যান চলাচলে সবচেয়ে দ্রুত ও ধীরগতির শহর: ঢাকার অবস্থান কোথায়?
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ পার্কের দূরত্ব নয় মাইল। এই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে প্রায় ৫৫ মিনিট।
অন্যদিকে মিশিগানের ফ্লিন্টে বিমানবন্দর থেকে একই দূরত্বের স্লোন মিউজিয়াম অব ডিসকভারিতে যেতে সময় লাগবে ৯ মিনিট।
চার লাখের লোক বসবাস করা একটি আঞ্চলিক শহরের তুলনায় ২ কোটি লোকের শহর ঢাকায় যান চলাচলের গতি কম হওয়াই প্রত্যাশিত মনে হতে পারে। তবে নতুন গবেষণা মতে, কেবল মাত্র গাড়ির সংখ্যা বা যানজটের কারণে কোনো শহর ধীরগতির হয় না। কারণ এমনকি মধ্যরাতেও, সবেচেয় ধীরগতির শহর ঢাকায় গাড়ি সংখ্যা অল্প থাকলেও ৯ মাইল পাড়ি দিতে লাগে ৩০ মিনিট, ফ্লিন্টের চেয়ে যা তিনগুণ বেশি।
ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ থেকে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে ধীরগতির শহরের তালিকায় ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামও আছে যথাক্রমে নবম ও দ্বাদশ স্থানে। ধীরগতির শহরের তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে নাইজেরিয়ার লাগোস এবং ইকোরোডু। চতুর্থ স্থানে আছে ফিলিপাইনের ম্যানিলা। এরপরের তিনটি শহর ভারতের ভিওয়ানডি, কলকাতা ও আররাহ।
আর সবচেয়ে দ্রুতগতির শহরের তালিকায় সেরা ২০টির ১৯টিই যুক্তরাষ্ট্রের। বাকি একটি কানাডার উইন্ডসর (১৯তম)।
গবেষণা মতে, যান চলাচলে ধীরগতির জন্য কত সংখ্যক গাড়ি চলছে তা আংশিকভাবে দায়ী। তারচেয়ে বরং রাস্তার ধরণ ও মান এবং পাহাড় কিংবা নদীর মতো প্রাকৃতিক বাধা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ কারণেই যানজটসহ এবং যানজট ছাড়া; দুই ক্ষেত্রেই দ্রুত কিংবা ধীরগতির শহর নির্ধারণ করেছেন গবেষকরা।
দেখা গেছে, যানজট কম থাকা থাকা অবস্থাতেও ঢাকা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধীরগতির শহর। এই তালিকায় শীর্ষে আছে নাইজেরিয়ার ইকোরোডু। তারপর আছে একই দেশের শহর আবা।
ফিনল্যান্ডের অল্টো ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ এবং এই গবেষণার প্রধান গবেষক প্রত্যয় আকবর বলেন, সবচেয়ে যানজটপূর্ণ শহর যে সবেচয়ে ধীরগতির হবে বা ঠিক উল্টোটা হবে তেমনটা নয়।
আকবর এবং তার সহ-গবেষকরা তিন লাখের বেশি জনসংখ্যার ১,১১৯টি শহর নিয়ে গবেষণা করেছেন। আর তারজন্য তথ্য নেওয়া হয়েছে গুগল ম্যাপ থেকে। তবে অ্যাপটি চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না বলে সেখানকার শহরগুলো এই তালিকায় নেই। তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বিবেচনায় পিয়ংইয়ং-এর মতো শহরকেও অন্তুর্ভুক্ত করা হয়নি।
যাবতীয় তথ্য যাচাই শেষে দেখা গেছে, শহরের আকার কিংবা বয়স নয়; বরং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যান চলাচলের গতির ক্ষেত্রে অনেক বেশি নির্ধারক। গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রুতগতির ১০০ শহরের তালিকায় ৮৬টি যুক্তরাষ্ট্রের। এবং ধনী দেশের তুলনামূলক কম আয়ের শহরগুলোর গতিও বেশি।
আর ঢাকা, ম্যানিলা কিংবা লাগোসের মতো যান চলাচলে ধীরগতির শহরগুলো উন্নয়নশীল দেশে অবস্থিত। যেখানে জনসংখ্যা বিবেচনায় অবকাঠামো সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
গবেষক প্রত্যয় আকবর বলেন, সবচেয়ে দ্রুতগতির সব শহরগুলো ধনী দেশে আর সব ধীরগতির শহর তুলনামূলক দরিদ্র দেশের।
আর যানজটের ক্ষেত্রে ধনী, দরিদ্র, মধ্যম আয়ের; সব ধরনের দেশই আছে। এই তালিকায় কলম্বিয়ার বোগোতা এবং মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটির পাশাপাশি নিউ ইয়র্কের নামও আছে। শহরগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ বিষয় হলো সেগুলোর আকার। প্রত্যেকটি শহরই বড় এবং প্রত্যাশিতভাবেই সেখানে যানবাহনের সংখ্যাও বেশি।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, যানজট বেশি হলেও শহর দ্রুতিগতির হতে পারে। যেমন, নাশভিলে, অস্টিন, টাম্পা, হস্টন এবং আটলান্টা সবচেয়ে যানজটপূর্ণ ২৫ শতাংশ শহরের মধ্যে আছে, তারপরও সেগুলো সেরা ১০ শতাংশ দ্রুতগতির শহরের মধ্যে আছে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আকবর বলেন, গবেষণায় পাওয়া সবেচয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, শহরভেদে ভিন্ন ভিন্ন সমাধানে নজর দিতে হবে। যেমন ঢাকায় সড়কে প্রাইভেট কার কমানো কিংবা রিক্সার মতো ধীরগতির যান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
আকবর বলেন, এসব পদ্ধতিতে দিনের বেলায় সর্বোচ্চ মাঝ রাতে যান চলাচলের গতি নিশ্চিত করা যাবে।
তিনি আরো বলেন, উন্নয়নশীল দেশের শহর পরিকল্পনাবিদরা অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ফ্রান্স থেকে যানজট নিরসনের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। অথচ দেশগুলোর অবস্থা অনেকটাই ভিন্ন।
আকবর আরো বলেন, যান চলাচলের দ্রুতগতিই একটি শহরকে আকর্ষণীয় করে তোলে না। বিষয়টি প্রয়োজনের তুলনায় অবকাঠামোখাতে অতি বিনিয়োগের ফলও হতে পারে। যেমন, ১৯৫০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ফ্লিন্টের জনসংখ্যা অর্ধেক কমেছে।
আকবর বলেন, 'সবচেয়ে দ্রুতগতির শহরই হিংসা করার মতো শহর, বিষয়টা এমন নয়।'