বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পের গতি বাড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হলো অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চ-পর্যায়ের কমিটি উন্নয়ন তহবিল ছাড়ে গতি বাড়াতে এবং বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্পগুলোর যথাসময়ে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিবকে নির্দেশনা দিয়েছে।
আমদানিকারকদের মার্কিন ডলারের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাওয়ার এ সময়ে এমন পদক্ষেপ নিল সরকার। বর্তমানে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি তহবিল নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বা পাইপলাইনে রয়েছে যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় আড়াই গুণের সমান।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, বুধবার (৬ মার্চ) বিদেশি অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে গঠিত কমিটির প্রথম বৈঠকে এ আদেশ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জেল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিদেশি অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পের জন্য তহবিল ছাড় ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও এ সম্পর্কিত নির্দেশিকা আলোচনা করা হয়।
সভায় পরিকল্পনা ও অর্থ বিভাগ, ইআরডি, এবং বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিবেরা বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
পরিকল্পনা কমিশন এবং ইআরডি কর্মকর্তারা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বারবার সম্মতির প্রয়োজন হয়। কোনো কোনো নথিতে সম্মতি আদায়ে ছয় মাস থেকে এক বছরও সময় পার হয়ে যায়।
উন্নয়ন অংশীদারদের সম্মতি জটিলতার কারণে কিছু প্রকল্পের অনুমোদিত পাঁচবছরের মেয়াদও শেষ হয়ে যাওয়ার উদাহরণও রয়েছে। এটি বৈদেশিক অর্থনৈতিক প্রকল্পে অর্থছাড় না হওয়ার বা ধীরগতিতে অর্থছাড়ের অন্যতম প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেন কর্মকর্তারা।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা–খুলনা ও খুলনা–চিলাহাটি করিডোরে সক্ষমতা বাড়াতে খুলনা–দর্শনা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মালামাল পরিবহনের জন্য ব্রডগেজ কনটেইনার চালু করার লক্ষ্যে মোট ১২৬ দশমিক ২৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে।
এ প্রকল্পে ভারত ৩১২ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্ত গত নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ছাড় হয়েছে কেবল তিন লাখ ২০ হাজার ডলার।
প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম ফিরোজী বলেন, প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত প্রস্তাব অনুযায়ী ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। 'তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রক্রিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে বিলম্বিত হয়েছে। ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের নথির জন্য কেবল ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি আদায়ে সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় লেগেছে,' বলেন তিনি।
আবার এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) মতো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর বাংলাদেশে কোনো অফিস নেই। সেক্ষেত্রে সম্মতি আদায়ে আরও বেশি বিলম্ব হয়।
গত নভেম্বরে ইআরডি'র একটি প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, এআইআইবি-এর আঞ্চলিক অফিস না থাকার কারণে প্রকল্পের তহবিল ছাড়ে বেশি সময় লাগে।
এসব জটিলতায় কারণে এআইআইবি'র অর্থায়নে ১৩টি প্রকল্প ধীরগতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্পে ২.০৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে এআইআইবি। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থছাড় হয়েছিল মাত্র ২২ শতাংশ বা ৪৫৮.৪৫ মিলিয়ন ডলার।
ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং চীনসহ প্রায় সব উন্নয়ন অংশীদারের ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি এমন।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রোগ্রামিং বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নুরুন নাহার বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের পরপরই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে ইআরডি সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া অর্থবছরের শুরুতে সঠিক কর্ম পরিকল্পনা থাকা উচিত। সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকা যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে অনলাইনে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, অর্থছাড় দ্রুত করতে ইআরডির মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
'এ বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য হলো বাজেটে বৈদেশিক সাহায্য খাত থেকে দেওয়া বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা। ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা না হলে আমাদের উন্নয়নও হবে না, আবার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব,' বলেন তিনি।
বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার সংক্রান্ত বেশকিছু চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বিদেশি ঋণ সময়মতো ব্যবহার করা যায় না।
বৈঠকে উপস্থিত সূত্রে জানা গেছে, আগামী দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
গত ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটি গঠন করা হয়।
সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের ওপেনিং পাইপলাইনের আকার ছিল ৪৩.৮৩৬ বিলিয়ন ডলার। এ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ৪.৩৯৮ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সহায়তা ছাড় করা হয়েছে, যা পাইপলাইনে থাকা তহবিলের মাত্র ১০ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৯৪ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের লক্ষ্য ছিল। জানুয়ারি পযন্ত বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দের মাত্র ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। ২০২২–২৩ এবং ২০২১–২২ অর্থবছরের জুলাই–জানুয়ারি মাসে বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দের ব্যবহার ছিল যথাক্রমে ৩৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ৩৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ কমিয়ে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।