তাপদাহ, যুদ্ধ ও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা: বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বাড়ছে
যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন – পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশ ও অঞ্চলে – প্রচণ্ড তাপদাহে বিপর্যস্ত কৃষি। শস্যক্ষেত, ফল বাগান, ডেইরি খামার – খাদ্য উৎপাদনের প্রায় প্রতিটি খাতই চাপের মধ্যে। চরম বিরূপ জলবায়ুই বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতি একমাত্র হুমকি নয়। চিরায়ত কিছু ভূরাজনৈতিক বাধাও ফিরে আসছে আবার।
যেমন চালের শীর্ষ রপ্তানিকারক ভারত, পণ্যটি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে – যা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য। স্থানীয় বাজারে মূল্য বৃদ্ধি রুখতেই এ পদক্ষেপ দিল্লির। এরমধ্যে ইউক্রেনের সাথে শস্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে রাশিয়া। ফলে নিরাপদে আর কৃষ্ণসাগরের পথে আসতে পারবে না ইউক্রেনীয় শস্যের চালান।
মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে এসেছে এল নিনো জলবায়ু পরিস্থিতি, যা কৃষির ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণে বাড়িয়ে তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা ঘিরে উদ্বেগ আরো ঘনিয়ে আসছে; ফলে খাদ্যের চড়া মূল্য, যা লাগামহীন মূল্যস্ফীতির অন্যতম নিয়ামক – হয়ে উঠতে পারে আরো স্থায়ী। আগের মূল্যস্ফীতির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই – নতুন এ আঘাতে, শনির দশা হবে সাধারণ ভোক্তা শ্রেণির। বিশ্বের অধিকাংশ প্রধান প্রধান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি যখন কিছুটা লাঘব হতে শুরু করেছিল, তখন গার্হস্থ্য ব্যয় কমে সুদিনের অপেক্ষায় করছিলেন আমজনতা। এখন আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, খাদ্যের অগ্নিমূল্য সহজে তাদের নিস্তার দেবে না।
লন্ডন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- চ্যাথাম হাউজের খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ টিম বেনটন বলেন, "বর্তমানে প্রায় সবাই মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে আছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি সূচক কিছুটা পড়তির দিকে আসলেও, তার মানে এই নয় যে সব পণ্যের দামও কমছে। এর অর্থ – দাম এখনও বাড়ছে, তবে আগের চেয়ে ধীর গতিতে।"
এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে চলা প্রচণ্ড তাপে ঝলসে গেছে মাঠের পর মাঠের ফসল। বিশ্বের কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য চলতি বছরটা চরম এক দুঃসময় হয়ে উঠছে। বৈরী জলবায়ুর খেয়ালখুশির সাথে লড়তে হচ্ছে তাদের। তবু কখনোবা দীর্ঘস্থায়ী খরা, কখনোবা অতিবৃষ্টির মতো প্রকৃতির রুদ্র রুপের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় থাকে না।
বর্তমানে গরমের প্রকোপ এতটাই যে, দক্ষিণ ইউরোপে গাভীরা কম দুধ দিচ্ছে। নষ্ট হয়ে গেছে, উপাদেয় টমেটোর ফলন। খরার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে যাওয়া ফসলের মাঠ থেকে এবছর গম, বার্লি, যবের মতো দানাদার শস্যও কম পাওয়া যাবে।
এশিয়ায় চীনের ধানক্ষেতগুলোর ফলন বিপন্ন; জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ফসল আবাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বৈরী। এরপর কিছুটা বৃষ্টি স্বস্তি আনে খরতাপে দগ্ধ মিডওয়েস্ট অঞ্চলে।
উৎপাদন ও সরবরাহের যখন বেহাল তারমধ্যে, আমদানিকারক দেশগুলো নতুন মজুত করতে শুরু করায় – এশিয়ায় চালের দাম দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে।
বৈরী আবহাওয়া কতদিন স্থায়ী হয় তার ওপর যদিওবা নির্ভর করবে ক্ষতির পরিমাণ, তবু এরমধ্যেই দক্ষিণ ইউরোপে ফল ও সবজির উৎপাদনে ব্যাপক ধবংসের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে - যে অঞ্চল থেকে ইউরোপের বাকি অংশ পণ্যগুলোর জোগান যায়।
ইতালির সিসিলিতে টমেটোগুলো ক্ষেতেই কালো বর্ণের বিকট রূপ নিয়েছে। এমনটা হয় অঙ্কুরে পচনের ফলে, বিশেষত যখন বৈরী আবহাওয়া টমেটো গাছে ক্যালসিয়ামের ঘাটতির কারণ হয়।
ইউরোপের একটি বৃহৎ খাদ্য পরিবেশক ও আমদানিকারক ব্র্যান্ড নাটুরার বৈশ্বিক জোগান শাখার প্রধান প্যাডি প্ল্যাঙ্কেটকে ক্ষেতের ছবি পাঠিয়েছিলেন সিসিলির এক চাষি। ছবি দেখে তার শিহরিত মন্তব্য, "টমেটোগুলো দেখে মনে হয়, তাদের নিচের অংশ পুড়ে গেছে। যা আমি আগে কখনই দেখিনি।"
স্থানীয় কৃষকদের একটি জোট কলডিরেত্তির তথ্যমতে, ইতালিজুড়ে চলতি বছর কৃষিখাতের ক্ষতি গত বছরের ৬ বিলিয়ন ইউরোর চেয়েও বেশি হবে।
আঙ্গুর, তরমুজ, নাশপাতি থেকে শুরু করে বেগুন – সব ধরনের ফসল তাপদাহে অপরিণত অবস্থায় দ্রুত পেকে নষ্ট হয়েছে। বাগানে মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকী গম শস্যের উৎপাদনও কমেছে বলে জানায় তারা।
কৃষি অর্থনীতিবিদ লরেঞ্জো বাজ্জানা বলেন, "এটি কোনো সাধারণ গ্রীষ্মকালীন খরতাপ নয়। অনেকে বলেন, উদ্ভিদের প্রজাতি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, কিন্তু এ ধরনের অভিযোজনে হাজারো বছর লেগে যায়। আর বর্তমান প্রজাতিগুলো সেভাবেই বিবর্তন করে আজকের পর্যায়ে এসেছে। ফলে এত দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে তারা খাপ খাওয়াতে পারছে না।"
ইউরোপের সবজি ফসলের কথা বাদ দিলে, আপাতত সুসংবাদ এটাই যে দানাদার শস্যের বাজার– যা খাদ্য আমদানি-নির্ভর দরিদ্র দেশগুলোর প্রধান সংগ্রহের উৎস – সেখানে এখনও পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। এর কৃতিত্ব ব্রাজিলে সয়াবিন ও ভুট্টার রেকর্ড ফলন। শীর্ষ গম উৎপাদক রাশিয়াতেও বাম্পার ফলনের আশা করা হচ্ছে।
তবু অনিশ্চয়তা বাড়ছেই। তারই প্রভাব পড়ছে বাজারে। কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য পরিবহন বন্ধের সংবাদে গেল সপ্তাহজুড়েই বিশ্ববাজারে গমের দাম ওঠানামা করেছে।
শস্য রপ্তানি চুক্তি থেকে রাশিয়া সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলে প্রথমে দাম বাড়ে। এরপর তা কমলেও, ইউক্রেনীয় বন্দরগামী জাহাজের ওপর রাশিয়া হামলার হুমকি দিলে, গমের দর ফের ঊর্ধ্বমুখী হয়। শুক্রবার ইউক্রেন শস্য রপ্তানি চুক্তি পুনরায় কার্যকরের আগ্রহ প্রকাশ করলে- তা আবারও কমে।
ভারতের সিদ্ধান্তের কারণেই অবশ্য শস্য বাজারে উদ্বেগ বেশি। দেশটি বাসমতি ছাড়া অন্যান্য ধরনের চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। স্থানীয় বাজারে দাম বাড়া যার প্রধান কারণ।
চলতি বছর দিল্লির বাজারে চালের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে, জাতীয় পর্যায়ে তা গড়ে ৯ শতাংশ বেড়েছে বলে ভারতের খাদ্য মন্ত্রণালয় জানায়। নোমুরা হোল্ডিং ইনকর্পোরেশন সতর্ক করেছে যে, দেশটির সরকার অন্যান্য ধরনের চাল রপ্তানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।
এশিয়ার অন্যত্র, চলতি বছর খরার ঝুঁকি থাকায় থাইল্যান্ডের সরকার কৃষকদের এবছর মাত্র এক মওসুম ধান আবাদের পরামর্শ দিচ্ছে। তাপদাহের কারণে চীনেও ধানশস্য আগাম পেকে যেতে পারে, এতে ফলন মারায়ত্মকভাবে কমবে। গত মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং শস্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৃহত্তর প্রচেষ্টার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানায় চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম।
একই রকমের চাপে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছরের শুরু থেকেই উষ্ণ ও শুস্ক আবহাওয়া পরিস্থিতি বিরাজ করে আমেরিকার শস্যঝুড়িখ্যাত মিডওয়েস্ট অঞ্চলে। এরপর বৃষ্টির সুবাদে কিছুটা উন্নতি হলেও, আগামী সপ্তাহজুড়ে আবহাওয়া আবার আগের অবস্থায় ফিরতে পারে। অথচ আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ভুট্টা ও সয়াবিন শস্যের দানা গঠনের ধাপ শুরু হয়। তাপদাহে যা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনএক্স সংস্থার পণ্যবাজার বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ আরলান সুডারম্যান।
চলতি বছর বসন্তকালীন দুরুম গমের ফলন ১৬ শতাংশ কমার পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ। এ মওসুমের অন্যান্য জাতের ফলন কমবে ১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা গম আবাদের জন্য বিখ্যাত। আগামী সপ্তাহে সেখানে শস্য পরিদর্শন শুরু হবে। প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতি কতোটা খারাপ – বাজার তখনই সেটা জানতেও পারবে।
পরিবহন সমস্যাও খাদ্য নিরাপত্তাকে অনিশ্চিত করে তুলছে। শস্য পরিবহনের অন্যতম প্রধান জলপথ মিসিসিপি ও ওহিও নদীর পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এতে প্রধান জলপথ দুটি দিয়ে শস্যের চালান ব্যাহত হবে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক - সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস) এর খাদ্য বিশেষজ্ঞ কাইলিন ওয়েলশ বলেন, "বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম গত এক বছর ধরে কমার পর, তা আবারো বাড়তে শুরু করলে আমি অবাক হব না। কৃষিবাজারগুলোয় একাধিক হুমকি লক্ষ করছি আমরা।"
ইউরোপ থেকেও শস্যবাজার সুসংবাদ পাচ্ছে না। খরার কারণে ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালে শস্য উৎপাদন গত বছরের চেয়েও ৬০ শতাংশ কম হবে। সার্বিকভাবে ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে শস্য ফলন হতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। এমনটাই জানিয়েছে, কৃষি বিষয়ক লবিস্ট ফার্ম – কোপা অ্যান্ড কোগেচা।
সার্বিক পরিস্থিতিকে 'চরম দুশ্চিন্তার' বলে অভিহিত করেছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ ব্যবসাগুলোর সঙ্গে কাজ করা সমবায় ব্যাংক কো-ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী টম হ্যালভার্সন বলেন, "(খাদ্য নিয়ে অনিশ্চয়তার বর্তমান অবস্থায়) মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতি থেকে দূর করা এত সহজ নয়, এতে আরও দীর্ঘসময় ও কঠোর অধ্যাবসায়ের দরকার হবে।"