১২ বার সার্জারি করা কানাডিয়ান অভিনেতা ভন কলুচি কে? তিনি কি এআইয়ের সৃষ্টি?
চলতি সপ্তাহের শুরুতে বিশ্বের একাধিক সংবাদমাধ্যমে সেন্ট ভন কলুচি নামক এক কানাডিয়ান অভিনেতার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, কে-পপ ব্যান্ড বিটিএস এর গায়ক জিমিনের মতো চেহারা পেতে ১২ বার সার্জারি করানোর পর এই অভিনেতার মৃত্যু হয়েছে।
ডেইলি মেইল অনলাইন, দ্য ইন্ডিপেনডেন্টসহ একাধিক পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এবং দ্য ইকোনমিক টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, হিন্দুস্তান টাইমসহ বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও সেন্ট ভন কলুচির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু এই সেন্ট ভন কলুচির কি আসলেই অস্তিত্ব আছে?
আল-জাজিরার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রমাণ বলছে যে এই সেন্ট ভন কলুচি আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে সাজানো একটি প্রতারণার অংশ। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য, ভারত ও মালয়েশিয়ার ডজন ডজন মিডিয়া আউটলেটকে বোকা বানানো হয়েছে এই ভুয়া সংবাদের মাধ্যমে।
কম্পিউটার জেনারেটেড মিথ্যা সংবাদের যুগে 'মৃত সেন্ট ভন কলুচি' আখ্যানের মাধ্যমেই প্রথম এআই ব্যবহার করে এতগুলো মিডিয়াকে বোকা বানানো হলো বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভন কলুচি চেয়েছিলেন আমেরিকার এক জনপ্রিয় স্ট্রিমিং নেটওয়ার্কে কে-পপ তারকা হয়ে কাজ করবেন। আর সেটার জন্যই তিনি তিনি ধাপে ধাপে ১২টি সার্জারি করান। গত শনিবার চোয়াল প্রতিস্থাপনের জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ধকল তিনি নিতে পারেননি, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তার মৃত্যু হয়।
অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট এর ডক্টোরাল শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক ফেলিক্স এম সিমন বলেন, "এআই টুলের সাহায্যে তৈরি ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য অবশ্যই উদ্বেগের কারণ, কারণ তারা ফ্যাক্ট-চেকার ও সাংবাদিকদের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে।"
চলতি সপ্তাহের শুরুতে সারা বিশ্বের সাংবাদিকদের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয় যে কানাডিয়ান অভিনেতা সেন্ট ভন কলুচি গত ২৩ এপ্রিল সিউলের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছে। এরপর থেকেই ঘটনার শুরু।
আনাড়ি হাতে লেখা ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছিল 'হাইপ পাবলিক রিলেশনস' নামক একটি জনসংযোগ এজেন্সি থেকে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ছিল অসংখ্য অসঙ্গতি।
এছাড়াও, বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া অনেক ওয়েব লিংকই কাজ করছিল না। ভন কলুচির ব্যক্তিগত ইনস্টাগ্রাম একাউন্টের এবং যে হাসপাতালের কথা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সে হাসপাতালেরও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
হাইপ-এর ওয়েবসাইটটি দেখে মনে হচ্ছিল এটি অসমাপ্ত এবং ভন কলুচির মৃত্যু সংবাদ দেওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই এটি রেজিস্টার করা হয়েছে।
আল-জাজিরার পক্ষ থেকে হাইপ-এর একটি নম্বরে কল দেওয়া হলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে আল-জাজিরাকে ওই নম্বর থেকে একটি ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়, যাতে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে লেখা ছিল- 'কী চান আপনি?'
দিনকয়েক আগে পাওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তির বাইরেও যে সেন্ট ভন কলুচি নামক কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল, তার তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
গুটিকয়েক কে-পপ তারকার জন্য গীতিকার হিসেবে কাজ করেছেন- এ্মন বর্ণনার বাইরে তার সম্পর্কে অনলাইনে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এবং তার মৃত্যুতেও জনসম্মুখে কাউকে শোক প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।
বরং অনলাইনে তার সম্পর্কে যেটুকু পাওয়া গেছে তাতে আরও সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে।
অনলাইনে সেন্ট ভন কলুচির ছবিগুলো ঝাপসা এবং কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে ছবিতে; যেমন- বিকৃত হাত, যা এআই'র সাহায্যে তৈরি ছবির একটি চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।
এআই-জেনারেটেড ইমেজ ডিটেকশন সফটওয়্যার (যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে) বলছে, কিছু কিছু ছবি এআই'র সাহায্যে তৈরি বা সম্পাদিত হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আল-জাজিরা নিজেরা ছবিগুলোর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
ভন কলুচির সঙ্গীতভাণ্ডার বলে যা দাবি করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ' T1K T0K H1GH SCH00L' নামক অ্যালবাম, সেটিও কোনো মূলধারার মিউজিক স্ট্রিমিং সার্ভিসে নেই।
গত বছর প্রকাশিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ভন কলুচিকে 'ইউরোপের শীর্ষ হেজ ফান্ড কোম্পানি আইবিজি ক্যাপিটালের সিইও জিওভানি লামাসের দ্বিতীয় ছেলে' বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সেই জিওভানি লামাসেরও অফিসিয়াল কোনো অনলাইন উপস্থিতি নেই। অন্যদিকে আইবিজি ক্যাপিটাল লিখে অনলাইনে সার্চ দিলে দেখা যায় এটি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় অবস্থিত একটি ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম।
আরও এক টুইস্ট হলো, কে-পপ তারকা হতে আগ্রহী ব্যক্তিটির ইনস্টাগ্রাম পেজ এ সপ্তাহে আবারও সচল করা হয়েছিল এবং তার কথিত মৃত্যুর খবর দেওয়ার দুদিন পরে একটি কমেন্টও এডিট করা হয়েছে; পরে সেই কমেন্ট আবার ডিলিটও করা হয়েছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে থাকা অসংখ্য অসঙ্গতিও বিভিন্ন মিডিয়া আউটলেটে ভন কলুচির মৃত্যুর খবর প্রকাশ হওয়া থামাতে পারেনি। এমনকি অনলাইনে কলুচির সার্জারির আগের ও পরের ছবিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায় তার ইউরোপীয়দের মতো চেহারা পাল্টে পূর্ব-এশীয়দের মতো চেহারা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
ডেইলি মেইল অনলাইন ভন কলুচির সংবাদ প্রকাশের পর বিশ্বের অন্যান্য মিডিয়া আউটলেটও তা লুফে নেয় এবং কলুচির কথিত মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ করে।
বুধবার ডেইলি মেইল অনলাইন কোনো রকম ব্যাখ্যা ছাড়াই সংবাদটি সরিয়ে নেয়। কিন্তু দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, দ্য হিন্দুস্তান টাইমস, মালয়েশিয়ার মালয় মালিসহ আরও ডজন ডজন সংবাদমাধ্যমে এই সংবাদ রয়ে গেছে।
আল-জাজিরা সিউলে অবস্থিত কানাডিয়ান দূতাবাসের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার গণমাধ্যম জানিয়েছে, সার্জারি জটিলতায় কোনো কানাডিয়ান অভিনেতার মৃত্যুর খবর তাদের কাছে আসেনি।
ভন কলুচির মৃত্যুঘটিত এই প্রতারণা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্য বিকৃত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই'র (যেটি এখনও উন্মেষকালে রয়েছে) সক্ষমতা কতখানি; বিশেষ করে দিন দিন মিডিয়ার আয় ও হেডকাউন্ট হ্রাস পাওয়া পেশাদার সাংবাদিক ও সংবাদের ভবিষ্যত এবং তাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এ ঘটনা।
চ্যাটজিপিটির মতো প্ল্যাটফর্ম মানুষের মতো করেই গোটা একটি নিবন্ধ লিখতে পারে, এবং এটি ব্যবহার করে এমন সংবাদ বানানো সম্ভব যা কোনো রাজনৈতিক কারসাজি বা ষড়যন্ত্র ছড়াতে ব্যবহৃত হতে পারে মাত্র কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে।
এছাড়াও, 'ডিপফেইক' এর জন্যও এআই ব্যবহৃত হতে পারে, যেখানে বাস্তবের কোনো ব্যক্তির ছবি ও ভিডিও বিকৃত করে ব্যবহার করা হয়। কারো সম্মানহানি করতে, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পর্ন তৈরি করতে, এমনকি সহিংসতার উস্কানি দিতেও ডিপফেইককে কাজে লাগানো হয়।
এর আগেও এআই'র সাহায্যে তৈরি কন্টেন্ট দিয়ে বহু মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার অভিযোগ এসেছে।
পোপ ফ্রান্সিসের সাদা পাফার জ্যাকেট পরা জাল ছবি এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রেপ্তার হওয়ার ভুয়া ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করা হয়েছে আগে।
কিন্তু ভন কলুচির কথিত মৃত্যুর সংবাদের মাধ্যমেই প্রথম এত বড় পরিসরে সাংবাদিকদের বোকা বানানো হলো, যা সম্পাদনার মানের ঘাটতি ও মৌলিক ফ্যাক্ট-চেকিং এর অভাব বুঝিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু তবুও অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের সিমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, এআই'র সাহায্যে তৈরি জাল সংবাদ পাবলিক ডিসকোর্সের উপর সর্বনাশা প্রভাব ফেলবে না।
তিনি বলেন, "আমাদের মোটামুটি ধরনের জ্ঞানীয় সতর্কতা রয়েছে- যেমন, ঘটনার প্রেক্ষাপট মূল্যায়ন, উৎস খোঁজা, পূর্বের তথ্যের সাথে মিলিয়ে দেখা ইত্যাদি- এগুলো আমাদেরকে পুনরায় প্রতারণার ফাঁদে পড়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সাহায্য করবে।