যেভাবে নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রস্তাব থেকে বাদ পড়ে গেল
চলমান ইসরাইল ও হামাসের মধ্যেকার যুদ্ধে মানবিক বিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গতকাল (শুক্রবার) একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। যেখানে একইসাথে গাজায় সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, আলোচনার পথ উন্মুক্ত করা ও যুদ্ধের টেকসই সমাপ্তির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়েছে।
রেজুলেশনে 'সম্পূর্ণ, দ্রুত, নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক দিনের জন্য সমগ্র গাজা উপত্যকায় জরুরী মানবিক বিরতির' আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে মূল যে যুদ্ধবিরতির দাবি, সেটি যেন আড়ালেই থেকে গেছে।
যদিও নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের বেশিরভাগ সদস্যই যুদ্ধবিরতি চেয়েছিল। সেক্ষেত্রে মানবিক বিরতি নয়, প্রথমে এই রেজুলেশনের ভাষা ছিল 'বিরোধ অবিলম্বে বন্ধ' করা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্রমাগত বিরোধিতায় সেটি সংশোধন করেই পাশ করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে রেজুলেশনে স্থায়ী সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ভোট প্রদান থেকে বিরত থেকেছে। দেশ দুটির একটিও যদি ভেটো প্রদান করতো তবে রেজুলেশনটি পাশ হতো না।
এদিকে মার্কিন দূত লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড অবশ্য রেজুলেশনটির প্রশংসা করেছে। কিন্তু এতে হামাসকে নিন্দা করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না থাকায় এটির পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে দেশটি।
মার্কিন একজন সিনিয়র কূটনৈতিক বলেন, "আমরা হামাসকে নিন্দা করার বিষয়টি রেজুলেশনে দেখতে চেয়েছিলাম। আমরা বুঝতে পারছি না কেন কাউন্সিল নিজেদের অবস্থান ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। কিন্তু দিনশেষে কূটনীতি বলতে এটাই বোঝায়।"
এর আগে যখন নিরাপত্তা পরিষদে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে রেজুলেশন আনা হয়েছিল তখন যুক্তরাষ্ট্র সেটিতে ভেটো দিয়েছিল। এতে করে বৈশ্বিকভাবে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল দেশটি।
ঐ কূটনীতিক বলেন, "দিনশেষে সকলেই স্থায়ীভাবে বিরোধ বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছে। এতে আমি মনে করি গত কয়েক সপ্তাহের বড় বিতর্কটি ছিল যে, 'বিরোধ বন্ধ করার এখনই কি সঠিক সময়? না-কি শর্তগুলো সঠিক হওয়া দরকার?' আমরা এই ধারণাটি নিয়ে পরিস্কার ছিলাম যে, শর্তগুলো সঠিক হওয়া দরকার।"
সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, খসড়াটির একটি প্রধান পয়েন্ট ছিল 'জাতিসংঘের মহাসচিবের কর্তৃত্বের অধীনে প্রয়োজনীয় কর্মী ও সরঞ্জামসহ গাজায় একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার' আহ্বান জানানো।
এই বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তি ছিল, গাজা উপত্যকায় ত্রাণ পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের তৈরি একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার প্রস্তাব বাস্তবায়ন কষ্টকর হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা সরবরাহের গতি কমিয়ে দেবে।
আর মার্কিন সিনিয়র কূটনীতিক মনে করেন যে, যুদ্ধের সময় গাজার অভ্যন্তরে একটি নতুন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা স্থাপণের প্রাথমিক ধারণাটি ছিল 'সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর'।
ঐ কূটনীতিক বলেন, "জাতিসংঘ আমাদের দ্বিপাক্ষিকভাবে বলেছে যে, তারা এমনটা করতে পারে না। আর আমাদের মূল্যায়ন ছিল যে, সাহায্যের জন্য বিদ্যমান কোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। সুতরাং এটি মূলত একেবারে নতুন, সম্পূর্ণরূপে অনুলিপিমূলক প্রক্রিয়ার উপর তৈরি করা হচ্ছে যা ইতিমধ্যেই রয়েছে। তাই নতুন করে এই উদ্যোগ সম্ভবত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং সবকিছুকে ধীর করে দেবে।"
রেজুলেশনটির সর্বশেষ ভাষার বর্ণনা করতে যেয়ে কর্মকর্তা বলেছেন, কূটনীতিকরা আরব আমিরাতের খসড়া প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করার জন্য কাজ করছিলেন। এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানান, খসড়াটি বিরোধ 'জরুরি বন্ধ' করার আহ্বান জানিয়ে শুরু হয়েছিল। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কেউই বর্তমানে যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন করে না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও পরোক্ষ ফর্মুলেশন দিয়ে এর পাল্টা জবাব দিয়েছে।
এদিকে রাশিয়ার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে ভোটের ঠিক আগে কাউন্সিলের সামনে রেজুলেশনের অস্পষ্টতার বিষয়টি সামনে এনে একটি সংশোধনী পেশ করা হয়েছিল। যেখানে খসড়ার ভাষাটিকে শুরুর যে ভাষা অর্থাৎ 'বিরোধের অবিলম্বে সমাপ্তি' এ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। তবে এতে ভেটো প্রদান করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ভোটের বিষয়ে ইসরায়েলি এক কর্মকতা সিএনএন-কে বলেন, "প্রস্তাবিত রেজুলেশনে সবচেয়ে সমস্যাযুক্ত উপাদানগুলিকে সমাধানে মার্কিন প্রচেষ্টার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তারা সত্যিই কঠোর পরিশ্রম করেছে এবং আমরা সত্যিই তাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করি।"
ঐ কর্মকর্তা আরও বলেন, "আমাদের দৃষ্টিতে রেজুলেশনটি অপ্রয়োজনীয় এবং সংঘাতে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে অক্ষমতার দিকটি প্রকাশ করে। ৭ অক্টোবরের গণহত্যার প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেলেও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে তার নিন্দা করা হয়নি।"
থমাস গ্রিনফিল্ড গত বৃহস্পতিবার দেরীতে হলেও ঘোষণা করেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রেজুলেশনে ভোট বিলম্ব করার জন্য চারবার ভোট দেওয়ার পর এবার এই রেজুলেশনটিকে সমর্থন করবে। তবে শেষ পর্যন্ত এর পক্ষে ভোট দেওয়ার পরিবর্তে বরং দেশটি বরং ভোট প্রদান থেকে বিরত ছিল।
ঐ কূটনৈতিক বলেন, "আমাদের কিছু মূল অবস্থান রয়েছে। যার মধ্যে আমরা মনে করি কাউন্সিলকে স্পষ্টভাবে বলা যে, হামাস এই সংঘাত শুরু করার জন্য দায়ী।"
মার্কিন কূটনীতিক বলেন, এই রেজুলেশনটি এমন কয়েকটি জিনিস করেছে যা অতীতের রেজুলেশনটি করেনি। এটি সন্ত্রাসবাদের সমস্ত কাজকে নিন্দা করেছে৷ এটি স্পষ্টতই হামাস যেসব কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী সেটা বলছে। যদিও এটি প্রত্যক্ষভাবে নাম নিচ্ছে না।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি গতকাল (বৃহস্পতিবার) বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার জাতীয় নিরাপত্তা দলের সদস্য এবং যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তাদের সাথে রেজুলেশনকে ঘিরে আলোচনায় ও যোগাযোগ করেছেন।
রেজুলেশনটি ঠিক এমন সময়ে আসছে যখন বাইডেন প্রশাসন গাজার যুদ্ধ কতটা নৃশংস ছিল তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশে আরও সোচ্চার হয়েছে। যদিও আগে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিয়েছে এবং সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির আহ্বানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে।