টাকা দেওয়া বন্ধ করাই কি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সংকট সমাধানের একমাত্র পথ?
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে আর টাকা না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি সহায়তা ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কি পারবে স্বাবলম্বী হয়ে ব্যবসা করতে?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে প্রথমেই নজর দেওয়া যাক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্যের দিকে। গত মার্চে ৬ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ও রূপালী ব্যাংকের অবস্থা বেশ শোচনীয় । এ দুটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৩,৩৫৮ কোটি টাকা। এ ঘাটতি মিটিয়ে ব্যাংকগুলোকে সচল রাখতে ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০১৭-১৮ অর্থবছর-- এই ১০ বছর সময়কালে সরকারকে জনগণের করের ১৮ হাজার কোটি টাকা ঢালতে হয়েছে।
বড় ধরনের সংস্কার করে লুটপাট ও দুর্নীতি বন্ধ না করে এভাবে বছরের পর বছর টাকা ঢেলে গেলেও ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো যায়নি। বিষয়টি অনেকটা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র মতোই হয়েছে!
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, “প্রকল্প যাচাই-বাছাই না করে বড় ঋণ ছাড় করার কারণেই এই দুর্দশা। ফলে অনেক ঋণ আদায় না হওয়ায় বাড়ছে খেলাপি ।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গেল মার্চে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ১,১০,৮৭৩ কোটি টাকা। এর অর্ধেকেরও বেশি ৫২ দশমিক ৯৪ ভাগের অংশীদার রাষ্ট্রায়ত্ত ৮টি ব্যাংক। বাকি ৪৭ দশমিক ৬ ভাগ ৪০টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির এক গবেষণা বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে ২২,৫০০ কোটি টাকা বিভিন্ন উপায়ে লুটপাট করা হয়েছে। এর সিংহভাগই গেছে জনতা, বেসিক ও সোনালী ব্যাংক থেকে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলছেন, “এর প্রথম দায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এবং দ্বিতীয় দায় বোর্ডের। কারণ এই দুপক্ষের যোগসাজশ ছাড়া অলাভজনক ও ভুয়া প্রকল্পে ঋণ মঞ্জুর সম্ভব ছিল না।”
তিনি আরও বলেন, প্রভাবশালী কোনো কোনো গ্রাহকের ঋণ পরিশোধ করার রেকর্ড খুবই খারাপ। আবার কোনো গ্রাহক টাকা ফেরত দেবেন না সেটা জানা সত্ত্বেও তাদের বড় অংকের ঋণ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের অধিকাংশেরই রাজনৈতিক যোগাযোগ বেশ শক্তিশালী।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে কীভাবে স্বাবলম্বী করা যায়
ব্যাংকের ভালো-মন্দের দায়ভার অনেকটাই বোর্ডের। মুনাফা হলে তার কৃতিত্ব যেমন বোর্ডের তেমনি লুটপাটের দায়ও তাদেরকেই নিতে হবে। এখন প্রশ্ন হল, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ হয় কীভাবে?
এ-বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বোর্ড সাজানো হয় সরকারের বিশ্বাসী লোকদের দিয়ে। তাই ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ কোনো ব্যবসায়ীর ঋণ-প্রস্তাব তারা ফিরিয়ে দিতে ভয় পান। ঠিকমতো প্রকল্প যাচাই-বাছাইও করেন না।”
এ-সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নিয়োগের ভার বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে দেওয়া উচিত। তাহলে অপেক্ষাকৃত দক্ষ ব্যক্তিরা বোর্ডে জায়গা পাবেন। যারা দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করবেন বলেও মনে করেন ড. সালেহউদ্দিন।
অবশ্য বিআইবিএম (বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট)এর সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর এ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সরকারি তহবিলের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদের আয়ে চলতে হলে, শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে। এটি করা সম্ভব হলে বোর্ডে কেবল সরকারের ঘনিষ্ঠরাই নিয়োগ পাবেন না, সেখানে জায়গা পাবেন নিরপেক্ষ ব্যাক্তিরাও।
এতে সুবিধা কী হবে?
ড. তৌফিক বলছেন, “অন্য পরিচালকরা বোর্ড সভায় যুক্তি-তর্ক করে ভালো প্রকল্পের পক্ষে থাকতে পারবেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে মন্দ ঋণ কমে আসবে।”
বিভিন্ন দেশের প্রসঙ্গ টেনে তিনি জানান, এই পদ্ধতি অনুসরণ করে ভারত বেশ সুফল পেয়েছে। এ কারণে আমাদের দেশের চেয়ে সেখানকার রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংকগুলো ভালো করছে, মুনাফাও করছে।
শেষ কথা
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে আত্ননির্ভরশীল করতে হলে পরিচালনা বোর্ডগুলোকে মানসিকভাবে দৃঢ় ব্যাক্তিদের দিয়ে সাজানোর বিকল্প নেই। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের সদিচ্ছার ওপর।
কিন্তু তাঁর একার পক্ষে কি সম্ভব আটচল্লিশ বছরের পুঞ্জিভূত সমস্যা দূর করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মুনাফামুখী করা? সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি বেঁকে বসেন তাহলে কী হবে?