সুযোগ দিয়ে এক প্রস্তাব করেন। কিন্তু ব্লেয়ার তা গ্রহণ করেননি।
টনি ব্লেয়ার ইরাকে আক্রমণে ব্রিটেনের যুক্ত থাকার তার সিদ্ধান্তের আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেন, এটি সাদ্দামকে মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গে তার কাছে যেমন একটি নৈতিকতার বিষয় ছিল তেমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার বিষয়টিও তাকে ভাবতে হয়েছিল। কারণ ব্রিটেন অংশ না নিলে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে তার বড়সড় প্রভাব পড়ত বলে মনে করেন ব্লেয়ার।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরাকে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া গেল না। 'সবকিছু ভেঙেচুরে গেল,' এমন মন্তব্যই করেছেন সাবেক একজন এমআই৬ কর্মকর্তা। এ ঘটনা ব্রিটিশ রাজনীতিক ও গোয়েন্দা; উভয়ের ওপরেই একটি গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রেখেছিল।