কাক-কথা
ঢাকার কাকমাত্রই আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে। আমাকে দেখলেই কাক 'অ্যালার্ম-কল' দেয়। যেখানেই যাই, আমাকে দেখে কাক জোর গলায় ডাকে: 'কা-ক, কা-ক'। এই ডাক হলো পাতিকাকের সতর্কবাণী। এর অর্থ: 'সাবধান, নিচে শত্রু।' ওই ডাক শুনে অন্য কাকেরা ঘাড় বাঁকিয়ে আমাকে দ্যাখে। তারপর তারাও সতর্কবাণীটি দেয়: 'কা-ক, কা-ক'। আমি বাইরে হাঁটলেই কাক থেকে কাকের মুখে এই সতর্কবাণী রিলে হতে থাকে: 'সাবধান, নিচে শত্রু।'
পাখিদের বহু ধরনের সতর্কবাণী আছে। তার মধ্যে প্রথমটি হলো: 'সাবধান, নিচে শত্রু।' দ্বিতীয়টি হলো: 'সাবধান, ওপরে শত্রু।' বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কণ্ঠে এই সতর্কবাণীগুলো অবশ্যই বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। কিন্তু সব পাখিই অন্য পাখির সতর্কবাণী বুঝতে পারে। পাখির এক প্রজাতি অন্য প্রজাতির ভাষা বোঝে না; সতর্কবাণীটা বোঝে। কাকের সতর্কবাণী শোনার পর পথের চড়ুই, শালিক আর দোয়েলও নিশ্চয়ই আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে। তারপর হুমকির কোনো কারণ না হয়ে আমি যখন সুরসুর করে চলে যাই, তখন হয়তো তারা বলে: 'বাচাল কাক।'
এখন কথা হলো, কাক আমাকে সন্দেহের চোখে কেন দ্যাখে! এককালে আমার কাছে সেটা দুর্বোধ্য ছিল। এখন তা নয়। আমি দেখেছি ঢাকার বাইরেও কোনো কাকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সে দুশ্চিন্তা করতে শুরু করে। একসময় সে ডাক দেয়: 'কা-ক, কা-ক'। হয়তো সে ভাবে: একজন আমার দিকে তাকাচ্ছে, কি মতলব জানি না; তবে সাবধানের মার নেই, এক্ষুনি সবাইকে সাবধান হতে বলি।
কাকের দিকে তাকিয়ে থাকাটা আমার একটা বাতিক ছাড়া কিছু নয়। এমন জটিল এই পাখি; যত দেখি, তত একে রহস্যময় মনে হয়। আমি কাককে কখনো খাবার দেই না; শুধু চেয়ে দেখি। খাবারের উৎকোচ পেলে হয়তো আমার চেয়ে থাকাটাকে মমতার দৃষ্টি বলে গণ্য করত বুদ্ধিমান কাক। কিন্তু আহার জোগান দিয়ে কাকের সংখ্যা বাড়ানোটাও তো ভালো নয়। তাই সে কাজে আমার উৎসাহ নেই। আমি শুধু চেয়ে দেখি। আমার এই 'মমতাহীন' কৌতূহলী দৃষ্টিকে কাক স্বভাবতই সন্দেহের চোখে দেখে।
কাক যে বুদ্ধিমান, তা নিয়ে তো আর দ্বিমত নেই। তবে কাক যে দারুণ সাহসী এক প্রাণী, সেটা হয়তো অনেকেই খেয়াল করেন না। আমার দেখা বন্য প্রাণীর মধ্যে পাতিকাক সবচেয়ে সাহসী বলে আমি মানি। প্রাকৃতিক পরিবেশে আমি বাঘ দেখেছি, সিংহ দেখেছি। আমার মনে হয়, বাঘ কিংবা সিংহের চেয়ে পাতিকাক অনেক অনেক বেশি সাহসী।
ইন্ডিয়ার করবেট জাতীয় উদ্যানে আমরা একবার বাঘ দেখতে পেয়েছিলাম। বন থেকে বেরিয়ে একটা বাঘ রাস্তা পার হয়ে একটা ছোট ঝোপের মধ্যে শিকার ধরতে গেল। খবর পেয়ে পর্যটকের দল বাঘ দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল। আমরাও যোগ দিলাম। সবাই বাঘ দেখার অপেক্ষায় আছি। বাঘকে বনে ফিরতে হলে ওই রাস্তাটি পার হয়ে যেতেই হবে। দীর্ঘ সময় পার হলো। রাস্তায় পর্যটকের বিশাল ভিড় জমে গেল। একসময় ঝোপ থেকে বেরিয়ে বাঘ রাস্তা পার হয়ে বনে গেল। গেল বটে; কিন্তু বীরদর্পে গেল না। দেখলাম বাঘটি নিচু হয়ে মাটির সাথে পেট ঘসে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তাটা পার হলো। একবার মুখ খিঁচিয়ে সে আমাদের ভয়ও দেখাল। কিন্তু সে নিজেই যে কত ভীত-শঙ্কিত তা তার চলনে-বলনে মোটেই ঢাকা থাকল না। আমরা অক্ষম, নিরস্ত্র একদল পর্যটকমাত্র। আমাদের ভয়ে বাঘের বিক্রম ধুলায় মিশে গেল। দেখে আমাদেরই মন খারাপ।
তার কিছুদিন পরেই কেনিয়ার অ্যাম্বোসেলি জাতীয় উদ্যানে সিংহ দেখার ভাগ্য হয়েছিল আমাদের। ভাড়া করা গাড়ির ভিতর বসে আমরা নিরাপদেই দেখলাম সিংহের ছোট একটি দল। আপদ হলো যখন একটা গোলমেলে গাড়ির ইঞ্জিন দুম করে সজোরে মিসফায়ার করল। অমনি একটা সিংহ ছুটে পালাল। সেটা দেখেও আমাদের বেশ মন খারাপ হলো। বাঘ-সিংহের শৌর্য-বীর্যের যে চিত্র আমাদের মনে আঁকা ছিল, তা থেকে কিছুটা রং বুঝি ঝরে গেল।
পাতিকাক নিয়ে কিন্তু এর উল্টো ঘটনা ঘটতে দেখেছি একাধিকবার। একবার আমি ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তার দিকে যাচ্ছি; হঠাৎ একটা গুলির আওয়াজ হলো। রাস্তার লোকজন ছুটে আমাদের গলিতে ঢুকতে থাকল আশ্রয় নিতে। আর পাড়ার কাকগুলো ডাকাডাকি করে উড়ে গেল রাস্তার দিকে। দেখলাম, কাকেরা ছুটছে সেই আওয়াজের উৎসের দিকে। তারা জানতে চায় কী ঘটেছে।
যা ঘটেছিল তা গুরুতর কিছু না। গুলির মতো আওয়াজ করে রাস্তায় একটা গাড়ির টায়ার ফেটে গিয়েছিল। গুলি হচ্ছে ভেবে লোক ছুটে পালিয়েছিল। সে কথা জানার পর তারা হাসি-ঠাট্টা করতে করতে রাস্তায় ফিরে গেল। আর কাকের দল রাস্তা ছেড়ে পাড়ায় উড়ে এল। যে আওয়াজে মানুষ ছুটে পালায় আত্মরক্ষার জন্য, কাক ছুটে যায় সেটা অনুসন্ধান করতে। মনে রাখার মতো একটি ঘটনা বটে।
অমন ঘটনা আমি আরও দেখেছি। কোথাও বিপদ আছে মনে হলে কাকেরা পালায় না; বরং সেখানে ছুটে আসে। আসে খোঁজখবর নিতে, আর বিপদের মোকাবিলা করতে। কী হয়েছে, তা জানার আগেই কাক কখনো ছুটে পালায় না। মহাবিপদ ঘটবে সেটা নিশ্চিত হবার পরে কাক পিছু হটতে পারে; কিন্তু বিপদ অনুমান করেই সে চম্পট দেয় না। বিপদের সম্ভাবনা আছে জেনেও সামনে এগিয়ে যাওয়াকে যদি সাহস বলা হয়, তাহলে আমাদের চেয়ে কাক অনেক, অনেক বেশি সাহসী।
আমাদের এক সহকর্মীর ছাদবাগান কাকের বিষ্ঠায় নোংরা হচ্ছিল। রেগেমেগে তিনি একদিন এয়ারগান দিয়ে গুলি করে একটি কাক মারলেন। তিন চার ডজন কাক চিৎকার করে তাঁর মাথার ওপর উড়তে থাকল। তিনি আরও কিছু গুলি ছুড়লেন। আরও একটি কাক মারা পড়ল। শত শত কাক এসে শোরগোল করে তার মাথার ওপর উড়তে থাকল। আমাদের উত্তেজিত সহকর্মী আরও গুলি ছুড়লেন। আরও দুটি কাক মারা পড়ল। ইতিমধ্যে হাজার হাজার কাক এসে ডাকাডাকি করে সবার কানে তালা লাগিয়ে দিল। কাকের কাছে হার মানবেন না বলে কিরা কাটলেও সহকর্মী একসময় ছাদ থেকে নেমে কামরায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন।
কাকের দল ছাদ ছেড়ে গেল না। সারাটা দিন কাকের শোরগোল চলতে থাকল। ওদিকে আমাদের সহকর্মীর জন্য কামরার বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তিনি বাইরে গেলেই চলে কাকের চিৎকার আর ডাইভ-বমিং। কত তুচ্ছ এক পাখি এই পাতিকাক। গুলির মুখেও কী করে তারা ভয়ে পালাল না; দলে দলে এসে প্রতিবাদ করল, প্রতিরোধ গড়ে তুলল! এমন দলবদ্ধ হয়ে মানুষের সাথে লড়াই করার সাহস বাঘ-সিংহেরও কি আছে! নেই। তাই হয়তো পৃথিবীতে বাঘ-সিংহ বিলুপ্তির পিচ্ছিল পথে নেমে যাচ্ছে, যখন কাকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
কাকের এই সংখ্যাবৃদ্ধিটাও আবার নির্ভেজাল সুসংবাদ নয়। কাকের সংখ্যা বাড়তে থাকলে নগরীতে ছোট পাখিদের সংখ্যা কমতে থাকবে। কাক দাপটের সাথে ছোট পাখির ডিম ও ছানা খেয়ে ফেলে। প্রধানত কাকের কারণেই রমনা পার্ক থেকে ফটিকজল, সাহেলি, ঝাড়ভরত, প্রিনা, বুলবুল, ধলাচোখ, দোয়েল, ফুলঝুরি ও মৌটুসির মতো ছোট পাখি উধাও হয়ে যাচ্ছে। পার্কে অনেক ভোজনপ্রিয় মানুষের আগমন ঘটে। তারা সজ্ঞানে অথবা না জেনেই কাকের শ্রীবৃদ্ধিতে অবদান রাখেন।
পাতিকাককে ইনভেসিভ বা আগ্রাসী প্রাণী ঘোষণা করেছে অনেক দেশ। অন্যায় করেছে, তা বলা যায় না। যেখানে কাকের শত্রু নেই সেখানে তার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হয় কেবলমাত্র আহারের প্রাচুর্য দিয়ে। বর্জ্যভুক আর সর্বভুক বলে কাকের আহার্য মেলে সর্বত্র। তাই কাকের সংখ্যাটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে পাতিকাকের আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করা হয়েছে। কাক মারার জন্য সিঙ্গাপুর নগরপালের বেতনভুক নিয়মিত বাহিনীও রয়েছে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ঢাকা নগরীতেও কি কাকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন আছে! এ প্রশ্নের উত্তরটা আমার জানা নেই। ঢাকা নগরীর কাকের সংখ্যা তো আমরা জানি না। এখানে আজও কাকের কোনো শুমারি আমরা করিনি। কাকের সংখ্যাটা মোটামুটি জানা বা অনুমান করার জন্য আজও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ঢাকায় উন্মুক্ত বর্জ্য বাড়ার পাশাপাশি কাকের সংখ্যা বাড়ছে বলে একটা অনুমান আমরা করে থাকি। সেই অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে কাকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।
ঢাকা নগরীতে কাকের শ্রীবৃদ্ধি হওয়ার ফলে আমাদের বড় বড় দুটো সুবিধাও হয়েছে। প্রথমত আমরা বিনা বেতনের ঝাড়ুদার পেয়েছি হাজার হাজার। আমরা যত্রতত্র যে বর্জ্য ছুঁড়ে ফেলি তার একটা অংশ সরিয়ে নেয় কাক। বাড়ির বুয়া মুরগির যে নাড়িভুঁড়িগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দেন, সেগুলো তো পৌরসভার ঝাড়ুদারের নাগালের বাইরেই থেকে যায়। কাক না থাকলে সেই বর্জ্য পচে পাড়ার বাতাস দূষিত করত। আমাদের এই দুর্বল বর্জ্যব্যবস্থাপনার আমলে কাকের সেবাটুকুর গুরুত্ব অনেক।
দ্বিতীয় সুবিধা হলো এই যে নগরীতে আমরা কোকিল পেয়েছি শত শত। গাড়ির হর্নের আওয়াজ ছাপিয়ে আমরা আজও কোকিলের ডাক শুনতে পাচ্ছি। নগরীতে এমন কোনো রাস্তা নেই, যেখানে বসন্তে আপনি কোকিলের ডাক শুনতে পাবেন না। অনেক কাক এখানে বাসা বাঁধে বলেই নগরীতে এত কোকিলের ডাকাডাকি। নগরীতে বট-পাকুরের গাছ আছে, তাই কোকিলের পর্যাপ্ত আহার আছে। ওদিকে কাকের বাসা আছে, তাই কোকিলের ডিম দিয়ে যাওয়ার স্থান আছে।
আমরা জানি, পুরোপুরি না জেনে হলেও কাক সযত্নে কোকিলের ডিমে তা দেয় আর তার ছানা লালনপালন করে। এই পরার্থপরতার ফলে কাক নিজের প্রজননে মোটেই পিছিয়ে পড়েনি। কাকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কোকিলের ছানা পালন না করলে হয়তো কাকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দাবিটা আরও জোরদার হতো। পরের সেবা করার পরেও নিজের ঘর সামলানোর ভালো শক্তি রাখে বলেই তো কাককে কোকিল তার ডিম ও ছানার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। কোকিলের ছানা পালন করতে গিয়ে কাক বিলুপ্ত হলে তো কোকিলও শেষ হয়ে যেত।
কাক-কথার শেষ কথা এই যে পাতিকাক প্রজাতিটি পাতি-চড়ুইয়ের মতো মানুষের সব চেয়ে কাছের পাখি, আমাদের সব চেয়ে কাছের পড়শি। লোকালয় ছাড়া কোথাও পাতিকাক নেই। এ দেশে লোকালয় থেকে দূরে কাক দেখলে ধরে নেবেন সেটা অন্য প্রজাতির কাক; সম্ভবত দাঁড়কাক। বাংলাদেশে কাকের প্রজাতি বৈচিত্র্য খুবই কম; মাত্র দুই প্রজাতির কাক বাস করে এ দেশে।
কুকুর-বিড়াল আর গরু-ঘোড়ার মতো পোষা প্রাণী তো মানুষের ভাষা বুঝতে আর মনের কথা আঁচ করতে ভালোই শিখে নিয়েছে। আমার মনে হয়, পোষ না মেনেও কাক ইতিমধ্যে এর অনেকখানি শিখে ফেলেছে। এবং মনে হয়, কাক আরও শিখতে চায়। আর সে শিখতে চায় মানুষের বশ্যতা স্বীকার না করে, মাথাটা উঁচু রেখেই। প্রকৃতিতে এমন চরিত্র তো হরহামেশা পাওয়া যায় না। তাই পাতিকাককে ব্রাভো না বলে কোনো কাক-কথা শেষ করা যায় না।