খাকি প্যান্ট: ব্রিটিশ সামরিক পোশাক থেকে যেভাবে সাধারণের পরিধেয় হয়ে দাঁড়াল
১৯ শতকের শুরুতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নতুন এক অসুবিধার মুখে পড়ে। উপমহাদেশের রুক্ষ-পাথুরে ভূমিতে তাদের সুপরিচিত লাল ইউনিফর্ম বিপজ্জনক হয়ে উঠল। প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ বাহিনী ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেদের জাহির করার বদলে একটু রাখঢাক করে চলার বিষয়ে ভাবতে শুরু করল।
'উনিশ শতকে ছোট ছোট বিভিন্ন ঔপনিবেশিক যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী অনেক নতুন নতুন বিষয়ে ধারণা পায়। বিশেষ করে ইউনিফর্ম ও যুদ্ধের কৌশলগত নানা বিষয় নিয়ে তাদের জ্ঞান বাড়ে,' বলেন ব্রিটিশ আর্মি ইউনিফর্ম অ্যান্ড দ্য ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার: মেন ইন খাকি বইয়ের লেখক জেন টিনান।
নতুন এ সমস্যার সমাধান হয় খাকিতে। মেটে বর্ণের এ রং খুব ভালোভাবেই ভারতবর্ষের প্রতিবেশের সঙ্গে মিলে যেত।
সামরিক ইউনিফর্মের ক্ষেত্রে বিস্তৃত পরিসরে ক্যামোফ্লাজের ব্যবহার খাকি রঙের পোশাকের মাধ্যমেই শুরু হয়। ১৭৬ বছরের ইতিহাসে খাকি পোশাক সামরিক ইউনিফর্মের পাশাপাশি বেসামরিক পরিসরেও ব্যবহৃত হয়েছে অনেক।
ভারতবর্ষে কোর অব গাইডস-এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার হ্যারি লামসডেন ও তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড উইলিয়াম হডসনকে সামরিক ইউনিফর্মের জন্য প্রথমবারের মতো খাকি পোশাক ব্যবহার করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
১৮৪৬ সালে ভারতবর্ষ যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ছিল, তখন প্রতিষ্ঠা করা হয় কোর অব গাইডস। ব্রিটিশ বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করা ও স্কাউট হিসেবে কাজ করা ভারতীয় সেনাদের নিয়ে এ কোরটি তৈরি করা হয়েছিল।
কার্পাসের কাপড়কে স্থানীয় এলাকার কাদার সঙ্গে মিশিয়ে প্রথমদিকে খাকি ইউনিফর্ম তৈরি করা হতো। ২০ শতকের শুরুতে এসব পোশাক ব্রিটিশ বাহিনী ইংল্যান্ড থেকে আনা শুরু করে। ওই সময় ব্রিটিশরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতবর্ষ ও মিশরে এর কলোনিগুলো থেকে তুলা আমদানি করত।
ট্যাকটিকাল ক্যামোফ্লাজ হিসেবে সর্বপ্রথম খাকি ইউনিফর্ম প্রচুর ব্যবহৃত হয়। উষ্ণ অঞ্চলে সেনাবাহিনীর জন্য হালকা সুতার এ কাপড়ও বেশ আরামদায়ক ছিল।
১৮৯৭ সালে দেশের বাইরে থাকা সবধরনের ব্রিটিশ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের জন্য খাকি ইউনিফর্ম আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এরপর স্প্যানিশ-মার্কিন যুদ্ধে লড়াই করা যুক্তরাষ্ট্রের রাফ রাইডার্স ও বোর যুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার সেনাদের মতো অন্যান্য দেশের সেনাবাহিনীও খাকি পোশাক ব্যবহার করতে শুরু করে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর পোশাক হিসেবে খাকি রঙের ইউনিফর্ম ব্যবহার অব্যাহত থাকে। এ সময়ে খাকি পোশাকের বেসামরিক ব্যবহারও জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
খনিতে ও কৃষিকাজের জন্য খাকি জামা ব্যবহার শুরু করেন শ্রমিকেরা। আবার বিনোদনমূলক কার্যক্রম যেমন টেনিস-গলফ খেলা, হাইকিং ও ক্যাম্পিং ইত্যাদির জন্যও খাকি পোশাকের ব্যবহার দেখা যায়। ২০ শতকের শুরুতে নতুন দেশ, অঞ্চল আবিষ্কারকারী অভিযাত্রীদের খাকি পোশাকের বিভিন্ন 'রোমাঞ্চকর' ছবি বেশ ছড়িয়ে পড়ে।
খাকির এই উপস্থাপন সাধারণের মাঝে এটির আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকশ্রেণি ও অভিযাত্রী গোষ্ঠীর কাছে খাকি পোশাক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
লেভি স্ট্রসের ইতিহাসবিদ ট্রেসি প্যানেকের মতে, ১৯১০-এর দশকে লেভি স্ট্রস ঘরের বাইরের বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য পরিধানযোগ্য খাকি বাজারজাত করতে শুরু করে। এ কোম্পানির খাকি জামাকাপড় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যুদ্ধফেরত সেনা, কলেজপড়ুয়া ও ব্যবসায়িক খাতে যুক্ত মানুষদের মধ্যে।
২০ শতকজুড়ে বেসামরিক ব্যবহারে খাকি পোশাক ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে অনেক ইতিহাসবিদ বেসামরিক পর্যায়ে খাকি পোশাকের ব্যবহারের সঙ্গে ঔপনিবেশিক সময়ের সামরিক খাকির একটি সম্পর্কের দিকটি নিয়ে চিন্তা করেছেন।
লেখক জেন টিনান বলেন, '২০ শতকের শুরুর দিকের খাকিপরা নৃতত্ত্ববিদ ও অভিযাত্রীদের ছবি দেখলে আমার কাছে বিষয়টা খুব সাম্রাজ্যবাদী মনে হয়। এটা যেন তাদের অতীতের এক ধরনের খোঁয়ারি, তারা যেন নিজেদেরকে কর্তৃত্বপরায়ণ হিসেবে আলাদাভাবে তুলে ধরতে চাইছে।'