'ক্রলিং পেগ' মানছে না কিছু ব্যাংক, রেমিট্যান্স ও আমদানিতে ডলারের দাম বেশি রাখা হচ্ছে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের চালু করা 'ক্রলিং পেগ' ব্যবস্থা অনুসরণ করছে না দেশের অনেক ব্যাংক। ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের এই পদ্ধতি চালুর সপ্তাহখানেক পর থেকেই বেশ কিছু ব্যাংক অতিরিক্ত দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ ও আমদানি এলসি নিষ্পত্তি করছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত তিনমাসে ধারাবাহিকভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ (গ্রস ফরেন এক্সচেঞ্জ হোল্ডিং) কমেছে। এপ্রিল শেষে ব্যাংকগুলোর এই পরিমাণ কমে ৫.০৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, গত সাত মাসের ব্যবধানে ১.১৩ বিলিয়ন ডলার কমেছে।
মঙ্গলবার (২১ মে) কিছু কিছু ব্যাংক বিদেশি এক্সেঞ্জ হাউজগুলো থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে ১১৯ টাকা দরে। এছাড়া, আমদানিকারকদের এলসি নিষ্পত্তি করেছে ১২০ টাকা কিংবা তারচেয়েও বেশি দরে। একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফরেন কারেন্সি নিয়ে কাজ করা এমন ছয়জন ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ৮ মে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ের জন্য ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা চালু করে। ক্রলিং পেগ মিড-রেট (সিপিএমআর) বা এই ব্যবস্থার আওতায় প্রতি ডলারের মাঝামাঝি বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় ১১৭ টাকা করে। যদিও এই ব্যবস্থা চালুর আগে দেশে প্রতি ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা। আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে সংস্থাটির পরামর্শ অনুযায়ী ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই ব্যবস্থার চালুর উদ্দেশ্য হলো, প্রবাসীদেরকে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করা এবং সিপিএমআর মার্জিনের চেয়ে ১ টাকা কম বা বেশিতে ডলার বিনিময় হার নির্ধারণ করা।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, দীর্ঘদিন ডলারের হার ১১০ টাকা নির্ধারণ থাকলেও অধিকাংশ ব্যাংক এই দাম অনুসরণ করেনি।
তিনি বলেন, "তখন আমরা যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেটকে অনুসরণ করেছি, আমাদেরই লোকসান গুনতে হয়েছে। কারণ এই কম রেটে ডলার সংগ্রহ করতে পারিনি।"
"কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর পর ধারণা করছিলাম সাবাই একটা নিয়মের মধ্যে চলবে। সবাই ডলারের মিড-রেট ১১৭ টাকা অনুসরণ করে এক টাকা বেশি-কমের মধ্যে থাকবে। তবে এখন অনেক ব্যাংকই অনুসরণ করছে না। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর একসপ্তাহ পর থেকেই এই রেটের অতিরিক্ত দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে।"
তিনি বলেন, "গতকাল এক্সেঞ্জ হাউজগুলো ১১৮.৬০ টাকা অফার করেছে। যদিও আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেটই অনুসরণ করেছি। তবে জেনেছি অনেক ব্যাংক ১১৯ টাকা রেটেও ডলার সংগ্রহ করেছে।"
"এরফলে মার্কেটে অসাধু প্রতিযোগীতা শুরু হবে। যখন ব্যাংকগুলো বিক্রি করা শুরু করবে, আমাদের ইনফ্লেশন আরও বাড়বে। কারণ ব্যাংকগুলো যখন বেশি দামে কিনবে, তখন সে অনুযায়ী মুনাফা করতে চাইবে," যোগ করেন তিনি।
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান টিবিএসকে বলেন, ক্রলিং পেগ চালুর দুই দিন পর্যন্ত সবাই ঠিকঠাক অনুসরণ করেছে। তারপর থেকে অনেক ব্যাংক বেশি রেটে ডলার সংগ্রহ করছে, একইসঙ্গে এলসি খুলতেও বেশি রেট নিচ্ছে।
তিনি বলেন, "শরিয়াভিত্তিক অধিকাংশ ব্যাংক এই ক্রলিং পেগ রেট অনুসরণ করছে না। যার কারণে তাদের ব্যাংকগুলো বেশি রেমিট্যান্স পাচ্ছে। তারা এই ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর আগেও বেশি দামে ডলার সংগ্রহ করেছিল।"
"ব্যাংক যখন ১১৯ টাকায় ডলার সংগ্রহ করবে, তখন এরচেয়ে বেশি দরে আমদানি এলসি সেটেলমেন্ট রেট নেবে। যদিও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকগুলোর কাছে বলছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭ টাকা বাড়িয়ে রেট ঠিক করে দিয়েছে, তারপরও কেন অতিরিক্ত দর নেওয়া হবে।"
"ক্রলিং পেগ চালুর পর কয়েকদিন ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার ইন্টার মার্কেট ভালই চলছিল। যদিও এখন কোনো গ্রাহকের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলে সেগুলোই ইন্টার ব্যাংকে লেনদেন হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ব্যাংক নির্দেশনা ছাড়াও নিজেদের প্রয়োজনে লেনদেন করছেন," যোগ করেন তিনি।
ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে
আমদানি দায় ও ঋণ পরিশোধের জন্য দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের বিদেশি হিসাবে (নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) ডলার জমা রাখে। চলতি বছরে ব্যাংকগুলোর এসব অ্যাকাউন্টে থাকা ডলারের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
বিশেষ করে, গত সাত মাসে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ কমেছে ১.১৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ 'মান্থলি মেজর ইকোনোমিক ইন্ডিকেটর্স' রিপোর্টে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
যদিও গত অর্থবছর শেষে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা ডলারের রিজার্ভ বেড়েছিল ৬ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৫.০৪ বিলিয়ন ডলারে, যা গত সাত মাস আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল ৬.১৭ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকগুলোর দায় পরিশোধের তুলনায় ডলার প্রবাহ কমে যাওয়ার সোয়াপের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার সংগ্রহের কারণে এর প্রভাব পড়েছে।
এদিকে, শরিয়াভিত্তিক একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান টিবিএসকে বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোয়াপের কারণে তাদের ফরেন কারেন্সি হোল্ডিং কমেছে। তবে এখানে যে পরিমাণটা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে ব্যাংকগুলোর ব্যবহারযোগ্য ডলার হলো ৫০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন।"
তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলোর গ্রস ফরেন এক্সচেঞ্জ হোল্ডিং রয়েছে ৫.০৪ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট ও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের (ওবিইউ) ডেবিট ব্যালেন্স এবং বিনিয়োগও রয়েছে।"