প্রভাবশালীদের জন্য ভবন নির্মাণে বিশেষ ছাড় দিয়েছে ড্যাপ: স্থপতিরা
নতুন করে অনুমোদন দেওয়া ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)-এ প্রভাবশালীদের চাপে মাত্র এক শতাংশ এলাকার ভবন নির্মাণে ফ্লোর-এরিয়া রেশিও (এফএআর) এর মান বাড়িয়ে তাদের ভবন নির্মাণে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি)।
রাজউককে এমন পন্থা থেকে বেরিয়ে এসে ড্যাপ সংশোধনের দাবি জানিয়েছে দেশের স্থপতিদের নিয়ে গঠিত এ সংগঠনটি।
সোমবার আইএবি অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত 'গেজেটকৃত ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ): পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়া' শীর্ষক এক অংশীজন সম্মেলনের মাধ্যমে তারা এ দাবি জানায়। ড্যাপ নিয়ে দেশের স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের সামগ্রিক পর্যালোচনা সাপেক্ষে মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য এ আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি)- এর ড্যাপ বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের আহ্বায়ক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, 'ঢাকা মহানগরীর মাত্র এক শতাংশ এলাকায় সর্বোচ্চ ফ্লোর-এরিয়া রেশিও (এফএআর) দেওয়া হয়েছে, যার মান ৫ থেকে ৬। অর্থাৎ এফএআর এর মানের দ্বিগুণ সংখ্যক তলা বিশিষ্ট ভবন করতে পারবে।' উল্লেখ্য ভবনের আয়তন ও উচ্চতা নির্ধারণ করার সূচক হচ্ছে এফএআর।
তিনি বলেন, 'রাজউক শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীকেও প্রভাবিত করেছে ড্যাপ প্রণয়নে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও জানেন না ড্যাপে এমন প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালীদের। যে সংস্থা (রাজউক) বলে ঢাকায় ৮৭ শতাংশ ভবন অবৈধ কিংবা অনুমোদনহীন, সেই সংস্থা দিয়ে ড্যাপ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।'
তিনি বলেন, 'বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, জলসিঁড়ি আবাসন প্রকল্প এলাকা, ঝিলমিল প্রকল্প এলাকা, গুলশান এলাকার জন্য যে এফএআর খসড়া ড্যাপে রাখা হয়েছিল সেটাকে তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। যারা এফএআর চার এর ওপরে পেয়েছেন, তারা সবাই গুলশান, বারিধারা, ধানমন্ডি এলাকার মানুষ। এর দ্বারা ধনী তোষণ করা হয়েছে। আর তুলনামূলক অনুন্নত এলাকা যেমন- মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, শংকর, আদাবর, টোলারবাগ এলাকায় এফএআর দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে কম।'
তিনি বলেন, কড়াইল এলাকার এফএআর এর মান খসড়া ড্যাপের ১.১ থেকে বাড়িয়ে অনুমোদিত ড্যাপে ১.৩ করা হয়েছে। ঠিক বিপরীত দিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৪০ নং ওয়ার্ডের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এফএআর এর মান খসড়া ড্যাপের ১.১ থেকে বাড়িয়ে অনুমোদিত ড্যাপে ৪.১ করা হয়েছে। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে প্রভাবশালীদের চাপে পরিবর্তন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ড্যাপে ঢাকা মহানগরের ৩৪৬টি ব্লকের মধ্যে মাত্র ৫টি ব্লকের এফএআর রাখা হয়েছে ৫ থেকে ৬ এর মধ্যে, ৪ থেকে ৫ এর মধ্যে রাখা হয়েছে ১০টি ব্লক, ৩ থেকে ৪ এর মধ্যে রাখা হয়েছে ১৯টি ব্লক এবং বাকিসব ১ থেকে ৩ এর মধ্যে। বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী, যে জমিতে ৮ তলা ভবন নির্মাণ করা যেতো, সেখানে বর্তমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪-৬ তলা ভবন করা যাবে।
তিনি বলেন, ড্যাপের কাঙ্খিত জনঘনত্ব ২০০ থেকে ২৫০ জন অনুযায়ী, ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ২০৩৫ সালে নেট আবাসিক জনঘনত্ব হবে ৩৯০ জন। অথচ ড্যাপের প্রাক্বলন অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি একরে মানুষ থাকবে ৫৩১ জন, যার মানে ১৪১ জন মানুষ আবাসন পরিকল্পনার বাইরে থাকবে।
তিনি ড্যাপ সংশোধন করে এবং বাস্তবায়নে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বোর্ড পুনর্গঠনের দাবি জানান।
বর্তমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, উত্তরায় তিন কাঠার একটি প্লটে সর্বোচ্চ সাততলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যায়। কিন্তু ড্যাপ অনুযায়ী, উত্তরায় তিন কাঠার জমিতে এখন সর্বোচ্চ ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা যাবে। বিধিমালা ও ড্যাপে এফএআর এর মানের তারতম্যের কারণে এমন হয়েছে।
আইএবি এর সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, 'ড্যাপ এর উদ্দেশ্য ঢাকায় যারা আছেন, তারা যেন সুস্থ, সুন্দরভাবে থাকতে পারেন। কিন্তু ড্যাপ পর্যালোচনা করে আমরা দেখলাম, সবার আবাসনের কথা ভাবা হয়নি। যে পরিকল্পনা করা হয়েছে— তাতে ঢাকা থেকে বহু লোককে চলে যেতে হবে। জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে কীভাবে বের করে দিতে হবে, কীভাবে চলে যেতে বলা হবে, সে প্রশ্নটিই আমাদের।'
তিনি আরও বলেন, 'ঢাকায় লোক আসা বন্ধ করা যাবে না। আর আমি যদি ঢাকায় বাড়ি না বানাই, তাহলে ঢাকায় মানুষ আসবে না, এ চিন্তা অমূলক। ঢাকায় যতদিন আয় থাকবে, ততদিন মানুষ আসবেই। তখন মানুষ বেশিরভাগ বস্তিতে বসবাস করবে। প্রয়োজনে ফুটপাতে শুয়ে থাকবে। ঢাকায় আসা বন্ধ করতে হলে ঢাকার চারপাশে উন্নয়ন করতে হবে।'
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান বলেন, 'রাজউক একটি উৎকোচ (ঘুষ) নেওয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ড্যাপ নিয়ে রাজউক তামাশা করছে। আগে যেখানে আটতলা বাড়ি করা যেত, বর্তমান ড্যাপ অনুযায়ী সেখানে চারতলা বাড়ি করা যাবে। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে।'
তিনি বলেন, 'প্রস্তাবিত ৩০ ফুট রাস্তার জন্য সবাই জায়গা ছেড়ে রেখেছে। কিন্তু একজন জায়গা না ছেড়েই বাড়ি করেছে, রাজউককে একাধিকবার বিষয়টি জানানোর পরও কেউ আসেনি।'
এফএআর নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বৈষম্য করা হয়েছে উল্লেখ করে সম্মেলনে বক্তারা বলেন, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এলাকায় এফএআর বেশি দেওয়া হয়েছে। আর স্বতঃস্ফূর্ত গড়ে ওঠা এলাকায় এফএআর কম দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে বলে বক্তারা দাবি করেন।
ঢাকা উত্তর সিটির ১৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়ূন জনি বলেন, 'আমাদের কাছে এলাকাবাসী খেলার মাঠ চায়, হাঁটার পথ চায় কিন্তু তাদের আশার কথা শোনাতে হয়। আমরা একটি জনবান্ধব নগর গঠনের পরিকল্পনা চাই।'