বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পে গতি আনার উদ্যোগ সরকারের
জরুরি ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন বাংলাদেশের। এদিকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি পাইপলাইনে আটকে রয়েছে। দেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের চেয়েও আড়াই গুণ বেশি–- এই অর্থের বেশিরভাগটাই ছাড় হচ্ছে না প্রকল্প বাস্তবায়নে নানান চ্যালেঞ্জের কারণে।
এই অবস্থায়, উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে দ্রুত ঋণ ছাড়ের জন্য বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়নে গতি আনতে সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পড়তির দিকে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে চাঙ্গা করাও– এই উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিবের নেতৃত্বে এই কমিটি– প্রকল্প অগ্রগতি নিয়ে দুই মাসে কমপক্ষে একটি পর্যালোচনা সভা করবে।
বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, সেগুলোর সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে কমিটির মূল কাজ। যদি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কারণে বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা থাকে– তাও গঠনমূলক আলোচনার মধ্যে দূর করার ব্যবস্থা নেবে।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারপার্সন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা কমিশনের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের সবশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
সভা শেষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম এবং কমিশনের সদস্য (কার্যক্রম বিভাগ) ও সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকার সভার বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, "তিনি বলেছেন, বৈদেশিক সহায়তার চলমান প্রকল্পগুলো আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।"
সত্যজিত কর্মকার বলেন, "উন্নয়ন সহযোগীরা আমাদের যে ঋণ দেয়, তা কিন্তু আমাদের পরিশোধ করতে হয়। এ কারণে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই কারণে প্রধানমন্ত্রী এই উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন।"
সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে বলে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান। উদারহণ হিসেবে বলা যায়, এডিবির অর্থায়নে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কথা। ২০১০ সালে এ প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই বাস্তবায়ন কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও– পরে তা বিল্মবিত হয়। ফলস্বরূপ, প্রকল্পটির জন্য এখন প্রায় ১৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে।
একইভাবে, ভারতের অর্থায়নে ২০১০ সালে শুরু হওয়া খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, প্রকল্পে বিলম্বের কারণে মোট ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা।
ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দক্ষ প্রকল্প পরিচালকদের ঘাটতি ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ত্রুটিসহ– বিভিন্ন কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়।
বৈঠকে উপস্থাপিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৩১৩.৩৩ শতাংশ বা ৮ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা বেড়েছে। কিন্তু, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে ব্যয়। গত পাঁচ বছরে, স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলির গড় মেয়াদ ৫৫.২৬ শতাংশ বেড়েছে, একইসাথে প্রকল্প ব্যয় ১৩.০৩ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি প্রকল্পে গড়ে তিনজন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব পালন করেছেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, "এখন থেকে যেকোন প্রকল্পে বাস্তবায়নের আগে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ওপর জোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরও উল্লেখ করেন, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যথাযথভাবে না হওয়ার কারণে মাঝপথে প্রকল্পে থেমে যায়, নকশার পরিবর্তন করতে হয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন বিলম্ব হয়, তেমনি ব্যয়ও বেড়ে যায়।"
তিনি বলেন, অনেক প্রকল্প পরিচালকের দক্ষতার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। এই সমস্যা সমাধানে, দক্ষ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এই প্যানেলের সদস্যদের মধ্যে থেকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হবে।
পরিকল্পনা সচিব বলেন, অর্থনৈতিক সুফল কম, বা কম গুরুত্বপূর্ণ নতুন প্রকল্প যাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রকল্প বাছাই কমিটিকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে।
আগে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের সদস্যরা নতুন প্রকল্প বাছাই করতেন। এখন থেকে কমিশনের পাঁচটি বিভাগ থেকেই একজন করে সদস্য বাছাই কমিটিতে থাকবেন। এতে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাছাই করা আরো সহজ হবে বলে জানান তিনি।
প্রকল্পের মেয়াদ কেন বিলম্বিত হয়?
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, বৈদেশিক অর্থায়নেরসহ উন্নয়ন প্রকল্প বিলম্বিত হওয়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে। বাস্তবায়নকারী সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা উভয়ের কারণেই বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়।
যথাযথ সমীক্ষা না হওয়া, ভূমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি স্থানান্তর, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বদলি, দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ, এবং প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন প্রক্রিয়ার মতোন কারণ বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনা কমিশন ও ইআরডির প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছে।
এছাড়া, উন্নয়ন সহযোগীদের প্রকল্পে তাদের কিছু শর্ত থাকে। বিভিন্ন শর্ত মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের থেকে সম্মতি নিতে হয়। এতে সময়ক্ষেপণ হয়। আবার, কখনোবা উন্নয়ন সহযোগীদের স্থানীয় অফিস দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাদের সদর দফতার থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এতেও বিলম্ব হয়।
আবার এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)-র মতো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার বাংলাদেশে কোনো অফিস নেই। সেক্ষেত্রে সম্মতি আদায়ে সময়ক্ষেপণ হয়।
গত বছরের নভেম্বরে ইআরডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এআইআইবির আঞ্চলিক কোনো অফিস না থাকায় প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে দেরী হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ বিলম্ব হওয়ার কারণে তাঁরাও কাজে উৎসাহ হারাচ্ছে এবং বাস্তবায়ন কাজও করছে ধীরগতিতে।
১৩টি প্রকল্পে ২.০৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে এআইআইবি, যেখানে বাস্তবায়নে রয়েছে ধীর গতি। ফলে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ বা ৪৫৮.৪৫ মিলিয়ন ডলার।
যদিও এসব প্রকল্পের বেশিরভাগের অনুমোদিত বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও শেষ পর্যায়ে। এই তালিকায় সিলেট-তামাবিল সড়ক চার লেনের মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রকল্প, ময়মনসিংহের কেওয়াটখালি সেতুর মতো প্রকল্প রয়েছে।
অর্থছাড় কম হওয়ার জন্য বাস্তবায়নের ধীর গতি-ই দায়ী
ইআরডির কর্মকর্তা জানান, ব্যয় করতে না পারার কারণে প্রতি অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ কমছে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমিয়ে– ৯৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৭৩ হাজার ৫০০ কোটি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
তবু বছর শেষে সংশোধিত এডিপির একটি অংশ অব্যবহৃত থেকে যায়। যেমন গত অর্থবছরে সংশোধিত বরাদ্দের প্রায় ১০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি।
ইআরডি কর্তমকর্তারা জানান, বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করতে না পারার কারণে বড় আকারের বৈদেশিক অর্থায়ন পাইপলাইনে আটকে রয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত যার পরিমাণ ছিল ৪৭.৬৩ বিলিয়ন ডলার।