অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার থেকে হিন্ডেনবার্গ! আদানিকে কাঁপিয়ে দেওয়া কে এই অ্যান্ডারসন?
আদানি গ্রুপ বনাম হিন্ডেনবার্গ গবেষণা নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যম জুড়েই চলছে আলোড়ন। হিন্ডেনবার্গের দাবি, বিশ্বের ১১তম ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানি ও তার নেতৃত্বাধীন আদানি গ্রুপের ঘাড়ে বিপুল পরিমাণে ঋণের বোঝা রয়েছে। এদিকে অ্যাকাউন্টিংয়েও সমস্যা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে তারা। এর পাশাপাশি তারা দাবি করেছে, আদানি গ্রুপ 'বহু বছর ধরেই অভাবনীয় স্টক ম্যানিপুলেশন এবং অ্যাকাউন্টিং জালিয়াতিতে জড়িত।'
হিন্ডেনবার্গের এ প্রতিবেদনের পর শুক্রবার আদানি গ্রুপের স্টক কমেছে ৫ থেকে ২০ শতাংশ; একইসাথে গ্রুপটির বাজারমূল্যের ৩.১৯ ট্রিলিয়ন রূপি যেন মুহূর্তের মধ্যেই উবে গেছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, হিন্ডেনবার্গের এ গবেষণা প্রতিবেদনের মূলে আসলে কে? জানা গেলো ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ট্রু স্কুপের প্রতিবেদন থেকে।
এক কথায় বলতে গেলে, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ একটি বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা যাদের মূল লক্ষ্য শর্ট-সেলিংকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করা। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা নাথান অ্যান্ডারসন।
১৯৩৭ সালে মার্কিন বাজারে অন্যতম আর্থিক কেলেঙ্কারি ছিল 'হিন্ডেনবার্গ কাণ্ড'। সেই ঘটনার সূত্রেই নিজের সংস্থার নাম দিয়েছেন নাথান। অর্থাৎ, তাঁর সংস্থার লক্ষ্য, এমন সব আর্থিক ফাঁক খুঁজে বের করা, যা ধরতে পারলে আগে থেকেই বিপর্যয়ের সম্ভাবনা চিহ্নিত করা যায়।
কানেটিকাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিষয়ে স্নাতক নেওয়া নাথান ফ্যাক্টসেট রিসার্চ সিস্টেমস ইনকর্পোরেটেড নামক একটি ডেটা কোম্পানিতে ফিনান্সে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ফ্যাক্টচেকে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর সাথে কাজ করেন তিনি।
এর আগে এক সাক্ষাৎকারে নাথান জানিয়েছিলেন, তিনি ইসরায়েলে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসাবেও কাজ করেছেন।
মজার বিষয় হলো, নাথান আরেক সাক্ষাৎকারে নিজের রোল মডেল হিসেবে হ্যারি মার্কোপোলোসের কথা উল্লেখ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ জালিয়াতির জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়া বার্নি ম্যাডফের প্রতারণার বিষয়টি সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে আনেন এই হ্যারি।
এবার ফেরত আসা যাক হিন্ডেনবার্গে। ২০১৭ সালে একটি ফরেনসিক আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে হিন্ডেনবার্গ প্রতিষ্ঠা করেন নাথান। ইক্যুইটি, ক্রেডিট এবং ডেরিভেটিভ বিশ্লেষণ ছিল তাদের মূল কাজ।
নিজস্ব ওয়েবসাইটে হিন্ডেনবার্গ বলেছে, তারা 'মানবসৃষ্ট' জালিয়াতি- যেমন অ্যাকাউন্টিং অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে। কোম্পানিটি তাদের নিজস্ব মূলধনই বিনিয়োগ করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিন্ডেনবার্গের বড় সাফল্য
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ইলেকট্রিক ট্রাক প্রস্তুতকারক নিকোলা কর্পের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত হিন্ডেনবার্গ।
মার্কিন মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায়, হিন্ডেনবার্গ দাবি করে যে নিকোলা তাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করেছে।
মূলত নিকোলার একটি ভিডিওকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন নাথান অ্যান্ডারসন। ভিডিওটিতে নিকোলার ইলেকট্রিক ট্রাকটিকে উচ্চগতিতে চলতে দেখা যায়। কিন্তু নাথান দাবি করেন, ট্রাকটি আসলে খাড়া পাহাড় থেকে নেমে আসছিলো বলেই অমনটি দেখাচ্ছিলো।
হিন্ডেনবার্গের এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর, বিনিয়োগকারীদেরকে ভুয়া তথ্য দেওয়ার অভিযোগে নিকোলার প্রতিষ্ঠাতা ট্রেভর মিল্টনকে গত বছর দোষী সাব্যস্ত করে মার্কিন এক জুরি।
২০২০ সালের জুন মাসে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নিকোলা। ফোর্ড মোটরকে ছাড়িয়ে কিছুদিন পরই কোম্পানির বাজারমূল্য ৩৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনের পর বর্তমানে কোম্পানির মূল্য মাত্র ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার।
হিন্ডেনবার্গ জানিয়েছে, কোম্পানিটি সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরিতে হুইসেলব্লোয়ার এবং প্রাক্তন কর্মীরা সহায়তা করেছেন।
হিন্ডেনবার্গ বলছে, আদানি গ্রুপের প্রতিবেদন তৈরিতেও এই একই পন্থায় তাদেরকে প্রাক্তন কর্মীরা সহায়তা করেছে, সেইসাথে প্রচুর নথিপত্র ঘেঁটেছে তারা।
আসলে হিন্ডেনবার্গ চাইছে আদানি গ্রুপ যাতে তাদের বিরুদ্ধে নিউইয়র্কে কোনো মামলা ঠুকে দেয়। এতে করে আদানির কিছু নথিও তাদের হাতে আসবে, যা থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে গ্রুপটি।
২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৬টি কোম্পানির সম্ভাব্য অন্যায় কার্যকলাপকে চিহ্নিত করেছে হিন্ডেনবার্গ।
আদানিকে নিয়ে হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদন
নিউইয়র্ক ভিত্তিক ফার্মটির দাবি, তারা আদানির বিনিয়োগ এবং স্টকগুলো ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করে ২ বছরে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। গৌতম আদানি-কে 'দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে বড় কর্পোরেট প্রতারক' হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে হিন্ডেনবার্গ ।
এদিকে, প্রতিবেদনে ব্যাপক কর্পোরেট অসাধুতার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা খণ্ডনে ৪১৩ পাতার একটি ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছেন গৌতম আদানি। উদ্দেশ্য একটাই, বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ দূর করা, যাতে তারা শেয়ার বিক্রির হিড়িক থামান।
কিন্তু, তার এ প্রচেষ্টাও কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। আস্থা ফেরাতে পারছেন না বিনিয়োগকারীদের। শেয়ারের বাজারমূল্য হারাতে থাকায় ও ডলার-ভিত্তিক বন্ডের ধসে তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য এখন খাড়া পতনের মুখে।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান গৌতম আদানি প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ সংগ্রহ করেছেন। গত ৩ বছরে তারা ১০০ বিলিয়নেরও বেশি আয় করেছে মূলত শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে। ৭টি মূল তালিকাভুক্ত কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির কাজটি করতো আদানি গ্রুপ।"
"এর আগে আরো চারটি বড় সরকারি জালিয়াতি তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আদানি গ্রুপ। মানি লন্ডারিং, করদাতার তহবিল চুরি এবং দুর্নীতির অভিযোগে পরিচালিত হয় এসব তদন্ত। সবমিলিয়ে আনুমানিক ১৭ বিলিয়ন ডলার জালিয়াতি নিয়ে এ তদন্তগুলো চলে," বলা হয় প্রতিবেদনে।
তাছাড়া, আদানি পরিবারের সদস্যরা করের স্বর্গক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত মরিশাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মতো জায়গায় অফশোর শেল কোম্পানি তৈরিতে সহযোগিতা করেছে বলেও উল্লেখ করে হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদন। জাল নথিপত্র দিয়ে এসব কাজ করা হয়েছে বলে দাবি হিন্ডেনবার্গের।
হিন্ডেনবার্গ বলে, "আমরা বিনোদ আদানি (গৌতম আদানির বড় ভাই) বা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী নিয়ন্ত্রিত মরিশাসের ৩৮টি শেল এনটিটি চিহ্নিত করেছি। সাইপ্রাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর এবং বেশ কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে গোপনে বিনোদ আদানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোও চিহ্নিত করেছি।"
মিডিয়াতে বিনোদ আদানিকে 'একজন অধরা ব্যক্তি' হিসেবে বর্ণনা করা হয় বলেও উল্লেখ করে হিন্ডেনবার্গ।