দুবাই-এর ভারী বৃষ্টি ও ভয়াবহ বন্যার সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা
এ মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতে মারাত্মক বন্যা ও বিপর্যয় তৈরি হয়েছিল যা আংশিকভাবে জলবায়ু সংকট দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুসারে, এ রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর সাথে সম্পর্কিত।
ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন উদ্যোগের অধীনে ২১ জন বিজ্ঞানী ও গবেষকের একটি দল আবিষ্কার করেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যই সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে ১০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে যা সাধারণত এল নিনোর বছরে ঘটে না।
১৪ ও ১৫ এপ্রিলে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের ব্যবধানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রেকর্ড অনুযায়ী [৭৫ বছর আগে দেশটিতে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা শুরু হয়] সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মরুভূমির শহর হিসেবে পরিচিত দুবাইতে টানা কয়েক মাস বৃষ্টি না হওয়াই যেখানে স্বাভাবিক ঘটনা সেই শহরেই দেড় বছরের সমপরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক মডেল ব্যবহার করে দলটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যার সম্ভাবনা কতটা বেশি ছিল তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি।
গবেষণা দলটি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের পিছনে প্রধান কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়া। বায়ুমণ্ডল স্বাভাবিকের থেকে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হলে তা ৮.৪ শতাংশ বেশি বেশি আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে যা ভারী বৃষ্টিপাতের অন্যতম প্রধান কারণ।
বন্যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে চারজন এবং ওমানে কমপক্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে ১০ জন শিশু ছিল। চরম আবহাওয়ার কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেশ কয়েকটি অংশে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে যা মহাকাশ থেকে স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমেও দেখা গেছে।
দুবাইয়ের বন্যার বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক হাজারেরও বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে এবং টানা কয়েকদিন ফ্লাইট বিলম্বিত হয়েছে।
বন্যার জন্য রাস্তায় লোকজনকে তাদের গাড়ি ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ফিলিপাইনের তিন নারী বন্যার কারণে তাদের গাড়িতেই মারা যান।
এমনকি বিলাসবহুল শপিং মলগুলো পানিতে ভেসে গিয়েছিল, আকাশচুম্বী ভবনগুলোর লিফট কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং রাস্তা অবরুদ্ধ হওয়ার কারণে কিছু মোটরচালককে তাদের গাড়িতেই ঘুমাতে হয়েছিল।
জুরিখের বায়ুমণ্ডল ও জলবায়ু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সোনিয়া সেনেভিরত্নে জানিয়েছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের মতো শুষ্ক অঞ্চলগুলোও বৃষ্টিপাতের উল্লেখযোগ্য প্রভাবের মুখোমুখি হতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় এটি আরো গুরুতর হয়ে উঠছে।
সৌদি আরবের জেদ্দায় অবস্থিত কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চের মনসুর আলমাজরুই উল্লেখ করেছেন, দুটি দেশে ভারী বৃষ্টিপাত পৃথক শক্তিশালী ঝড় থেকে এসেছে। সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ঝড়ের মাত্রা আরো তীব্র হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এপ্রিল এবং মে মাসে আরব উপদ্বীপের সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান সহ কোন কোন অঞ্চলে অনেক সময় মেসোস্কেল সংবহনশীল সিস্টেম থেকে একাধিক বজ্রঝড় একত্রিত হয়ে একটি একক আবহাওয়া ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে যা জন্য ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।
লন্ডনের গ্রান্থাম ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিজ্ঞানের সিনিয়র প্রভাষক ফ্রেডেরিক অটো বলেছেন, গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে এই ঝড়গুলো আরো ঘন ঘন ঘটছে। অটোর মতে, এল নিনো এপ্রিলের বৃষ্টিতেও অবদান রেখেছে। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের গতি কমানোর গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন।
জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা থেকে সরে আসার বিষয়ে বৈশ্বিক চুক্তি সত্ত্বেও প্রচুর সম্পদ আছে এমন অনেক দেশ প্রচুর পরিমাণে কয়লা, তেল এবং গ্যাস আহরণ করে চলেছে। কেউ কেউ জীবাশ্ম জ্বালানি নিষ্কাশন ও ব্যবহার প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ করার জন্য নতুন অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রাকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই সীমাবদ্ধ করতে নতুন জীবাশ্ম জ্বালানী প্রকল্পগুলো বন্ধ করার ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু নিয়ে আলোচনার প্রায় ছয় মাস পরেও দেশগুলো এখনো নতুন তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র খুলছে।
ফ্রেডেরিক অটো সতর্ক করে জানিয়েছেন, ক্রমাগত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে অনেক অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার ঘটনা আরো বৃদ্ধি পাবে।
এল নিনো: এল নিনো প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত যার ফলে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের সমুদ্রের পানি উষ্ণ হয়ে ওঠে। এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধের পূর্ব দিকের বায়ুর প্রবাহ বদলে যাওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার অঞ্চলে গরম বাতাস প্রবাহিত হওয়া, তীব্র তাপদাহ অথবা বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন ঘটতে পারে।
জীবাশ্ম জ্বালানি: হাইড্রোকার্বন ধারণকারী জ্বালানি যেমন কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস যা মৃত গাছ এবং প্রাণীর দেহাবশেষ থেকে প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর ভূত্বকের মধ্যে তৈরি হয়।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়