স্মৃতিতে ঢাকা
হ্যাঁ, ঢাকা শহর আমার স্মৃতিকে ঢেকে রেখেছে। যে শহরে জন্ম, যে শহরে বেড়ে ওঠা, যে শহরে যৌবন পার করে বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া, ওই শহরটা স্মৃতিতে না থাকলে আর কী-ই বা থাকবে?
আমার জন্ম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, এই ঢাকা শহরে। আমি মাত্র ১১ বছর পূর্ব পাকিস্তানে থেকেছি। তারপর বাকি জীবন স্বাধীন বাংলাদেশে কাটিয়েছি। যেহেতু ওই সময়টা আমার শৈশবকাল, তাই ওইটা আমার স্মৃতিতে হিম বরফের মতো জমে রয়েছে।
আমার স্মৃতি যেখান থেকে শুরু হয়, তা হলো পোস্তগোলা। তার আগে আমার স্মৃতিতে আর কিছু নেই-শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। স্মৃতির আলোটা ফুটেছিল ওই সময়-১৯৬২ অথবা ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি হবে। আমরা পোস্তগোলায় থাকতাম। মাঝেমধ্যে আমার চাচার বাসায় যেতাম, তারা ওয়ারীতে থাকতেন। তখন সূত্রাপুরের লোহার পুলের ওপর দিয়ে যেতে হতো এবং ওই পুলটি আমার কাছে একটি বিশাল সেতু মনে হতো। আমি আর আমার মা রিকশায় বসে থাকতাম এবং কিছু বাচ্চা এগিয়ে এসে রিকশাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিত কিছু পয়সার বিনিময়ে। তখন আমারও মন চাইত আমিও নেমে ওদের সাথে এই খেলায় যোগ দেই। তখন আমার জানা ছিল না যে এটা তাদের খেলা না, এটা বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
তারপর আমরা চলে এলাম নয়াপল্টনে। যে গলিতে আমাদের বাসা, ওই রাস্তার মাথায় একটি মসজিদ ছিল, যেটাকে সবাই বলত ছাতি মসজিদ। মসজিদটির সিঁড়ির ছাদে একটি কংক্রিটের ছাতা ছিল। আমাদের বাসার সাথেই আগাখানিদের জামাতখানা ছিল। তখন আমার স্কুল যাওয়া শুরু হয়নি। কিন্তু আমাকে এবং আমার চাচাতো ভাই-বোনদের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। আমাদের খুব প্রিয় জায়গা ছিল রমনা পার্ক। সেখানে বাচ্চাদের খেলার জায়গা ছিল; যেখানে দোলনা, সি-স ও স্লিপার ছিল। এটা এখনকার হাইকোর্টের বারের বিল্ডিংয়ের উল্টো দিকে ছিল। আরও মনে পড়ল তখন চিড়িয়াখানা ছিল যেখানে বারটা আছে, সেই জায়গায়; যেটা একটি মাঠ ছিল এবং বোধ হয় রেসকোর্সের (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অংশ ছিল। তখন রেসকোর্সে আসলে ঘোড়ার দৌড় হতো। আমার চাচারা রেস খেলতে যেতেন। মাঝেমধ্যে আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতেন।
পুরো রেসকোর্সটা কাঠের বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা ছিল এবং আমজনতা বাউন্ডারির বাইরে দাঁড়িয়ে রেস দেখত। অনেকেই দোতলায় গ্যালারিতে বসে রেস দেখতেন, তার জন্য টিকিট কাটতে হতো। টিকিট কেনার পরে কর্তৃপক্ষ একটি ছোট বইও দিতেন, যার ভেতরে ঘোড়ার নাম, তার বংশপরিচিতি, এখন পর্যন্ত কতটি রেস জিতেছে ইত্যাদি তথ্য দেওয়া থাকত। ওসব বই পড়ে আমরা ঘোড়াগুলোর নাম এবং বংশ জেনে গিয়েছিলাম। ওই রেসকোর্সে ১৪ আগস্টে কুচকাওয়াজ হতো, আমরা তা দেখার জন্য যেতাম।
রেসকোর্সের ভেতরে একটি পুকুর ছিল এবং তার পাশেই একটি পুরান মন্দির, যাকে বলা হতো রমনার কালীমন্দির। ঢাকা গেট জীর্ণ অবস্থায় ছিল, যেটা নাকি মোগল আমলে তৈরি। তখন তিন নেতার মাজার তৈরি হয়ে গেছে। একটু সামনে গেলে কার্জন হল তার রাজকীয়ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে গেলে পুরান হাইকোর্টের বিল্ডিং তার ভিক্টোরিয়ান রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রেসক্লাবের পাশে আরেকটি সুন্দর ভিক্টোরিয়ান বিল্ডিং ছিল এবং এখনো আছে, ওটা হলো চামেলী হাউস। তখন প্রেসক্লাবটা একটি লাল রঙের পুরনো বিল্ডিং ছিল। যেহেতু আমার বাবা একজন সাংবাদিক ছিলেন, আমার ওই ভবনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তার উল্টো দিকে USIS-এর লাইব্রেরি ছিল। মনে আছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লাইব্রেরিটি গেরিলা বাহিনী বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। USIS লাইব্রেরির ঠিক পিছনে একটি বিল্ডিংয়ে পাকিস্তান কাউন্সিলের লাইব্রেরি ছিল। সচিবালয় তখন এত বড় জায়গা জুড়ে ছিল না, মাত্র একটি বিল্ডিং ছিল।
আমার বড় চাচা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তখন অফিস টাইম ছিল সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। আমরা দেখতাম উনি বাসায় এসে একটা ঘুম দিয়ে আবার সুটেট-বুটেড হয়ে ক্লাবে চলে যেতেন। আমাদের কৌতূহল থাকত এই ক্লাব কী জিনিস? পরে জানলাম উনি ঢাকা ক্লাবের মেম্বার এবং সন্ধ্যার পরে ওখানে বন্ধুদের সাথে সময় কাটান। আমাদের কোনো একদিন ওই ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজকের ঢাকা ক্লাব আর ওই ঢাকা ক্লাব এক নয়। ক্লাবটি তখনো এখনকার জায়গায়ই ছিল। তখন মাত্র একটা বিল্ডিং ছিল, সাদা রঙের। মাথায় পাগড়ি পরা ওয়েটাররা খাবার পরিবেশন করত। ওই সময় আমি একবারই এই ভবনে গিয়েছিলাম। যেটাকে আমরা এখন শাহবাগের মোড় বলি। ওখানে শাহবাগ হোটেল বলে একটি হোটেল ছিল, ওটা এখন পিজি হাসপাতাল। এই মোড়ে একটি ফোয়ারা ছিল, যেটা পরে ভেঙে ফেলা হয়, কেন জানি না। ও রকম একটি ফোয়ারা এখনো বঙ্গভবনের সামনে আছে। যাই হোক হোটেল শাহবাগ ওই সময় সব চেয়ে নামী হোটেল ছিল। পরে যখন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হলো, তখন এই শাহবাগ হোটেলের গুরুত্ব কমে গেল।
আমার মনে আছে, এই হোটেলে একটি ঐতিহাসিক বিয়ে খেয়েছিলাম। নায়ক নাদীমের বিয়ে খেয়েছিলাম, আসলে বিয়েতে গিয়েছিলাম কিন্তু খাবার কপালে জোটেনি। গেট ক্রাশ হয়েছিল আর খাবার রীতিমতো লুট হয়ে গিয়েছিল।
অনেক দিন পরে সেনাকুঞ্জে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি যেই টেবিলে বসেছিলাম, ওই একই টেবিলে আমার পাশে নাদীমের স্ত্রী ফারজানা বসেছিলেন এবং উনার বাবা এহতেশামও ছিলেন। আমি তখন ফারজানাকে বললাম, আপনার বিয়ের খাবার পাওনা আছে, তখন খাবার পাইনি। শুনে খুব হাসলেন এবং বললেন আপনি একা নন, অনেক লোক পায়নি।
শাহবাগ থেকে ফার্মগেটের দিকে যাওয়ার রাস্তা, যেটাকে তখন ময়মনসিংহ রোড বলা হতো, এই রাস্তা তখনকার এয়ারপোর্ট, তেজগাঁও বিমানবন্দরের দিকে চলে যেত। সোজা গেলে ঢাকা সেনানিবাস আর ডান দিকে মহাখালী হয়ে গুলশানের দিকে। আমাদের সময় গুলশানে প্লট বরাদ্দ চলছিল। তখনো কোনো উল্লেখযোগ্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। আমার এক চাচা একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন। আমরা সবাই-চাচা, চাচি, খালা, ভাই-বোনরা মিলে সেই প্লট দেখতে গিয়েছিলাম। আমার খালাদের মন্তব্য ছিল, 'নাজমি ভাইয়ের মাথা খারাপ, এই জঙ্গলে জমি কিনেছেন।' পুরো এলাকায় শুধু কাঁঠালের গাছ দিয়ে ভর্তি ছিল।
তখনো আজকের হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্টের কাজ শুরু হয়নি। ওই রাস্তা টঙ্গীর দিকে চলে যেত, ওখান থেকে জয়দেবপুর। আমরা সব সময় জয়দেবপুরের নাম শুনতাম, যেহেতু আমার এক চাচা কন্ট্রাক্টর ছিলেন এবং তিনি জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির সিভিল কাজের ঠিকাদারি পেয়েছিলেন। মহাখালী থেকে টঙ্গী যাওয়ার পথে দুই পাশে কোনো স্থাপনা ছিল না, ধু ধু খালি পিচঢালা পথ।
হোটেল শাহবাগ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলে রেডিও পাকিস্তান ছিল, এখনো আছে ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশে। আর একটু এগিয়ে গেলে ইস্কাটন গার্ডেন। আর ওই রাস্তার ওপর হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, সরকারি আমলাদের বাসভবন, গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ, কেহকাশাঁ ইত্যাদি কঠিন উর্দু নামকরণের বিল্ডিংগুলো ছিল। আরও একটু সামনে গেলে পাক মোটর, এখনকার বাংলা মোটর। ওখানে তখন একটি বিল্ডিং ছিল, যেটার নাম ছিল জোহুরা ম্যানশন। ওই বিল্ডিংয়ে আমার বাবার অফিস ছিল।
আমি একটি স্মৃতি ভুলতে পারব না-তখন অ্যাপোলো ১১-এর মহাকাশচারীরা ঢাকায় এসেছিলেন-নিল আর্মস্ট্রং, কলিন্স, অল্ড্রিন। তারা বিমানবন্দরে নেমে একটি খোলা জিপে করে হোটেলে যাচ্ছিলেন এবং আমি জোহুরা ম্যানশনের সামনের রাস্তার ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিলাম। এই স্মৃতি ভোলার মতো নয়। এই জোহুরা ম্যানশন এখন নতুন করে একটি বিশাল ভবনে পরিণত হয়েছে জোহুরা স্কয়ার নামে।
ওই রাস্তার ওপর একটি কাবাবের দোকান ছিল, জোহুরা ম্যানশনের পাশে একটি ডোবার ওপর, নাম ছিল 'দারুল কাবাব'। আমরা প্রায় ওখানে যেতাম আর ওটা আমাদের খুব প্রিয় একটি জায়গা ছিল। দারুল কাবাবের নিচে ছোট ছোট দোকান ছিল এবং ওই দোকানগুলোর মাঝখানের পথ দিয়ে অন্য দিকে গ্রিন রোডে যাওয়া যেত। তখনকার দিনের আর একটি নামকরা কাবাবের দোকান ছিল ফার্মগেটের একটু আগে বিমানবন্দরের রাস্তায়, নাম ছিল 'শালিমার'। ওর আশে পাশে একটি বারও দেখতাম 'রেড বাটন' নামের, যেটা আমাদের জন্য একটি কৌতূহলের বিষয় ছিল।
আমি আমার জীবনের প্রথম ছবি দেখেছিলাম গুলিস্তান সিনেমা হলে। ওটা তখনকার আমলে একটি সিনেপ্লেক্স ছিল। যেহতু ওখানে দুটি সিনেমা হল ছিল, একটি গুলিস্তান আর অন্যটি নাজ। নাজে সব সময় ইংরেজি ফিল্ম রিলিজ হতো। আমার প্রথম ছবি ছিল 'বাঞ্জারন', তখনকার যুগের নামকরা নায়িকা নীলু অভিনীত আর নায়ক ছিলেন এজাজ, যিনি গায়িকা নূরজাহানের স্বামী ছিলেন।
আমরা মাসে একবার নাজ সিনেমা হলে ফিল্ম দেখতাম আর ওই একই বিল্ডিংয়ে একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্ট 'চু চিন চো'তে ডিনার করতাম। ওই দিন আমাদের ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দের হতো। এই সিনেমা হলের নিচে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল, যার নাম ছিল 'সুইট হ্যাভেন', যেখানে অনেক নামীদামি সিনেমার জগতের লোকজন আড্ডা দিত।
আমাদের আরেকটি প্রিয় জায়গা ছিল এই একই রাস্তায়, তা ছিল 'বেবী আইসক্রিম', এটা একটি আইসক্রিম পারলার ছিল। ওখানে কাচের কাপে করে আইসক্রিম পরিবেশন করা হতো। আমার প্রিয় আইসক্রিম ছিল 'টুটি ফ্রুটি'। ওই পারলারটা স্বাধীনতার পরে কয়েক বছর পর্যন্ত ছিল, তারপর বিলুপ্ত হয়ে গেল।
ওই সময় বেবী আইসক্রিম আর ইগলু আইসক্রিমের ভ্যানগুলো রাস্তায় আর মহল্লায় আইসক্রিম বিক্রি করত। যখন তারা আসত, আমরা টের পেয়ে যেতাম; কারণ, তারা ঘণ্টি বাজিয়ে ঘুরত আর বাচ্চারা ওই শব্দ শুনেই মা-বাবার কাছে আইসক্রিম খাবার আবদার করত।
গুলিস্তানের মোড়ে, রোড ডিভাইডারের ওপর একটি কামান রাখা ছিল, যাকে সবাই বিবি মরিয়াম নামে চিনত। কামানটি অনেক বছর ওখানে ছিল, পরে ঢাকা জাদুঘরে রাখা হয়েছিল। এখন ঢাকা গেটের সামনে তার স্থান হয়েছে। ওই কামানের উল্টো দিকে যেখানে এখন একটি আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটের পথ আছে, ওখানে একটি কাঠের দোতলা কটেজের মতো ছিল, যেখানে ট্রাফিক পুলিশ বসে ট্রাফিক লাইটগুলো কন্ট্রোল করত। আমি একবার ওখানে উঠে দেখেছিলাম।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউর নাম তখন জিন্নাহ এভিনিউ ছিল এবং অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অফিস ওই রাস্তার ওপর ছিল। এখনো একটি পুরনো ওষুধের দোকান আছে, যার নাম হলো 'ভাম অ্যান্ড কম্পানি'। তখন বাইতুল মোকাররম মসজিদের কমপ্লেক্স এত বিশাল ছিল না। নিচে এতগুলো দোকানও ছিল না। ঢাকা স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ হতো। আউটার স্টেডিয়াম বলে একটা বড় মাঠ ছিল, যেটা আবার পল্টন ময়দান বলেও পরিচিত ছিল। এখানে সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ হতো। মাঠের এক কোণায় একটি মসজিদ ছিল, যেটা এখনো আছে, কিন্তু বাইরে থেকে দেখা যায় না।
মতিঝিলে সব চেয়ে উঁচু বিল্ডিং ছিল ডিআইটির বিল্ডিং, যেটা এখন রাজউক ভবন বলে পরিচিত। এই ভবনে পাকিস্তানের প্রথম টেলিভিশন স্টেশন স্থাপন হয়েছিল। বঙ্গভবন আরও বড় আকারে ছিল, এটাকে গভর্নর হাউস বলা হতো। এখন যে রাস্তা পার্কের ভেতর দিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন রোডের দিকে চলে যায়, ওটাও বঙ্গভবনের অংশ ছিল। পূর্বানী হোটেল তখনো একটি ভালো হোটেল বলে পরিচিত ছিল। ওয়াপদা বিল্ডিংকে তখন বেশ বিশাল বিল্ডিং বলে মনে হতো। একটু পরে মধুমিতা সিনেমা হল ছিল, এখনো আছে।
আমরা যখন এলিফ্যান্ট রোডে চলে এলাম, ওখানকার ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বলা হতো 'প্লেন মসজিদের' রাস্তা। ওই রাস্তাটি সোজা হাতিরপুলে চলে যেত। তখনো সায়েন্স ল্যাব থেকে পিজি পর্যন্ত রাস্তাটি বানানো হয়নি। এই রাস্তা আমাদের চোখের সামনে বানানো হলো।
নীলক্ষেত বা কাঁটাবন থেকে যে রাস্তা এসে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে বের হয়, ওটা আসলে রেললাইন ছিল। কমলাপুর স্টেশন বানানোর পরে ফুলবাড়িয়া স্টেশনের আর প্রয়োজন রইল না; এই রেললাইনের ওপর দিয়ে রোড বানিয়ে দেওয়া হলো। তার আগে মতিঝিল বা ময়মনসিংহ রোডে আসার জন্য নীলক্ষেতের রেললাইনের ফটক পার করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি দিয়ে যেতে হতো। অথবা হাতিরপুলের ওপর দিয়ে যেতে হতো।
হাতিরপুলের নাম হাতিরপুল কেন হলো, তা নিয়ে অনেক গল্প আছে। কিন্তু আমি ওটার নিচ দিয়ে রেলগাড়ি চলতে দেখেছি।
আমাদের আরেকটি প্রিয় জায়গা ছিল নিউমার্কেট। তখনো ওটা এত ঘিঞ্জি ছিল না। ত্রিকোণ দুটি স্তর ছিল। ওখানে আমার বাবার একটি বইয়ের দোকান ছিল, যার নাম 'এসোসিয়েটেড ট্রেডার্স', যেটা পরে একটি ঘড়ি আর কলমের দোকানে রূপ নিয়েছিল।
ওখানে আমাদের আকর্ষণের অনেক জায়গা ছিল, যার মধ্যে একটি ছিল 'লাইট বিস্কুট ফ্যাক্টরি'-এখানে আমরা একটি 'হট পেটিস' (যেটা ত্রিকোণ আকারের হতো) খেতাম অথবা একটি ক্রিমরোল আর সঙ্গে এক বোতল ফান্টা। তা ছাড়া বইয়ের দোকান তো ছিলই, যেখান থেকে আমরা কালার পেন্সিল, ওয়াটার কালার, গল্পের বই আর মিকানোর সেট কিনতাম। মার্কেটের ভেতরে কোনো গাড়ি-সাইকেল চলত না, প্রশস্ত জায়গা, আমরা ওখানে দৌড়াদৌড়ি করতাম।
বলাকা সিনেমা হল ছিল, আমি ওখানেও কয়েকটি ছবি দেখেছি, যেমন নীল আকাশের নিচে, ক খ গ ঘ ঙ, নও নেহাল ইত্যাদি। ঢাকা কলেজের ফুটপাত ঘেঁষে চটপটিওয়ালাদের ঠেলা থাকত আর আমরা ওখানে এসে চটপটি খেতাম। হকার্স মার্কেটের দোতলায় একটি স্ট্যাম্পের দোকান ছিল, নাম এখনো মনে আছে 'ষ্ট্যাম্প কর্নার', ওখান থেকে স্ট্যাম্প কিনতাম। এলিফ্যান্ট রোডে তখন একটি বেশ ভালো রেস্টুরেন্ট ছিল, নাম ছিল 'কাম্পালা'।
কিছুদিন পরে আমরা মোহম্মদপুরে চলে এলাম, নজরুল ইসলাম রোডে থাকতাম। পুরো মোহম্মদপুরে গুটিকয়েক দোতলা বাসা ছিল। আমি ফিজিক্যাল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে ঝিগাতলার দিকে যাওয়ার রাস্তাকে দেখতাম আর চিন্তা করতাম-এই রাস্তা কোথায় যায়? মনে হতো, এই রাস্তাটি রূপকথার গল্পের পৃথিবীতে যায়। আমি জুমার নামাজ পড়ার জন্য সাতগুম্বুজ মসজিদে যেতাম; কারণ, ওখানে নামাজের পর মিলাদ হতো আর জিলাপি দিত। জিলাপি নিয়ে মসজিদের পেছনে প্রশস্ত দেয়ালের ওপর বসে জিলাপি খেতাম আর বড় পালতোলা নৌকাগুলোকে ঢেউর ওপর ভাসতে দেখতাম, এখন তো নদী দূরের কথা, মসজিদও খুঁজে পাওয়া যায় না।
একসময় বন্যার কারণে মোহম্মদপুরের ভেতরে পানি ঢুকে গিয়েছিল, তখন একটি বাঁধ নির্মাণ করা হলো-যেটা আজকের রিং রোড। তাজমহল রোডের শেষ মাথায় শিয়া মসজিদের পরে আর কোনো স্থাপনা ছিল না। অনেক নিচু জায়গা ছিল বাঁধের ওই পারে। সেখানে ধানের খেত ছিল। বর্ষার দিনে বা বন্যার সময় এই জায়গাটি বড় একটি নদীর আকার ধারণ করত। এখন ওই নদীর ওপর মোহম্মদিয়া হাউজিং, পিসি কালচার হাউজিং-আরও কত হাউজিং আছে। ওখান থেকে সবচেয়ে কাছের এলাকা ছিল একটি গ্রাম-নাম ছিল বছিলা। ওই জায়গাটি এখন বিরাট একটি শহরে পরিণত হয়েছে। আরও অনেক স্মৃতি আছে; ৬৪ বছরের স্মৃতি কয়েক পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব।