অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী স্বভাবের ব্যক্তিদের সম্পর্কে ৪টি মিথ নিয়ে যা বলছে গবেষণা
প্রথমবার যখন ব্রিটিশ বিলিয়নিয়ার রিচার্ড ব্র্যানসনের সঙ্গে আমার দেখা হলো, তখন ধরেই নিয়েছিলাম যে তার ভাবভঙ্গি হবে সেই অ্যাডভেঞ্চারপাগল এক বিলিয়নিয়ারের মতোই, হয়তো তার চলন-বলনেই প্রকাশ পাবে রাজকীয় ভাব। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, এই ব্রিটিশ বিজনেস ম্যাগনেট একটু লাজুক প্রকৃতির, অন্তত প্রথম দেখায় তা-ই মনে হয়েছে।
তিনি প্রাণবন্ত, চিন্তাশীল এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও তিনি অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন, তবুও স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে যে রিচার্ড ব্র্যানসন একজন ইন্ট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। এতে অবশ্য আমি খুব অবাক হইনি; কারণ আপনি অন্তর্মুখী না বহির্মুখী স্বভাবের- এর সঙ্গে জনসমক্ষে আপনার কার্যকলাপের কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক, কর্মস্থলে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী স্বভাবের মানুষদের নিয়ে আরও কি কি মিথ বা ভুল ধারণা রয়েছে:
১. 'বহির্মুখী স্বভাবের মানুষেরা বাইরের জগত অন্বেষণে এবং রোমাঞ্চকর কাজ করতে বেশি আগ্রহী; অন্যদিকে অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষেরা আপন খেয়াল-খুশির ও চিন্তার জগতে ডুবে থাকতে পছন্দ করেন'
উল্লিখিত উক্তিটি এসেছে মায়ারস ব্রিগস থেকে, যেখানে মায়ার্স ব্রিগস টাইপ ইন্ডিকেটর (এমবিটিআই) পারসোনালিটি টেস্ট রেজাল্টে 'ই' এবং 'আই'- অর্থাৎ, অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী বিষয় দুটিকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বিজ্ঞান বলছে যে উল্লিখিত উক্তি বাস্তবে সবসময় প্রয়োগ ঘটে না। পারসোনালিটি অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ডিফারেন্সেস-এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তর্মুখী স্বভাবের লোকেরাও বহির্মুখীদের মতোই বাইরের মানুষের সঙ্গে একই রকম সময় কাটাতে এবং বিভিন্ন কাজে যুক্ত হতে আগ্রহী; এবং এই কাজের মাধ্যমে তারা বহির্মুখীদের মতোই সমান আনন্দ পায়।
পারসোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বহির্মুখী স্বভাবের মানুষেরা কথা বলা ও অন্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই শক্তি পায়, কিন্তু অন্তর্মুখীদের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটে। এমনকি দুই ধরনের মানুষেরাই জানিয়েছেন যে অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করলে তাদের মন আরও ফুরফুরে লাগে, তারা নতুন করে প্রাণশক্তি লাভ করেন- সেটা ব্যক্তিজীবনে হোক বা কর্মজীবনে।
তবে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী মানুষের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো বাইরের কর্মকাণ্ডের প্রতি তাদের সংবেদনশীলতা। যদি কেউ অন্তর্মুখী হয় তাহলে তাহলে তার হয়তো নিজেকে সঠিক ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে একটু সময় লাগতে পারে। আবার বহির্মুখী স্বভাবের মানুষদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের কখনোই নির্ঝঞ্ঝাট সময় দরকার হয় না নিজের জন্য, তাদের কাছে মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া, অনেক বেশি কাজে যুক্ত থাকা মানেই আনন্দ।
২. বহির্মুখী মানুষেরা অন্তর্মুখীদের চাইতে ভালো নেতৃত্ব দিতে পারে
না, এই ধারণাটিও সঠিক নয়। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, টিম ও কোম্পানির সার্বিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী মানুষের নেতৃত্বদানের ক্ষমতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে- যেমনটা অ্যাডাম গ্র্যান্ট বলেছেন, যেসব কর্মীরা নির্দেশনা চায়, বহির্মুখী স্বভাবের নেতারা তাদেরকে ভালো নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে পরিচালনা করতে পারেন। অন্যদিকে, অন্তর্মুখী স্বভাবের নেতারা সেই সকল কর্মীকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারেন- যারা কিনা নিজে থেকে উদ্যোগ নেয় এবং তত্ত্বাবধান ছাড়াই ভালো কাজ করতে পারেন।
কে অন্তর্মুখী আর কে বহির্মুখী তা মূখ্য নয়; বরং প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মীর চাহিদা বুঝে আচরণ করাই একজন নেতার গুণ। আপনি কেমন এবং কিভাবে কাজ করছেন, আর নিজে কি বিশ্বাস করছেন সেটাই হলো মূলকথা।
সিমোন সিনেক যেমনটা বলেছেন: ইতিহাসে এমন প্রচুর বিখ্যাত নেতা রয়েছেন যারা ছিলেন অন্তর্মুখী। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল ছিল, তা হলো- নিজে কি করতে চাইছেন তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস।
আপনার শক্তি কতখানি সেখানে ক্যারিশমা লুকিয়ে নেই, ক্যারিশমা লুকিয়ে আছে আপনি নিজের কাজের প্রতি কতটা নিবেদিতপ্রাণ। আর যদি তা উপলব্ধি করতে পারেন, তার মানে আপনার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
আপনি যদি অন্তর্মুখী হন তাহলে আপনার একটা শক্তি হলো, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, যার মাধ্যমে সুবিবেচক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। একইসঙ্গে নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও দৃঢ়সংকল্প দ্বারা নিজের লক্ষ্য ও সিদ্ধান্তকে সমর্থন করার ইচ্ছাও আপনার শক্তি হয়ে দাঁড়াবে।
৩. বিক্রয় খাতে বহির্মুখীরা বেশি দক্ষ
কোনো প্রতিষ্ঠানে বা ব্যক্তিগত কাজেও কোনো পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ধারণা করা হয় যে বহির্মুখী স্বভাবের লোকেদের পারফরম্যান্স ভালো। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সিলেকশন অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট- প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, সেলস পারফরম্যান্স এবং বহির্মুখী-অন্তর্মুখী স্বভাবের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।
তাহলে এক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে বিজয়ী কারা? অর্থাৎ কাদের পারফরম্যান্স ভালো? 'অ্যাম্বিভার্টদের'। অর্থাৎ, অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী স্বভাবের সংমিশ্রণ যাদের মধ্যে। তারা খুব সহজেই সম্ভাব্য ক্রেতাভেদে বা ব্যক্তিভেদে তাদের আলোচনার ধরন পরিবর্তন করতে পারে। সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণার লেখকদের মতে: অ্যাম্বিভার্টরা যেহেতু সহজাতভাবেই কথা বলা ও শোনার একটা নমনীয় প্যাটার্ন তৈরি করে ফেলে নিজের মধ্যে, তাই তারা কোনোকিছু বিক্রির জন্য কাউকে বুঝিয়ে রাজি করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দৃঢ়তা প্রকাশ করতে পারে; তবে তারা গ্রাহকের আগ্রহের জায়গা বুঝতে বেশি আগ্রহী থাকে এবং অতি-আত্মবিশ্বাসে ভোগে না।
একজন ভালো বিক্রেতা এবং একজন ভালো নেতা হওয়ার পেছন নিজের অন্তর্মুখী বা বহির্মুখী স্বভাব কমই ভূমিকা রাখে। এর চাইতে বরং কাজের সদিচ্ছা এবং অন্যদের চাহিদা বুঝে আচরণ করতে পারাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
৪. বহির্মুখী স্বভাবের মানুষেরা জনসমক্ষে কোনো পরিস্থিতিতে ভালো পারফর্ম করে
সামাজিক দক্ষতার সঙ্গে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের আশেপাশে প্রচুর অন্তর্মুখী ব্যক্তি আছে যারা মানুষের সঙ্গে বেশ ভাল কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে, আবার প্রচুর বহির্মুখী ব্যক্তি আছে যারা সামাজিক পরিস্থিতিতে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করে।
আবার পরিস্থিতিও অনেক ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। বহির্মুখী স্বভাবের অনেকেই গ্রুপে কথা বলতে বেশি পছন্দ করে, কিন্তু আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হয়। আবার অন্তর্মুখী অনেকেও আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন, কিন্তু দেখা যায় হাজার হাজার লোকের সামনে পারফর্ম করতে তাদের সমস্যা হয় না, যেমনটা ছিলেন মেতালিকার গিটারিস্ট কার্ক হ্যামেট।
আমি আমার জীবনে সবচেয়ে ভালো যেই মিটিংগুলোতে অংশগ্রহণ করেছি , সেগুলো পরিচালনা করেছেন একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি। তারা খুব চিৎকার করে কথা বলতেন না, বাচাল ছিলেন না কিংবা খুবই ক্যারিশমেটিকও ছিলেন না। কিন্তু যখন কথা বলতেন প্রতিটি পয়েন্ট ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যখন তিনি কথা শুনতেন তখন সত্যিই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।
কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি মনস্তাত্ত্বিকভাবে কিভাবে সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে তার উপর তার পারফরম্যান্স নির্ভর করে।
যদি আপনি লাজুক হন তাহলে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে মিটিং এ আসলে উপকার হবে। আর যদি খুব স্বতস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পছন্দ করেন, তাহলে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন যে আপনাকে আগে অন্যের কথা শুনতে হবে, যাতে অন্যরা বুঝতে পারে যে তাদেরকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।