বিজ্ঞানীরা কেন চাঁদে ঘড়ি পাঠানোর কথা বলছেন!
পৃথিবীর বুকে সময় যে গতিতে যায়, পর্বতের শীর্ষে তা যৎসামান্য দ্রুত ধায়। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আপনাকে-আমাকে সময়ের এই মৃদু হেরফের নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না।
তবে মানুষ এখন মহাশূন্য দখলের দৌড়ে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্র, এর মিত্র দেশ এবং চীন চন্দ্রপৃষ্ঠে স্থায়ী আস্তানা গাড়ার জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। এ জন্য আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে তাদেরকে সময়ের 'খেয়ালখুশির' কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।
আমাদের পৃথিবীর এক দিন চাঁদে প্রায় ৫৬ মাইক্রোসেকেন্ড কম হয়। আপাতদৃষ্টিতে ৫৬ মাইক্রোসেকেন্ড অতিক্ষুদ্র প্রতীয়মান হলেও সময়ের এ হেরফের জমতে জমতে একসময় তা বড় অসঙ্গতির কারণ হতে পারে।
নাসা ও এর আন্তর্জাতিক অংশীদার মহাকাশ সংস্থাগুলো বর্তমানে সময়ের এ ধাঁধা সমাধানের চেষ্টা করছে।
নাসা'র গোডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের চান্দ্র অবস্থান, নেভিগেশন, সময় ও মান বিষয়ক প্রধান শেরিল গ্র্যামলিং বলেন, নাসা চাঁদের জন্য স্রেফ নতুন একটা 'টাইম জোন' তৈরি করার চেষ্টা করছে না। বরং চাঁদে সময় দ্রুতচলার বিষয়টি মাথায় রেখে এটি ও এর সহযোগী সংস্থাগুলো চাঁদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি 'টাইম স্কেল' তৈরি করতে চাচ্ছে।
এ টাইম স্কেল চন্দ্রপৃষ্ঠে অভিযান চালানো সব দেশ মেনে চলবে। হোয়াইট হাউজ চাচ্ছে ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ নাসা চাঁদের জন্য এমন নতুন সময়-মাত্রা ঠিক করুক। ওই বছরই পাঁচ দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো চাঁদে পুনরায় নভোচারী পাঠাতে চায় নাসা।
ভবিষ্যতে নভোচারীরা আর চাঁদে হেঁটে বেড়াবেন না। বরং তারা বিশেষ গাড়িতে চড়ে চাঁদের বুকে ঘুরে বেড়াবেন। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। 'তারা যখন চাঁদের সাপেক্ষে চলে বেড়াবেন, তখন সময়কেও চাঁদের সাপেক্ষে হিসেব করতে হবে,' বলেন গ্র্যামলিং।
প্রাচীনকালে মানুষ সূর্যঘড়ি বা পাথর সাজিয়ে সময়ের হিসাব বুঝত। তা-তেই তাদের কাজ চলে যেত। তারপর ১৪ শতকে তৈরি হলো মেকানিক্যাল ঘড়ি; তখন সময়ের হিসেব আরও সূক্ষ্মভাবে গণনা করাটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।
২০ শতকের শুরুতে সেকেন্ডের হিসেব আরও জটিল হয়ে উঠল। এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব হাজির করে জার্মান বংশোদ্ভূত এ বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানের দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলে দেন।
'বিজ্ঞানী আইনস্টানের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বরাতে জানা গেল, অভিকর্ষ সময়কে মন্থর করে দেয়,' বলেন দ্য প্ল্যানেটারি সোসাইটি'র প্রধান বিজ্ঞানী ড. ব্রুস বেটস।
পৃথিবীর 'সেকেন্ড'-এর ধারণা মানুষের তৈরি, এটার হিসেবও বেশ জটিল। তবে পৃথিবীর সময়ের হিসেবে আপেক্ষিকতার জটিলতাগুলোর সমাধান বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছেন। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কয়েকশ পারমাণবিক ঘড়ি বা অ্যাটমিক ক্লক স্থাপন করেছেন।
অ্যাটমিক ঘড়িগুলো অতিসূক্ষ্মভাবে সময়ের হিসেব করতে পারে। আর এজন্য এগুলো পরমাণুর কম্পন ব্যবহার করে। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসরণ করে এসব ঘড়ি ভূপৃষ্ঠের যত কাছাকাছি থাকে, তত ধীরে চলে।
সারাবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এসব অ্যাটমিক ঘড়ির সময়ের গড় করে পৃথিবীর জন্য বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে সম্ভাব্য নিখুঁত সময় কোঅর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম বা ইউটিসি তৈরি করেছেন। তারপরও পৃথিবীর ঘূর্ণনগতির অতি অল্প পরিবর্তনের সাপেক্ষে এ সময়ের সঙ্গেও 'লিপ সেকেন্ডে'র হিসেব যোগ করা হয়।
সমুদ্রপৃষ্ঠ আর পর্বতশীর্ষে সময়ের হেরফেরের নিয়মের দরুন পৃথিবী থেকে যতদূরে যাওয়া যায়, সময়ের পার্থক্য ততই বাড়ে। আবার আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী, ব্যক্তি বা নভোযান যত দ্রুত যায়, সময়ের গতি তত কমে যায়।
তাহলে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) ক্ষেত্রে সময়ের জটিলতা কীভাবে কাটানো হলো? ইউএস ন্যাশন্যাল ইনস্টিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি'র একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ড. বিজুনাথ পাটলা জানান, আইএসএস পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩২২ কিলোমিটার ওপরে থাকলেও এটি বেশ তীব্র দ্রুতিতে পৃথিবীকে দৈনিক ১৬ বার প্রদক্ষিণ করছে।
ফলে আপেক্ষিকতার প্রভাব উচ্চতা ও দ্রুতির সাপেক্ষে সময়ের পার্থক্য খুব বেশি থাকছে না। তাই আইএসএস-এ নভোচারীরা সহজেই পৃথিবীর সময় ব্যবহার করতে পারেন।
কিন্তু অন্য মিশনের জন্য সময় গণনা এতটা সাদাসিধা হয় না। কিন্তু এসব জটিলতা সমাধানের জন্যও বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। মহাকাশযানগুলোতে তারা অসিলেটর নামক স্বতন্ত্র একধরনের ঘড়ি যুক্ত করেছেন।
'ওগুলো [অসিলেটর] নিজেদের সময় ব্যবহার করে। কিন্তু এসব মহাকাশযান আবার পৃথিবীতে থাকা ভূ-স্টেশনের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ ওগুলো যা কিছু করছে, সবকিছুকে ইউটিসির সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে,' বলেন গ্র্যামলিং।
গত ৫০ বছর ধরে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরা জিপিএস স্যাটেলাইটগুলোতে থাকা অ্যাটমিক ঘড়িগুলোর সময়ের হিসেবও রাখছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানী পাটলা বলেন, 'আমরা সহজেই জিপিএসের ঘড়ির সঙ্গে পৃথিবীর ঘড়ির তুলনা করতে পারি। এমনকি বিজ্ঞানীরা জিপিএস'র ঘড়ির গতি কমানোর পদ্ধতিও তৈরি করেছেন বলে জানান তিনি।
কিন্তু চাঁদের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের ঘড়ির দ্রুতি কমানোর ইচ্ছে নেই। তারা বরং পৃথিবীর সময়ের সাপেক্ষে চাঁদের সময়ের সঠিক পরিমাপ করতে চান। সম্প্রতি বিজুনাথ পাটলা চান্দ্রসময়ের ফ্রেমওয়ার্কের বিস্তারিত বিবরণসহ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।
তবে চাঁদের সময়ের হিসেব নিয়ে একটি ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। তা হলো, তাদেরকে পৃথিবী থেকে চাঁদে সময় গণনার যন্ত্রপাতি পাঠাতে হবে।
চন্দ্রঘড়ি বানাতে কে বিনিয়োগ করবে, কোন ধরনের ঘড়ি চাঁদে চালু করা হবে, চাঁদের কোথায় এসব ঘড়ি বসানো হবে — এসব প্রশ্নের কোনো সর্বজনস্বীকৃত উত্তর এখনো তৈরি হয়নি বিজ্ঞানীমহলে।
চাঁদকে আবর্তন করা বিভিন্ন উপগ্রহের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঘড়ি বসানো হবে বলে জানান গ্র্যামলিং। আবার চাঁদের সুনির্দিষ্ট স্থানে, যেখানো কোনো একদিন মানুষ ভ্রমণ করবেন, সেসব জায়গাতেও এসব ঘড়ি বসানো হতে পারে।
আর দাম? মহাশূন্যে ভ্রমণের উপযুক্ত করে বানানো একটি অ্যাটমিক ঘড়ির পেছনে কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে বলে জানান গ্র্যামলিং। তবে ক্রিস্টাল অসিলেটর ঘড়িতে খরচ কিছুটা কম হবে।
কিন্তু পাটলা জানান, সস্তা অসিলেটর ঘড়িতে কয়েক মিলিসেকেন্ডের হেরফের থাকতে পারে। আর এ ব্যাপারটা মাথায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ 'নেভিগেশনের জন্য ঘড়িগুলোকে ১০ ন্যানোসেকেন্ডের কোঠায় একই ছন্দে রাখতে হবে আমাদেরকে।'
পৃথিবীর অ্যাটমিক ঘড়িগুলো যেভাবে ইউটিসির সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করে, তেমনিভাবে চাঁদে স্থাপন করা একাধিক ঘড়ির ওই নেটওয়ার্ক নতুন একটি লুনার টাইম স্কেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করবে। নতুন এ টাইম স্কেলকে নাসা ও অংশীদারেরা লুনানেট হিসেবে অভিহিত করছে।
'আপনি লুনানেটকে ইন্টারনেট — অথবা ইন্টারনেট ও বৈশ্বিক নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেমের একটি সমন্বিত রূপ হিসেবে চিন্তা করতে পারেন,' বলেন গ্র্যামলিং।
নাসার অন্য অংশীদারদের সঙ্গে চাঁদে ঘড়ি স্থাপনের আলাপ এখন পর্যন্ত 'খুব, খুব ইতিবাচক' বলে মন্তব্য করেছেন গ্র্যামলিং।