লেবাননে ডিভাইস বিস্ফোরণ: কীভাবে হলো, এখনই বা কেন এই হামলা?
লেবাননে দুটি পৃথক ঘটনায় কয়েক হাজার পেজার ও রেডিও ডিভাইস বিস্ফোরিত হয়ে হাজারো মানুষ আহত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৭ জন। এমন একটা হামলা কীভাবে চালানো হলো, তা এখনও তদন্তাধীন।
লেবানন ও হিজবুল্লাহ—যাদের সদস্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে টার্গেট করা হয়েছিল—এই ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। যদিও ইসরায়েল এখনও পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি।
তাইওয়ান থেকে জাপান, হাঙ্গেরি, ইসরায়েল ও লেবানন পর্যন্ত এ ঘটনার সূত্র অনুসন্ধান করেছে বিবিসি।
কিন্তু অনেক এখনও প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।
পেজারগুলো কীভাবে বিস্ফোরিত হলো?
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, কোনো জটিল হ্যাকের মাধ্যমে পেজারগুলো বিস্ফোরিত করা হতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এই তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে পরিমাণ ক্ষতি করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, ডিভাইসগুলো হিজবুল্লাহর হাতে পৌঁছানোর আগেই সম্ভবত ওগুলোতে বিস্ফোরক পুরে দেওয়া হয়েছিল।
বিস্ফোরণে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া পেজারগুলোর একাংশে ছোট একটা তাইওয়ানি ইলেকট্রনিক্স প্রস্তুতকারক কোম্পানির লোগো দেখা গেছে—যার নাম 'গোল্ড অ্যাপোলো'।
বিবিসির একটি দল তাইপে-র শহরতলিতে অবস্থিত কোম্পানিটির অফিসে যায়।
ওই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সু চিং-কুয়াংকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি বড়সড় ধাক্কা খেয়েছেন। বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা তিনি অস্বীকার করেন।
সু বিবিসির প্রতিবেদকদের বলেন, 'লেবাননের (ডিভাইসের) ছবিগুলো দেখুন। ওগুলোর কোথাও কিন্তু মেইড ইন তাইওয়ান লেখা নেই। আমরা এসব পেজার তৈরি করিনি!'
এরপর তিনি বিএসি কনসাল্টিং নামে হাঙ্গেরির একটি কোম্পানির দিকে ইঙ্গিত করেন।
সু জানান, তিন বছর আগে তিনি হাঙ্গেরির বিএসি কোম্পানিকে তাদের পেজারে গোল্ড অ্যাপোলোর ট্রেডমার্ক ব্যবহারের লাইসেন্স দিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, বিএসি থেকে অর্থ স্থানান্তর প্রক্রিয়া 'খুব অদ্ভুত' ছিল, সমস্যা ছিল পেমেন্টেও। আর ওই পেমেন্ট আসত মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
এ ঘটনার সঙ্গে হাঙ্গেরিয়ান কোম্পানির কী সম্পর্ক?
বিবিসি এবার বিএসি কনসাল্টিংয়ের নিবন্ধিত অফিসে গিয়ে দেখতে পায়, অফিসটি হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের একটি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত।
ওই ঠিকানায় আরও ১২টি কোম্পানির অফিস আছে। তবে ভবনের কেউই বিএসি কনসাল্টিং সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
হাঙ্গেরির কর্মকর্তারা জানান, বিএসি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২২ সালে। প্রতিষ্ঠানটি ওই দেশে স্রেফ একটি ব্যবসায়িক মধ্যস্থতাকারী কোম্পানি হিসেবে কাজ করছিল। এর কোনো উৎপাদন কারখানা ছিল না।
লিঙ্কডইনে বিএসির প্রকাশিত একটি ব্রোশিওর থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্যের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টসহ (ডিএফআইডি) আটটি সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছে। তবে ডিএফআইডির দায়িত্বপ্রাপ্ত যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে জানিয়েছে, বিএসির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
বিএসির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এর প্রধান নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টিয়ানা বারসোনি-আর্সিডিয়াকোনো। বিবিসি তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সফল হয়নি।
তবে এনবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বারসোনি-আর্সিডিয়াকোনো বলেছেন, 'আমি পেজার তৈরি করি না, আমি কেবল মধ্যস্থতাকারী।'
তাহলে বিএসি কনসাল্টিংয়ের পেছনে আসলে কারা আছে?
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএসি কনসাল্টিং আসলে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের ভুয়া প্রতিষ্ঠান ছিল।
পত্রিকাটি তিনজন ইসরায়েলি কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে যারা পেজার তৈরি করছিলেন, তাদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য আরও দুটি শেল কোম্পানি খোলা হয়েছিল। আর ওইসব পেজার বানাচ্ছিলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
বিবিসি স্বতন্ত্রভাবে এসব প্রতিবেদন যাচাই করতে পারেনি। তবে বুলগেরিয়ান কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বিএসির সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
বুলগেরিয়ান টিভি চ্যানেল বিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেবাননে ডিভাইস হামলার সঙ্গে যুক্ত ১.৬ মিলিয়ন ইউরো বুলগেরিয়া হয়ে হাঙ্গেরিতে পাঠানো হয়েছিল।
রেডিও ডিভাইসগুলোতে বিস্ফোরক রাখা হলো কীভাবে?
দ্বিতীয় দফায় বিস্ফোরিত হওয়া রেডিও ডিভাইসগুলোর ব্যাপারেও বিস্তারিত তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, হামলায় ব্যবহৃত ডিভাইসগুলোর মধ্যে কিছু ছিল জাপানের আইকম কোম্পানির আইসি-ভি৮২ মডেল।
একটি গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, পাঁচ মাস আগে হিজবুল্লাহ এই ডিভাইসগুলো কিনেছিল।
তবে এর আগে আইকমের যুক্তরাষ্ট্র শাখার একজন সেলস এক্সিকিউটিভ বলেছেন, লেবাননে বিস্ফোরিত রেডিও ডিভাইসগুলো নকল পণ্য হতে পারে, ওসব পণ্য তাদের কোম্পানি তৈরি করেনি। তিনি আরও বলেন, অনলাইনে এ ধরনের নকল পণ্য সহজেই পাওয়া যায়।
বিবিসি মাত্র কয়েক সেকেন্ড খুঁজেই অনলাইন মার্কেটপ্লেসে আইকমের আইসি-ভি৮২ মডেল পেয়েছে।
আইকম এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ২০১৪ সালের অক্টোবরেই আইসি-ভি৮২ মডেলের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। এ ডিভাইস চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাটারির উৎপাদনও বন্ধ করা হয়েছে।
কোম্পানিটি বলেছে, তাদের সব রেডিও পশ্চিম জাপানের একটি কারখানায় তৈরি হয়। তারা বিদেশে উৎপাদন আউটসোর্স করে না।
বার্তা সংস্থা কিয়োদো-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইকমের পরিচালক ইয়োশিকি এনোমোয়ো ডিভাইসগুলোর ব্যাটারি কম্পার্টমেন্টের ক্ষতির ছবি দেখে ধারণা করেছেন যে ডিভাইসগুলোতে বিস্ফোরক ভরে দেওয়া হয়েছে।
ডিভাইসগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হলো কীভাবে?
বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, ডিভাইসগুলো বিস্ফোরণের কয়েক সেকেন্ড আগে ভুক্তভোগীরা তাদের পকেটে হাত দিয়েছেন। রাস্তায়, দোকানে, বাড়িতে—দেশজুড়ে হয়েছে এসব বিস্ফোরণ। এতে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।
লেবাননের কর্তৃপক্ষের ধারণা, একটি 'ইলেকট্রনিক মেসেজ' পাঠিয়ে ডিভাইসগুলো বিস্ফোরিত করা হয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিস্ফোরণের আগে পেজারগুলোতে সম্ভবত হিজবুল্লাহর নেতাদের কাছ থেকে বার্তা এসেছিল। এসব বার্তাই ডিভাইসগুলোর বিস্ফোরিত হওয়ার কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কী ধরনের বার্তা পাঠানো হয়েছিল, তা এখনও জানা যায়নি।
অন্যান্য ডিভাইসেও কি এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানোর ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে?
লেবানিজরা এখন উৎকণ্ঠিত—ক্যামেরা, ফোন, ল্যাপটপের মতো অন্যান্য ডিভাইসেও হয়তো বিস্ফোরক ভরে দেওয়া রয়েছে।
সেনাবাহিনী বৈরুতের রাস্তায় রিমোট-নিয়ন্ত্রিত বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট ব্যবহার করে এসব সন্দেহজনক ডিভাইস পরীক্ষা করছে।
লেবাননে বিবিসি ক্রুদের থামিয়ে দিয়ে ফোন বা ক্যামেরা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।
গিদা নামের স্থানীয় এক নারী বিবিসির একজন সংবাদদাতাকে বলেন, 'সবাই আতঙ্কে আছে…ল্যাপটপ বা ফোনের পাশে থাকা নিরাপদ কি না, আমরা জানি না। সবকিছুই এখন বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। কেউই বুঝতে পারছে না কী করা উচিত।'
এখন কেন এই আক্রমণ?
একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, ইসরায়েল সম্ভবত হিজবুল্লাহকে একটি শক্তিশালী বার্তা দিতে চেয়েছিল, বিশেষ করে ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের একদিন পর, যেদিন হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট ছোড়ে। ওই ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে প্রায় এক বছর ধরে চলা সীমান্ত উত্তেজনা আরও বেড়েছে।
আরেকটি তত্ত্বের দাবি, ইসরায়েলের এই মুহূর্তে হামলা চালানোর ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আক্রমণের পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার উপক্রম হওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে আগেভাগেই হামলা চালিয়েছে।
মার্কিন সংবাদ সংস্থা অ্যাক্সিওসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল, হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের একেবারে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা হিসেবে এই পেজার হামলা চালানো হবে। কিন্তু ইসরায়েল যখন বুঝতে পারে হিজবুল্লাহ তাদের এই পরিকল্পনা আঁচ করে ফেলেছে, তখন তারা অবিলম্বে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।