নিখোঁজ টাইটান সাব ভিডিও গেম কন্ট্রোলার দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে রবিবার (১৮ জুন) আটলান্টিক মহাসাগরে নিখোঁজ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওশানগেট এক্সপেডিশনস-এর পর্যটকবাহী সাবমার্সিবল 'টাইটান'। কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই সাবমার্সিবল একটি মডিয়ফায়েড ভিডিও গেম কন্ট্রোলার দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
এই মুহূর্তে ভ্যান-সাইজের এই ছোট সাবটি উদ্ধারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার একাধিক উদ্ধারকারী দল কাজ করছে। রবিবার অভিযান শুরুর এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পরে সাপোর্ট শিপের সাথে এই ডুবোযানটির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
'টাইটান' কি?
টাইটান হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র বেসরকারি মালিকানাধীন সাবমার্সিবল যা সমুদ্রের তলদেশে ৪০০০ মিটার গভীরে পর্যন্ত যেতে পারে।
যদিও ওশানগেট ২০১৫ সাল থেকে সাইক্লোপস নামক একটি সিস্টার সাবমার্সিবল পরিচালনা করে আসছে, কিন্তু 'টাইটান' বিশেষভাবে নির্মিত হয়েছিল পর্যটকদের টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
কোম্পানির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, টাইটানের ওজন প্রায় ২৩,০০০ পাউন্ড (১০,৪৩২ কেজি) এবং একটি অ্যারোস্পেস-স্ট্যান্ডার্ডের পাঁচ ইঞ্চি পুরু কার্বন ফাইবার কাঠামো রয়েছে যা দুটি গম্বুজসদৃশ টাইটানিয়াম এন্ড ক্যাপ দিয়ে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে।
সাগরের সবচেয়ে গভীরে যেতে সক্ষম মার্কিন সাবমেরিন 'ইউএসএস ডলফিন'-এর চাইতেও অনেক বেশি গভীরতায় যেতে সক্ষম 'টাইটান'। ইউএসএস ডলফিন একবার সাগরের তলদেশে ৯০০ মিটার পর্যন্ত গিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষে সাগরের তলদেশে ৩৮০০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত।
যদিও অনেকেই টাইটানকে সাবমেরিন হিসেবেই দেখছেন; কিন্তু ইউএস ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বলছে, সাবমেরিনের চাইতে সাবমার্সিবলের শক্তির মজুদ সীমিত থাকে। সাবমার্সিবল লঞ্চ করা ও অভিযান শেষে ফিরিয়ে আনার জন্য সহায়তাকারী জাহাজের দরকার হয়।
২০১৮ সালে টাইটানের সমুদ্রে ট্রায়াল দেওয়া শুরু হয়। ২০২১ সালে এটি প্রথম যাত্রা করে। গত বছর এটি ১০ বার সাগরের তলদেশে গিয়েছে, যদিও এর সবগুলো ট্রিপই টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে ছিল না।
লঞ্চিং ও রিকভারি প্ল্যাটফর্ম থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর সাবমার্সিবলে থাকা চারটি ইলেক্ট্রিক থ্রাস্টার (ইঞ্জিন) এটিকে ঘণ্টায় ৩.৪৫ মাইল বেগে চলতে সাহায্য করে।
ভেতরে কি কি আছে?
টাইটান সাবমার্সিবলের ভেতরটা এমনিতেই বেশ চাপা। এর আকৃতি ২২ ফুট X ৯.২ ফুট X ৮.৩ ফুট এবং এটি মাত্র পাঁচজনকে বহন করতে পারে। এর মধ্যে একজন থাকবেন পাইলট এবং বাকি চারজন যাত্রী।
এই সাবমার্সিবলের ভেতরে যাত্রীদের মেঝেতে বসতে হয় এবং নড়াচড়ার জন্য খুব বেশি জায়গা থাকে না। ডুবোযানের সামনে একটি বড় গম্বুজাকৃতির পোর্টহোলে ভিউয়িং পয়েন্ট আছে, যা কোম্পানির দাবি- 'গভীর সমুদ্রে যাত্রীবাহী সাবমার্সিবলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভিউপয়েন্ট।'
যেহেতু সমুদ্রের তলদেশে এতটা গভীরতায় প্রচন্ড ঠান্ডা অনুভব হতে পারে, তাই ডুবোযানটির দেয়ালও উষ্ণ তাপমাত্রায় রাখা হয়েছে। দেয়ালে লাগানো ল্যাম্পই ভেতরে আলোর একমাত্র উৎস।
যদিও অস্বাভাবিক, কিন্তু এই ডুবোযানের সামনের দিকে যাত্রীদের জন্য একটি ব্যক্তিগত টয়লেট রয়েছে। যখন এটি ব্যবহার করা হয়, একটা পর্দার মতো উঠে যায় এবং পাইলট কিছু মিউজিক ছেড়ে দেন।
তবে কোম্পানির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এ ধরনের অভিযানে আসার আগে থেকেই নিজের ডায়েট সীমাবদ্ধ করতে এবং পানির নিচে থাকার সময় যেন টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন কম পড়ে সেদিকে সচেতন থাকতে।
ডুবোযানটির বাইরের অংশে শক্তিশালী আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, এতে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাবে। বহির্সজ্জায় একাধিক ফোর কে ক্যামেরা সংযুক্ত রয়েছে এবং জাহাজের ম্যাপিং করতে বাইরের দিকে লেজার স্ক্যানার এবং সোনার রয়েছে। সেইসঙ্গে ভেতরে বিশাল ডিজিটাল স্ক্রিনেও টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ ভেসে উঠবে।
যাত্রা শুরুর পর 'টাইটান' নামক এই সাবমার্সিবলের ৯৬ ঘণ্টা চলার মতো অক্সিজেন মজুদ রয়েছে; কিন্তু এর মধ্যে থাকা ক্রুদের শ্বাসপ্রশ্বাসের হার অনুপাতে বোঝা যাবে যে অক্সিজেন কতক্ষণ চলবে।
ইন্টেরিয়রের বিষয়ে কোম্পানিটি বলছে যে, তারা 'অফ-দ্য-শেলফ-টেকনোলজি' ভিত্তিক অনেকগুলো অংশের সমন্বয়ে ইন্টেরিয়র তৈরি করেছে, যাতে করে নির্মাণকাজ আরও সহজ ও কার্যকরী হয়, যাতে ডুবোযানটি সহজে পরিচালনা এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন অংশ প্রতিস্থাপন করা যায়।
কিভাবে 'টাইটান'কে নিয়ন্ত্রণ করা হয়?
টাইটান সাগরের যতটা গভীরে যাবে, ঐ পর্যায়ে জিপিএস কাজ করবে না। তার বদলে একটি বিশেষ টেক্সট ম্যাসেজ সিস্টেমের মাধ্যমে ক্রুরা পানির ওপরে থাকা সাপোর্ট জাহাজ থেকে নির্দেশাবলি পেয়ে থাকেন। আর এই নির্দেশাবলীর উপর ভিত্তি করে এবং একটি মডিফায়েড ভিডিও গেম কন্ট্রোলারের সাহায্যে বাহনটি পরিচালনা করেন পাইলট।
গতবছর সিবিএস নিউজকে ওশানগেটের প্রতিষ্ঠাতা স্টকটন রাশ বলেছিলেন, এই ডুবোযানটি পরিচালনা করতে 'খুব বেশি দক্ষতার দরকার হয় না'।
সাগরের তলদেশে ধ্বংসাবশেষের কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসতে 'টাইটান'-এর আট ঘণ্টার মতো সময় লাগে বলে জানা গেছে। কিন্তু ২০১৮ সালে যখন সিবিএস এর সাংবাদিক ডেভিড পোগ টাইটান-এ করে ভ্রমণ করেছিলেন, তখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে এটি গভীর সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল এবং দুই ঘণ্টারও বেশি সময় পর আবার যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছিল।
কি ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে?
সমুদ্রের এত গভীরে অনেক ধরনের চাপ মোকাবিলা করতে হবে টাইটানকে। ওশানগেট এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, 'রিয়েল টাইমে' ডুবোযানটিকে পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। সাবমার্সিবলের কাঠামোয় কোন সমস্যা হয়েছে কিনা তা মূল্যায়ন করার জন্য এটি ডুব দেওয়ার সাথে সাথে সাবের উপর যে চাপ পড়ে, তার প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য সেন্সর রয়েছে।
পানির নিচে যাওয়ার আগে একটি সহায়তাকারী দল যাত্রীদের সাবমার্সিবলের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা টেনে ১৭টি বোল্ট দিয়ে আটকে দিবে।
তবে ওশানগেট বলছে, এটি একটি এক্সপেরিমেন্টাল ডুবোযান। যখন সিবিএস-এর সাংবাদিক টাইটানে করে ভ্রমণ করেছিলেন তখনো তাকে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল যে, "এই ডুবোযানটি কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত নয় এবং এটিতে ভ্রমণের ফলে যেকোনো ইনজুরি, মানসিক আঘাত থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।"
একটি প্রমোশনাল ভিডিওতে ওশানগেটের সফটওয়্যার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ অ্যারন নিউম্যান সম্ভাব্য গ্রাহকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, 'এই সাবমার্সিবলে চড়া কোনো ডিজনি রাইড নয়, তা আপনি জানেন। এর সঙ্গে অনেক ঝুকি ও চ্যালেঞ্জ জড়িয়ে আছে।'
কিন্তু ২০১৮ সালে সাবমার্সিবল বিশেষজ্ঞরা টাইটান নির্মাণের সময় ওশেনগেটের নেওয়া পরীক্ষামূলক পদ্ধতির বিষয়ে 'সমন্বিত উদ্বেগ' প্রকাশ করেছিলেন এবং এটির যে নকশা, তাতে সম্ভাব্য 'বিপর্যয়' এর বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন।
নিউইয়র্ক টাইমস মেরিন টেকনোলজি সোসাইটির স্টকটন রাশকে দেওয়া একটি চিঠি উন্মোচন করেছে। সেই চিঠিতে মেরিন টেকনোলজি সোসাইটি বলেছে, কোম্পানিটি এ ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত নিরাপত্তা মানের বাইরে গিয়ে, তাদের সাবমার্সিবলের ডিজাইন নিয়ে 'বিভ্রান্তিকর' তথ্য ছড়াচ্ছে।
ক্রুদের কি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল?
ওশানগেটের ওয়েবসাইটের পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, টাকা দিয়ে যারা 'টাইটান'-এ ভ্রমণ করবেন, তাদের আগে থেকে কোনো ডাইভিং অভিজ্ঞতা না থাকলেও চলবে। আর যদি কোনো প্রশিক্ষণ দরকার হয়, তাহলে ভ্রমণ শুরুর আগে অনলাইনে তা দেওয়া হবে।
ভ্রমণেচ্ছু গ্রাহকদের বয়স অবশ্যই কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। লম্বা সময় আবদ্ধ একটা জায়গায় বসে থাকতে এবং মই বেয়ে উঠতে সক্ষম হতে হবে।
ওশানগেট জানিয়েছে, সকল যাত্রীদের এই ভ্রমণ বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন সেশন নেওয়া হয় এবং নিরাপত্তা বিষয়ে ব্রিফিং করা হয়।
এরপরে কোম্পানি গ্রাহকদের বলে যে, 'আপনি নিজেই বেছে নিতে পারেন যে কিভাবে আপনি এই অভিযানের অংশ হতে পারে'। অর্থাৎ, কেউ চাইলে কমিউনিকেশস টিমের সাথেও কাজ করতে পারে, আবার কেউ চাইলে সরাসরি পাইলটের সাথে সাগরের নিচে যাত্রা করতে পারে।