নাসিরুদ্দিন? যে নামেই ডাকো, হাসির ঝরনাধারা
'একই অঙ্গে এত রূপ'—মান্না দের বিখ্যাত এ গানের আগে কেউ অমন মনমাতানো সুর শুনেছেন কি না, জোর দিয়ে বলতে পারব না। একইভাবে একই ব্যক্তিত্বের অনেক নামের কথাও বোধহয় কমই জানি আমরা। এ রকম এক ব্যক্তিত্ব হলেন আমাদের অনেককালের পরিচিত, হাসি-বন্ধু, নাসিরুদ্দিন হোজ্জা। নাসিরুদ্দিন হোক্কা, মোল্লা নাসিরুদ্দিন, নাসিরুদ্দিন খোজা, (দক্ষিণ এশিয়ায়) জুহা, নাসিরুদ্দিন এফেনদি কিংবা শুধু নাসিরুদ্দিন নাম নিলে বোঝানো হয় তাকেই। 'ভিনদেশী এক বীরবল' বলেও তাকে আখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক মোহাম্মদ নাসির আলী। তার অনূদিত হোজ্জার গল্প-সংকলনটির নামই 'ভিনদেশী এক বীরবল'।
গোলাপ যে নামেই ডাকো। তেমনি নাসিরুদ্দিন যে নামেই ডাকো, হাসির ঝরনাধারা, অনাবিল প্রবাহ। 'মিষ্টি হাসির দুষ্টামি' থেকে মশকরা, নির্মল রসিকতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এমনকি হো হো হাসি বা অট্টহাসিসহ হাসির সকল ধরনকেই পাওয়া যাবে তাকে নিয়ে গল্পগাথায়। এসব গল্পের কোনো কোনোটিতে দার্শনিক দৃষ্টির ছোঁয়াও মিলবে। কিংবা শিক্ষণীয় বিষয়ও থাকতে পারে তার কোনো কোনো গপ্পে। আর যা-ই হোক, সবকিছুকেই ছাপিয়ে থাকবে হাসির তরঙ্গমালা। হোজ্জার গল্পমালা 'ইরান-তুরান পার হয়ে' বাংলাদেশেই কেবল আসেনি বরং হাল আমলের পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই হাসির ধ্রুপদি উৎস হয়েই বিরাজ করছে। অবশ্য আদিতে বলকান থেকে চীন পর্যন্ত লোককাহিনিতে হোজ্জাকেন্দ্রিক গল্পগুলোর দেখা মিলত।
হোজ্জার নামের সাথে তুরস্কের শহর আকসেহির নাম অবিচ্ছেদ্যভাবেই জড়িয়ে রয়েছে। তিনি ১৩ শতকে ছিলেন বলেও নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মনে করা হয়। এই বিভিন্ন সূত্র বলেই নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে দার্শনিক, জ্ঞানী, আলেম (ধর্মবেত্তা), হাস্যরসের অধিকারী, সরস, তীক্ষèধী বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্বের কাতারে ফেলা হয়। তাঁর গল্পগুলো বিশ্বের প্রায় সব জায়গায়ই শোনা যাবে। তুর্কিভাষী বিশ্বের উপজাতিদের মধ্যে থেকে পারস্য, আরব, আফ্রিকা এবং রেশম সড়ক বা সিল্ক রোড ধরে চীন এবং ভারত, পরে ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্যই, প্রায় সাত শ বছরে ধরে এসব গল্প হোজ্জার নামে চলছে। কিন্তু সব গল্পের সাথে হোজ্জার সম্পর্ক হয়তো নেই। শুধু তা-ই না, অধিকাংশ গল্প বিশুদ্ধ তুর্কিও নয়। বরং মুসলিম এবং এশীয় সংস্কৃতির অন্যান্য মানুষের সম্মিলিত মশকরা, ঠাট্টা বা হাস্যরস, বোকামি কিংবা আহাম্মকীর অমোঘ ফসল। এ কথা অনেকেরই মনে আছে যে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দকে ইউনেসকো 'নাসিরুদ্দিন হোজ্জা বছর' হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। হোজ্জা যদি আজও বেঁচে থাকতেন, তবে তার বয়স হতো মাত্র ৮১৫-এর কাছাকাছি!
বীরবলের জীবন বৃত্তান্ত পাওয়া গেলেও 'ভিনদেশী এই বীরবলের' জীবনের কথা সঠিকভাবে আজও জানা সম্ভব হয়নি। তার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়ে অনেক কথাই চালাচালি হয়। কিন্তু সন্দেহাতীত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। ইতিহাসের দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে, ১৬ শতকের পর থেকে বিভিন্ন উৎস থেকে আসা জনপ্রিয় ঐতিহ্য, উপাখ্যান, কৌতুকগাথা, ঠাট্টা-মশকরাগুলোর স্ফটিকরণের সূত্র হয়ে সক্রিয় রয়েছে হোজ্জার নাম।
হোজ্জার নামে প্রচারিত গালগল্পের প্রথম দেখা মেলে ১৫ শতকের পুঁথি বা পাণ্ডুলিপিতে। ১৪৮০-এর এব'উল-খায়ের-ই রুমির 'সালতুক-নামে'তে প্রথম হোজ্জার নাম পাওয়া যায়। এই পুঁথির কাহিনিগুলো অনুসরণ করলে মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে দরবেশ রূপে দেখা যায়। আধুনিক তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমের আকসেহির শহরের সৈয়দ মাহমুদ হায়রানির অনুসারী ছিলেন হোজ্জা। হোজ্জাকেন্দ্রিক গল্প-কৌতুকের দেখা মিলবে তুর্কি ভাষায় লামি সিলবির (মৃত্যু ১৫৩১) গল্পের বই লেতা'ইফ'-এ। এতেও নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সঠিক পরিচয় সম্পর্কে কোনো ঐকমত্যের সুর পাওয়া যায় না। লামি সিলবি তার বইয়ে (১৪ শতকের ওসমানিয়া তুরস্কের কবি) সাইয়্যেদ হামজার সমসাময়িক হিসেবে তুলে ধরেন। দরবেশ মেহমুদ জিল্লি হিসেবে পরিচিত পরিব্রাজক এভলিয়া সেলেবির লেখায় নাসিরুদ্দিনের কথা এসেছে। ১৭ শতকে তিনি আকসেহিরে নাসিরুদ্দিনের সমাধিও পরিদর্শন করেন। তার রচনার ভিত্তিতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েন নাসিরুদ্দিন। তুর্কি ভাষা থেকে ইংরেজিতে হোজ্জার গল্পগুলো অনুবাদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে লেভান্টে (লেভান্ট শব্দটি ইংরেজিতে ব্যবহার শুরু হয় ১৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে। মূল অর্থ ছিল 'প্রাচ্য' বা 'ইতালির পূর্বে ভূমধ্যসাগরীয় ভূমি'। অনুমাননির্ভর এই ভৌগোলিক শব্দ দিয়ে পশ্চিম এশিয়ার পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটি বিশাল এলাকাকে বোঝানো হয়। অর্থাৎ ইসরায়েল, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ফোরাতের মধ্যবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিম তুর্কির গোটা অঞ্চল, এককথায় 'বৃহত্তর সিরিয়া'কে বোঝানো হয়।) ব্রিটিশ সাবেক কনসাল জেনারেল হেনরি ডি বার্নহাম, ডি এম জি। ১৯২৩-এ প্রথম প্রকাশিত বইটির নাম 'টেলস অব নাসের-ইড-দিন খোজা'। বইয়ের মুখবন্ধ থেকে জানতে পারি, ক্যামেরলোহার ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন হোজ্জার কাহিনি। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ইংরেজি ভাষায় হোজ্জার কাহিনি অনুবাদ করা হয়। জর্জ বরোর 'দ্য টার্কিশ জেস্টার, ওর দ্য প্লেজেনটারিস অব কজিয়া নাসের এদ্দিন এফেন্দি' নামের বইটি সীমিত আকারে, মাত্র দেড় শ বই, ছাপানো হয় সে সময়। স্বাভাবিকভাবেই সে বইয়ের রসাস্বাদন আম-ইংরেজি পাঠকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেদিক থেকে বার্নহামের বইকে বলা হয় হোজ্জা-কাহিনির প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি সংস্করণ। এতে আগ্রহী পাঠকদের জন্যই হোজ্জাকে তুলে ধরা হয়।
হোজ্জা বা খোজ্জা শব্দের অর্থ শিক্ষক। তার জন্ম বিষয়ক তুর্কি সূত্রের আরেকটি তথ্য: ১৪ শতকের মাঝামাঝি সময়ের পর তার জন্ম তুরস্কের আঙ্গোরা জেলার সিবরিহিসারের স্থানীয় অধিবাসী বলেই মনে করা হয়। অল্প বয়সে তাকে কোনিয়ার হানাফি মজহাবের ধর্মীয় বিদ্যালয় বা মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। এই মাদ্রাসায় সফলভাবে ফিকাহ শাস্ত্র পাঠ-সমাপ্তির বদৌলতে তিনি শিক্ষক বা ইমাম হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তিনি বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছেন বলে দাবি করা হয়। নাসিরুদ্দিন সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। তৎকালীন তুর্কি সমাজ কাঠামোর প্রেক্ষাপটে এমন শ্রেণিবিন্যাস ভুল হবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।
পরবর্তী শতাব্দীতে সিবরিহিসারের মুফতি হুসেইন এফেন্দি (মৃত্যু ১৮৮০) মেকমুয়া-ই মাআরিফ বইতে লেখেন, ওই এলাকার হোর্তু গ্রামে ১২০৮ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরুদ্দিন জন্ম নেন। পরে তিনি আকসেহির শহরে চলে আসেন এবং সেখানেই ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। কোনিয়াতে তিনি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির সাথেও সাক্ষাৎ করেন। রুমির কাছ থেকে সুফিবাদ শিক্ষা নেন। তবে সাইয়্যেদ হায়রানিকে নিজ ধর্মগুরু বা শেইখ হিসেবে অনুসরণ করতেন বলে দাবি করা হয়। নাসিরুদ্দিন বিয়েও করেন আকেসেহির শহরে। রসিকতা এবং হাস্যরসে ভরপুরে হাজির জবাব ও চৌকস মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সেখানকার সমাজের উল্লেখযোগ্য সদস্য হয়ে ওঠেন হোজ্জা।
আলাদা আলাদা দুটো ওয়াকফ-নামাতে ১৩ শতকের মাঝামাঝি কোনিয়াতে নাসিরুদ্দিন ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। এর একটি হলো ১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সাইয়্যেদ মেহমুদ হারিয়ানির। অন্যটি হলো ১২৬৬ থেকে ৬৭ খ্রিষ্টাব্দের হাজ ইব্রাহিম সুলতানের।
কিন্তু তারপরও তাকে নিয়ে চলমান বিতর্কের এখনো হয়নি 'তামাম শোধ'। নিশ্চিত করে বলা যায়, ১৩ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আনাতোলিয়ায় ছিলেন নাসিরুদ্দিন। জন্ম হয়েছে হোর্তু গ্রামে। পরে তিনি সিবারিহিসার অঞ্চল ছেড়ে কোনিয়ার কাছাকাছি আকসেহিরে থিতু হন। সেখানেই ইহলোক ত্যাগ করেন। এ শহরের রয়েছে তার মাজার। তার মাজার দেখতে গেলে চট করে ধাঁধায় পড়তে হবে। মাজারের সামনেই লোহার বিশাল ফটকে ঝুলছে অতিকায় তালা। না, ফিরে যেতে হবে না। মাজারকে ঘিরে কোনো প্রাচীর নেই। সরাসরি ঢোকা না গেলেও পাশ কাটিয়ে তার মাজারে ঢোকা যাবে। মুজতবা আলীর বর্ণনায় এ মাজারের কথা এসেছে। এর মধ্য দিয়ে হয়তো চূড়ান্ত রসিকতাও করে গেছেন হোজ্জা। জীবনটি ওই তালা দেওয়া বিশাল ফটকের মতোই। মৃত্যু আসবেই। ফটকের কোনো পাল্লা খোলার দরকার পড়বে না। পাশ কাটিয়েই ঢুকে আমাদের জীবনকে অনন্তের পথে নিয়ে যাবে!
নাসিরুদ্দিনের জীবন নিয়ে আরেকটি উল্লেখ রয়েছে: মাওলানা রুমির গোরস্তানে একটি সমাধিফলকে নাসিরুদ্দিনের কন্যা ফাতিমার নাম এবং পরিচয় উল্লেখ করা আছে। ফাতিমা পরলোকগমন করেন ১৩২৬ খ্রিষ্টাব্দে। অনেকেই মনে করেন, ১৩ শতকে কোনিয়াতে নাসিরুদ্দিন বসবাস করতেন, তার আলামত হয়ে আছে এ সমাধিফলক।
অন্যদিকে তৈমুর লং বা খোড়া তৈমুরের দরবারের বিদূষক হয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন। আবার ইমামতিও করতেন। কিন্তু চাটুকার ছিলেন না। 'টেলস অব নাসের-ইড-দিন খোজা' বইয়ের মুখবন্ধে হোজ্জার সাহসিকতার কাহিনি শোনান ব্রিটিশ সাংবাদিক, বিশিষ্ট লেখক, ইতিহাসবিদ এবং কূটনীতিবিদ স্যার ইগনাশিয়াস ভ্যালেন্টাইন চিরোল (২৮ মে ১৮৫২-২২ অক্টোবর ১৯২৯)। তৈমুর ব্যক্তিগত জীবনে সময়নিষ্ঠ নামাজি ছিলেন। আজান হলেই হোজ্জার ইমামতিতে নামাজ পড়তে দেরি করতেন না।
কথায় কথায়, কিয়ামতের দিনে তার বরাতে কী ঘটতে পারে, সে কথা হোজ্জার কাছে জানতে চান তৈমুর। হোজ্জা অসীম সাহসী জবাব দেন, মহামান্য সম্রাটের এ নিয়ে দুঃচিন্তার কোনো দরকারই নেই। চেঙ্গিস খান ও হালাকু সরাসরি জাহান্নামের সম্মানীয় আসনে বসে আছেন, সেখানেই সম্রাট তৈমুরের জন্যও নিঃসন্দেহে আসন সুনির্ধারিত হয়ে আছে।
চিরোল জানান, এমন জবাব দেওয়ার প্রায় পাঁচ শ বছর পর খলিফা আবদুল হামিদ পাশার সময় তুরস্কের রাজদরবার থেকে ব্রাত্য হতে হলো হোজ্জাকে। হোজ্জাকে নিয়ে সাহসী সব গল্প বলার মধ্য দিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে তারই শাসনের প্রতি বিদ্রƒপ করা হয় কি না, ভেবে এমন নিষেধাজ্ঞার ভারী জোয়াল চাপিয়ে দেওয়া হয়। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে 'তরুণ তুর্কি'দের বিপ্লবের পর এ ব্রাত্য অবস্থার অবসান ঘটে।
নাসিরুদ্দিন হোজ্জার উপাখ্যানের প্রথম দিকের পাণ্ডুলিপিতে গল্পসংখ্যা কম ছিল। আকারে ছোট ছিল। পরবর্তী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যেসব পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছে, সেগুলোর কলেবর বেড়েছে ক্রমাগত। উত্তর-পশ্চিম এবং মধ্য-এশিয়াটিক তুর্কি ভাষায় মুদ্রিত সংগ্রহগুলো বেশির ভাগই প্রথম তাতার ভাষায় প্রকাশিত পুঁথি থেকে নেওয়া। উসমানিয়ার তুর্কিদের সূত্র থেকে পাওয়া কাহিনিগুলো প্রায় অভিন্ন ছিল। ১৫ শতকের পর থেকে নাসরুদ্দিনের গল্পগুলো সংগ্রহের কাজের সূচনা হয়। প্রথম ছাপা হয় ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্তাম্বুলের মাতবা-ই আমিরে (রয়্যাল প্রিন্টিং হাউস) লেতাইফ-ই হাসে নাসরুদ্দিন (খোজ্জা নাসরুদ্দিনের আনন্দদায়ক গল্প) শিরোনামে।
নাসিরুদ্দিনের প্রথম চিত্রটি আঁকা হয় ১৭ শতকের এক পাণ্ডুলিপিতে। পাণ্ডুলিপিটি দেখতে চাইলে আপানাকে তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘর গ্রন্থাগারে ঢুকতে হবে। মূলত এটি ক্ষুদ্রাকৃতি বা মিনিয়েচার চিত্রকর্ম। ছবিতে দেখতে পাবেন, মোল্লা নাসিরুদ্দিন বসে আছেন গাধার পিঠে।
তুর্কি ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ধীরে ধীরে গোটা উসমানিয়া সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে নাসিরুদ্দিনের গালগপ্পগুলো। নাসিরুদ্দিনের সাথে যোগ হতে থাকে অন্যান্য চরিত্রের ঘটনাগুলোও। আরবি ও ফারসি লোককাহিনিতে সুপরিচিত হয়ে ওঠে নাসিরুদ্দিনের নাম। তার গল্পগুলো আলবেনীয়, আরবি, আজেরি, বাংলা, বসনীয়, হিন্দি, পশতু, ফারসি, সার্বিয়ান এবং উর্দু লোকজ ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠে। ক্রোয়েশীয় এবং ককেশীয় এমনকি চীনা ভাষায়ও একই নামে এসব গল্প পরিচিতি পায়। গোটা ইউরোপও জয় করে। 'হেলায় বিশ্ব করিল জয়'—ভিন্নতর প্রসঙ্গের কথাটি এখানে যথাযথ হয়ে উঠল।
২. মোল্লা নাসিরুদ্দিনের শিক্ষাজীবনের দুটি কাহিনি প্রথমেই তুলে ধরছি:
ওস্তাদের কথা শুনছে না শিশু নাসিরুদ্দিন। ঝিমুচ্ছে। ওস্তাদ দেখে রেগে গেলেন।—নাসির তোমার তো বাপু পড়ায় মন নেই। ঘুমিয়ে পড়েছ, না কেবল ঝিমুচ্ছ।
দ্রুতই জবাব এল—না ওস্তাদ। আমি জেগে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছি।
*
অবিরাম কথক ছিল নাসিরুদ্দিন। ওস্তাদের কথায় কান না দিয়ে চলছে তার বকবকানি। ওস্তাদ খেপে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, নাসিরুদ্দিন তুমি আমার কথায় মনোযোগ দিচ্ছ না। এমন একদিন আসবে, মানুষ তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। তুমি একজন বিদূষক হবে। ভাঁড় বনবে। এমনকি তারা তোমাকে নিয়ে গালগপ্প করবে। একটি-দুটি নয়। সব সময় তোমাকে নিয়ে অন্তত সাতটি চাপা মারবে।
*
কম বয়স থেকেই গতরে খাটতে হয়েছে নাসিরুদ্দিনকে। কিশোর বয়সে এক গুদামে বস্তা টানার কাজও করেছে। সেখানে শ্রমিকেরা একবারে তিনটি করে বস্তা ঘাড়ে চাপিয়ে একটু দূরে জড়ো করে রাখছিল। কিন্তু নাসিরুদ্দিন অমন কাজের ধারেকাছেও গেল না। প্রতিবার সে বইতে থাকল মাত্র একটা করে বস্তা। বিষয়টা তদারকির দায়িত্ব থাকা ব্যক্তির শ্যেন নজর এড়াল না। একটা করে বস্তা নিচ্ছে এবং কাজে কেন ফাঁকি দিচ্ছে কর্কশ গলায় জানতে চাইল সে।
জবাব পেল, হুজুর ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। তিন বস্তা নিতে আমাকে তিনবার আসা-যাওয়া করতে হয়। ফাঁকিবাজের দল এই তিনবার আসা-যাওয়া করে গতর খাটাতে চায় না। তাই একবারে তিনটা করে ছালা ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে।
*
শহরের মধ্যে প্রধান চত্বর দিয়ে নাসিরুদ্দিন গাধায় করে চলছে। সাথে রয়েছে তার বন্ধু। হঠাৎ দুষ্ট বুদ্ধি ঝিলিক দিল নাসিরের মাথায়। বন্ধুকে বলল। মজা করার জন্য তারা দুজনে মিলে চিৎকার জুড়ল, সোনা! সোনা!! সোনা!!! পাশের জঙ্গলে সোনা পেয়েছি।
আর যায় কোথায়। অমনি সব মানুষ দে ছুট। প্রাণপণে দৌড় দিল জঙ্গলের দিকে। মূর্হূতেই শহর ফাঁকা। এবারে দেখা গেল হোজ্জাও তার গাধাকে তাড়িয়ে নিয়ে প্রায় জান বাজি রেখে ছোটাচ্ছে! বন্ধু বেকুব বনে গেল। 'আরে হোজ্জা করছ কী? পাগল হলে নাকি?'
হোজ্জার জবাব শোনার জন্য বন্ধুকে তাল রেখে তাকেও ছোটাতে হচ্ছে গাধা। ছুটন্ত হোজ্জা বলল, দেখো সব মানুষ সোনার খোঁজে জঙ্গলে গেছে। হয়তো সোনা থাকতে পারে। তা-ই ছুটছি।
—আরে বাবা তুমি না মজা করলা।
—হ্যাঁ, তা করেছি। কিন্তু এত মানুষ যখন কথাটা বিশ্বাস করল, তখন হয়তো সত্যি সত্যিই সোনা থাকতে পারে। বলতে বলতে গাধার গতি বাড়ানোর জন্য আরও চেষ্টা করতে লাগল হোজ্জা। চিৎকার করে বলতে লাগল, সোনা! সোনা!! সোনা!!! আছে জঙ্গলে!
*
রাস্তার পাশে নাসিরুদ্দিন একটা দোকান দিয়েছে। বড় বড় করে লেখা—'যেকোনো বিষয়ে দুটো প্রশ্নের জবাব দেওয়া হবে। এ জন্য দিতে হবে এক হাজার টাকা। প্রশ্ন করার আগে টাকা জমা দিতে হবে।' একজন দুটো প্রশ্ন ঠিক করে এল নাসিরুদ্দিনের দোকানে। এক হাজার টাকা আগে দিল। তারপর বলল, ভাই দামটা চড়া একটু কমানো যায় কি?
—না। গম্ভীরভাবে জবাব দিল। তারপর টাকা ক্যাশবাক্সে রাখতে রাখতে বলল, 'হ্যাঁ, এবার বলো তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন কী?'
*
লাশের খাট নিয়ে যাওয়ার সময় কোথায় দাঁড়ানো ঠিক হবে? সামনে, পেছনে, ডাইনে না বায়ে—একজন নাসিরুদ্দিনের কাছে জানতে চাইল। জবাব পেল, 'সামনে-পিছে, ডান-বাম কোনোটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেবল খেয়াল রেখো, তুমি শুধু খাটের ওপর শোয়া থেকো না!'
*
গাধা হারিয়ে গেছে, তারপরও বেশ খোশ মেজাজে রয়েছে নাসিরুদ্দিন। এক বন্ধু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল—গাধা হারানোর পরও এত ফুর্তিতে কেন তুমি?
—বড় বালা থেকে বাঁচলাম কি না, তা-ই।
—মানে?
—সহজ কথাটা বুঝতে পারছ না, তাহলে শোনো, ভাগ্যিস গাধার পিঠে আমি ছিলাম না। নইলে তো আমিসহই হারিয়ে যেতাম। জবাব দিল হোজ্জা।
*
শহরে নতুন বিচারক দরকার। শহর পরিষদের সদস্যরা যোগ্য লোকের খোঁজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। সে সময় দেখা গেল, জাল কাঁধে বিনীত ভঙ্গিতে যাচ্ছেন নাসিরুদ্দিন। সদস্যরা অবাক হলো। জাল কাঁধে কেন ঘুরছে নাসিরুদ্দিন? জানতে চাইল। জবাবে নাসিরুদ্দিন বলল, আমি গরিব মানুষের কাতার থেকে উঠে এসেছি। সে কথা মনে রাখার জন্য এই জাল নিয়ে ঘুরছি।
এমন বিনয়ী মানুষই ভালো বিচারক হবে—ভাবল সদস্যরা। নাসিরুদ্দিন শহরের বিচারক হলো। বছরখানেক পর পরিষদ সদস্যরা নাসিরুদ্দিনকে দেখতে গেল। এবারে তার কাঁধে কোনো জাল নেই।
—বাহ! জাল নেই কেন? অবাক হয়ে জানতে চাইল তারা।
—বাহ! জাল থাকবে কেন? মাছ ধরার পর জালের আর দরকার আছে কি? পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল নাসিরুদ্দিন।
*
নাসিরুদ্দিন তার বেগমকে সোহাগ করে নানা নামে ডাকত।
আমার হিরের টুকরা।
আমার কলিজ।
আমার জান।
আমার আত্মা
ইত্যাদি, ইত্যাদি।
তবে বেশির ভাগ সময়ই বলত,
আমার প্রাণ।
একরাতে নাসিরুদ্দিন স্বপ্নে দেখে আজরাইল এসেছে।
হোজ্জাকে বলছে, তোমার প্রাণ নিতে এসেছি।
নাসিরুদ্দিন তার পাশে ঘুমে অচেতন বেগমকে দেখিয়ে বলল,
—ওই যে আমার প্রাণ। ঘুমাচ্ছে। তাকে কি ডেকে তুলব?
*
নিজের কবর পাকা করাচ্ছে মোল্লা নাসিরুদ্দিন। এখানে এ কাজ করো, সেখানে সে কাজটি করো। এভাবে খুঁটিনাটি নিদের্শ দিচ্ছে। আর রাজমিস্ত্রি দ্রুত তা করছে। কাজ শেষে নাসিরুদ্দিনের কাছে এসে দাঁড়াল।
—সারা দিন খাটছি, এখন মজুরিটা দিয়ে দিলে চলে যেতে পারি।
—কাজ শেষ না হলে মজুরি দিই কি করে?
রাজমিস্ত্রি অবাক হলে বলল—আর কোন কাজ বাকি?
—আরে বাবা, আসল কাজই তো বাকি। লাশ ছাড়া কবর হয় নাকি। কবরের মধ্যে লাশ কই যে তোমাকে মজুরি দেব!
*
বলা হয়, নাসিরুদ্দিন হোজ্জার কবরফলকে দুটো বাক্যই খালি লেখা আছে,
চলতে থাকো।
চলাই ভালো।