বকরি ঈদ থেকে আজকের ঈদুল আজহা
ঈদুল আজহা, অর্থাৎ কোরবানির ঈদ। রোজার ঈদের মতো এ ঈদে থাকে না মাসব্যাপী প্রস্তুতি নেওয়ার মতো আয়োজন। গরু-ছাগল কিনে সেগুলো বিতরণ আর খাওয়াদাওয়াই এই ঈদের মুখ্য বিষয়। বলতে গেলে, কোরবানি ঈদের প্রধান আকর্ষণই যেন হয়ে গেছে এখন 'গরুর মাংস খাওয়া'। রোজার ঈদে জামাকাপড় আত্মীয়স্বজন মিলে যতটা তাও আনন্দ আছে, কোরবানিতে পুরোটাই হয়ে গেছে কে কত দামে কত বড় গরু কিনতে পারে এবং সে গরুর মাংস কতটা লোভনীয় করে কতরকম পদে রান্না করা যায়, তার ওপর। কোরবানি যে ভোগ এবং রসনাবিলাসের উৎসব নয়, বরং ত্যাগেরই উৎসব, তা-ই যেন আমরা ভুলতে বসেছি আজ।
কোরবানি ঈদের মাংস বিতরণ তখন একরকম দুর্লভ ঘটনা ছিল
শত বছর আগের আর আজকের ঈদুল আজহার মধ্যে একটা বড় তফাত বোধহয় এখানেই। কোরবানি ঈদ ঘিরে এই যে আমাদের ভোগবিলাস আর খাওয়াদাওয়ার পর্ব, তা বেশিদিন আগের নয়। বিশ শতকের আগে ঈদুল ফিতর যেমন কোনো বড় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদ্যাপিত হয়নি, তেমনি হয়নি ঈদুল আজহাও। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার বাংলাদেশের উৎসব (১৯৯৪) বইয়ে লিখেছেন, 'আজকে আমরা যে ধুমধামের সঙ্গে ঈদ-উল আজহা পালন করি, তা চল্লিশ–পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্যমাত্র।' দেড় শ-দু শ বছর আগে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদ তেমনভাবে উদ্যাপিত না হওয়ার কারণ ছিল দারিদ্র্য ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। গরু কোরবানি দেওয়া কিংবা সাড়ম্বরে মাংস বিতরণ করার ব্যাপারটি তখন একরকম দুর্লভ ঘটনা ছিল। তখন সমাজের হাতেগোনা কিছু মুসলিম পরিবারের পক্ষেই সম্ভব ছিল কোরবানি করা। বলা চলে, কোরবানি ছিল নবাব পরিবারের জন্য। সাধারণ জনগণের সে পরিমাণ পয়সা ছিল না যে একটি গরু কিনে কোরবানি দেবে। যে কারণে ঈদুল ফিতর বা মোহররম নিয়ে আত্মজীবনী বা ইতিহাসমূলক বইগুলোতে যেমন চিত্র উঠে এসেছে, কোরবানির ঈদ নিয়ে তেমনটা আসেনি। আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মজীবনী আত্মকথায় লিখেছেন, 'মোহররম পর্বে আমাদের বাড়িতে এত ধুমধাড়াক্কা হইলেও দুই ঈদে কিন্তু অমন কিছু হইত না। বকরী ঈদে প্রথম প্রথম দুই-তিনটা ও পরে মাত্র একটা গরু কোরবানি হইত।'
দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ২৮ জুন ২০২৩ সালের সেকালের সাহিত্য-সাময়িকী ও রেডিওতে ঈদ উদযাপন শীর্ষক একটি মতামতে দেওয়া আছে, 'জেমস টেলরের মতে, ১৮৩৮ সালে ঢাকা শহরের বণিকদের ভেতর চার-পাঁচজন মুসলমান ও সমসংখ্যক খ্রিষ্টান ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন হিন্দু। এখনকার মতো তখন ঘরে ঘরে কোরবানি দেওয়ার মতো সমাজে তত বেশি বিত্তশালী ব্যক্তি ছিলেন না। অধ্যাপক আবদুল গফুর তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ 'আমার কালের কথা'য় লিখেছেন, 'কোরবানির ঈদ বা অন্য কোনো বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া সাধারণত গরু বা বকরি জবাই করা হতো না। হাট-বাজারে গরু বা ছাগলের মাংসও এভাবে বিক্রি হতো না তখন। বাড়িতে মেহমান এলে সাধারণত মুরগি জবাই করেই তাদের আপ্যায়ন করা হতো।' 'ঢাকা প্রকাশ' পত্রিকায় প্রকাশিত ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের সরকারি ছুটির তালিকায় দেখা যায় হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টান পর্বের জন্য ঘোষিত মোট ২৩ দিন ছুটির মাঝে ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে সরকারি ছুটি ছিল মাত্র এক দিন।'। আর এখন কোরবানির ঈদের ছুটি থাকে সারাবছরের দ্বিতীয় বড় সরকারি ছুটি। সুতরাং ঈদুল আজহার গুরুত্ব যে তখনো তৈরি হয়নি এই বঙ্গদেশে তা স্পষ্ট।
ঈদুল আজহার চাঁদ দেখা নিয়ে মতানৈক্যের ইতিহাসও রয়েছে, যা জানা যায় গবেষক অনুপম হায়াতের নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে 'ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি' গ্রন্থে উল্লিখিত ১৯২২ সালের ৩ আগস্টের দিনলিপি থেকে। সে বছর ঢাকা শহরে শুক্র ও শনিবার দুই দিন ঈদ উদযাপিত হয়। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮ জুন ২০২৩, সেকালের সাহিত্য-সাময়িকী ও রেডিওতে ঈদ উদযাপন) তবে উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে কোরবানি ঈদের কিছু চিত্র পাওয়া যায় বিভিন্নজনের আত্মজীবনীতে।
'জমিদারের তরফ হইতে উহা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল'
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার 'কাল নিরবধি' বইয়ে লিখেছেন: 'বকরিদে আমরা প্রতিবছর কোরবানি দিতাম না—মাঝে মাঝে তা বাদ পড়ত—ভক্তির অভাবে অতটা নয়, যতটা সামর্থ্যের অভাবে। বড়োরা চেষ্টা করতেন পশু জবাই থেকে আমাদের আড়াল করতে। আমরা ছোটোরা ততোধিক উৎসাহ ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে জবাই দেখে ফেলতাম। দেখার পরে কিন্তু অনেকক্ষণ বিষাদে মন ছেয়ে যেতো। তবে শেষ পর্যন্ত এই বিষণ্নতা পেছনে ফেলে দেখা দিতো কোরবানির গোশত খাওয়ার উৎসাহ।'
এই 'বকরি ঈদ' শব্দটাই এখন হয়তো অনেকের কাছে অজানা। একসময় কোরবানির ঈদকে বলা হতো বকরি ঈদ। কারণটা আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন: 'বক্রা ঈদে গরু কোরবানি কেউ করিত না। কারণ জমিদারের তরফ হইতে উহা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল। খাশি-বকরি কোরবানি করা চলিত। লোকেরা করিতও তা প্রচুর।' 'জমিদারের তরফ হইতে উহা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল' বিধায় বাংলার মুসলমানরা সাধারণত বকরি কোরবানি করত। যে কারণে ঈদের নামই হয়ে গিয়েছিল বকরি ঈদ।'
তো এখন বকরি ঈদের কড়াকড়ি আর নেই। কোরবানি মানেই এখন গরু কোরবানি। সাথে পছন্দানুয়ায়ী খাসি, মহিষ কোরবানিও দেয় অনেকে। তবে আগে কিন্তু কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলেও ঈদের নামাজ ঘিরে ছিল আনন্দ। তবে মোগল আমলে কোরবানির ঈদ পালন হতো জাঁকজমকভাবেই। ঈদুল আজহার উদযাপন নিয়ে মীর্জা নাথান লিখে গেছেন, 'সকলেই ঈদগাহ গমন করেন। ইমাম সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে খুৎবা পাঠ করেন। এই অর্থ দিয়ে বহু অভাবগ্রস্থ লোকের জীবনধারণের সংস্থান হয় এবং তারা সুখী হয়।' (যুগে যুগে ঈদ মিছিল, পৃ ৩৭)
নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী রচিত ১৯০১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় 'ঈদল আজহা' নামক গ্রন্থ। বইয়ের ভূমিকায় নবাব লিখেছেন, তার গ্রামের আশপাশে কোনো ঈদগাহ না থাকায় ১৮৯৬ সালে তিনি ধনবাড়ি গ্রামের একটি মাঠকে ঈদগাহ হিসেবে নির্ধারণ করেন। সে ঈদগাহে সর্বপ্রথম কোরবানির ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে জামাতের ইমামতি করেছিলেন নবাব সাহেব স্বয়ং নিজেই।
একসাথে ঈদের জামাতে শামিল হওয়ার এই আনন্দে কিন্তু ভাটা পড়েনি এখনও। বিশেষ করে, প্রতিবছর যারা দু ঈদে বাড়িতে ছোটে, নিজ এলাকায় ঈদের নামাজ আদায় করতে গিয়ে দেখা হয়ে যায় আশেপাশে চেনা পরিচিত সকলের সাথে। সেই সাথে কোরবানির মাংস বিতরণ। এই মাংস বিতরণপর্বেও মিশে আছে আলাদা আনন্দ। মঈদ রুমী অন্তত তাই মনে করেন। মাংস ভাগাভাগির পর পলিথিনে মোড়া সেই মাংসের প্যাকেটটি নিয়ে বাবার হাত ধরে আত্মীয়দের বাসায় দিয়ে আসার সেই স্মৃতি আজও মনে পড়ে ইঞ্জিনিয়ার মঈদ রুমীর। এখন তার দুই মেয়েই দিয়ে আসে আত্মীয়দের বাসায় বাসায়। তার মতো তার দুই মেয়েও এই মাংস দিয়ে আসাটাকে খুব উপভোগ করেন। তার ছোটো মেয়ে দীপ্র বলেন, 'আমি আমার বোনের সাথে রিকশায় চড়ে কাছাকাছি আত্মীয়দের বাসাগুলোতে যাই। দুপুরে খেয়েই মাংসের প্যাকট গুলো নিয়ে বের হয়ে যাই। দুজন মিলে ঢাকার রাস্তাজুড়ে কোরবানির আমেজ দেখতে দেখতে যাই। সবার সাথে এই উপলক্ষ্যে দেখাও হয়ে যায়। কোলাকুলি করি, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন আইটেম খাই। খুব ভালো লাগে এটা আমাদের দুজনের।'
তবে কোরবানির মাংস বিতরণে অগ্রাধিকার দেয়া হয় ছেলেমেয়ের শ্বশুরবাড়িকেই। সাধারনোত গরুর পেছনের রানটি একটি বড় ডালার ওপর হাতের নকশা করা চাদরে ঢেকে পাঠিয়ে দেন। বেয়াইবাড়ি থেকেও আরেকটি রান আসে। (যুগে যুগে ঈদ মিছিল, পৃ. ৩৭)
কোরবানির ঈদ যখন থেকে মহাসমারোহে শুরু হলো, তখন থেকেই এর একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল ভোজউৎসব। বরং বলা চলে, এখনের চেয়ে তখনই এর আয়োজন বড় ছিল। ইউটিউব আমলের মতো বিফের আফগানি কাবাব, আদানা কাবাব, বিফ স্টেক, সাসলিক ইত্যাদি এত বাহারি পদ তো আর হতোনা তখন, হতো কেবল রুটি ও মাংস। মাংসের ঝোল আর চালের রুটি ছিল কোরবানির ঈদের প্রধান খাবার। এই রুটি আর মাংসের এক পদের খাবারই খেত সবাই উপচে পড়ে। যদিও ঢাকাইয়াদের মধ্যে দেখা যেত গরুর নানা পদ, কাঁচা গোশতের কোফতা, সিদ্ধ গোশতের কোফতা, গরুর কালিয়া, খাশতা কোফতা, বুন্দিয়া, কোফতার কোরমা ইত্যাদি। ঢাকা বা অন্য জেলা, যে অঞ্চলেরই হোক, মানুষ খেতে পারতেন। তখনকার মানুষ খাওয়ার দিক থেকে যেমন ছিলেন বেহিসাবি, তেমন আয়োজনের দিক থেকেও অকৃপণ। এক বসাতেই এক কেজি মাংস ও ২০টি রুটি পেটে ভরা ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। এই উৎসাহ সমান পরিমাণে ছিল প্রতিবেশী আর অভাবী লোকদের খাওয়ানোর বেলায়ও। রুটি ও মাংস দিয়ে আদর যত্ন করে আপ্যায়ন করায় তখন ছিল না কোনো বিরক্তি বা কিপটামি।
নতুন শাড়ি পরে বউ-বিবিরা ওজু করে বিসমিল্লা বলে কোরবানির রুটি বানাতে বসতেন
জাহানারা ইমাম তার 'অন্য জীবন' স্মৃতিকথায় কোরবানি ঈদের মহাভোজ নিয়ে লিখেছেন 'কোরবানির সময় আমাদের বাড়িতে চালের আটার রুটি বানানো হত—সে একটা দেখবার মত জিনিস। রসুনের খোসার মত পাতলা রুটি, ধবধবে সাদা এবং সুগোল। বাড়ির মেয়েরা আগের রাতে বারোটা একটার সময় দহলিজের সামনের সেই যে কাজীপুকুর—সেই পুকুরটায় গোসল করে আসতেন৷ কাজী পুকুরের সানবাঁধানো ঘাট ছিল, চারকোনা পুকুরটির পাড়গুলি উঁচু ছিল, পানি ছিল পরিষ্কার টলটলে। রাত দুপুরে পর্দার হানি হবে না বলেই বোধ হয় দাদাজানের অমত ছিল না বাড়ির বউঝিদের পুকুরে গোসল করতে যেতে দিতে। গোসল করে বাড়িতে এসে নতুন শাড়ি পড়ে বউ-বিবিরা ওজু করে বিসমিল্লা বলে কোরবানির রুটি বানাতে বসতেন। আগের দিনই ঢেঁকিতে আটা কোটানো হয়েছে। রুটি বানানো হত দুশো-তিনশো!
হারাতে বসা মাংসের শুঁটকি
কোরবানির ঈদে অন্যতম আনুষ্ঠানিকতা পশু জবাই, গোশত কাটা এবং বিতরণের পর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াত এতগুলো গোশত একসাথে সংরক্ষণের বিষয়টি। আগের দিনের কোরবানি মানেই ছিল গরুর মাংসের শুঁটকি বা মাংস শুকানোর এক আয়োজন।
এখন বাড়িতে বাড়িতে ফ্রিজ, ডিপফ্রিজ থাকলেও, নব্বই দশক পর্যন্তও অনেক বাড়িতে ছিল না ফ্রিজ, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। তাই যাতে অনেকদিন পর্যন্ত এই মাংস সংরক্ষণ করা যায় সেজন্য বিকল্প ও ঐতিহ্যগত নানা পদ্ধতি জনপ্রিয় ছিল। এরমধ্যে একটি ছিল হলুদ, লবণ, মরিচ দিয়ে রোদে মাংস শুকানো, আবার বিভিন্ন বাড়িতে সুতায় গেঁথে ও চালুনিতে মেলে রোদে মাংস শুকানো হতো।
আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করত কয়দিন ধরে মাংস শুকানো হবে। গরমের দিনে দুই থেকে তিনদিনেই মাংস শুকানোর কাজ শেষ হয়ে যেত। এরপর শুরু হতো প্রতিদিন এই মাংস জ্বাল দেওয়ার পর্ব। সে ছিল এক বাড়তি ঝামেলার কাজ।
জাহানারা ইমাম 'অন্যজীবন'-এ মাংস শুকানোর স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবে, 'তারপরেও ভুনা গোশত খাওয়ার জের চলত ১০-১৫দিন। সেকালে ত' ফ্রিজ ছিল না। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা বউ-বিবিদের মস্তবড় কাজই ছিল বিরাট বিরাট ডেকচি-কড়াইতে রাখা গোশত ভাল করে জ্বাল দেওয়া। এটা বড়ই খাটনির কাজ ছিল, বিরক্তিকর তো বটেই। জ্বাল দেওয়ার দোষে অনেক সময় গোশত নষ্ট হয়ে যেত। সে জন্য খুব দায়িত্বশীল এবং জাঁহাবাজ ধরনের একজন মুরুব্বি এসবের তদারকিতে থাকতেন। কোরবানির গোশত মহরমের চাঁদে খাওয়া নাকি খুব পুণ্যের কাজ—তাই কিছুটা গোশত খুব যত্নসহকারে জ্বাল দিয়ে দিয়ে রাখা হত।'
ছোটোবেলায় যখন গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যেতেন, তখন আজাদ রহমানও দেখতেন মাংস শুকানোর নানা কায়দা। স্মৃতির ঝুলিতে যতটুকু মনে পড়ে সেখান থেকে তিনি জানান, 'গরু শুকাতে দেখেছি তিন রকমভাবে। এক হলুদ, লবণ দিয়ে মাখিয়ে শুকানো হতো। সে মাংস প্রতিদিন জ্বাল দিতে হতো। আরেকভাবে দেখেছি মাংসের সাথে হলুদ, লবণ, মরিচ দিয়ে আধাসেদ্ধ করত প্রথম দিন। এরপর সেই মাংস রোদে শুকাতো তারে বা শিকে গেঁথে। এটিই বোধহয় মাংসের শুটকি। এটা অনেকদিন সংরক্ষণ করা যেত। আরেকটা পদ্ধতি দেখেছিলাম এক বিহারি পরিবারে। তারা মাটি পুঁতে তার ভেতর একটি মাটির পাত্র রাখত। সে পাত্রে মাংস ভিনেগার দিয়ে মাখিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখত। কিন্তু এটি তারা কীভাবে এরপর খেত তা জানি না। এটি মনে হয় সবচেয়ে কম জনপ্রিয়।'
তবে এই মাংস নিয়ে মুসলিমদের অনেকের বিশ্বাস, মহররমের দিন এই মাংস খেলে সওয়াব হয়। তাই আগে দীর্ঘদিন ঘরে রান্না করে রেখে মহররমের দিন সিন্নী পাক হিসেবে বিলানো হতো এই শুকিয়ে রাখা মাংস।
জাহানারা ইমামের শিকে গাঁথা সেই ঝলসানো কলজে
এছাড়া ছিল রুটি বানানোরও রেওয়াজ। এখনও কোরবানি ঈদকে ঘিরে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে, দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের মানুষের মধ্যে এই রুটি বানানোর চল দেখা যায়। বাড়ির মেয়েরা সব কাজকর্ম সেরে বসতেন বেলুন আর পিঁড়ি নিয়ে। একসাথে কয়েকজন মিলে বানিয়ে ফেলতেন শ খানেক রুটি। ঈদের আগের রাতে বাড়িতে বাড়িতে চলত এই রুটি বানানোর ধুম। জাহানারা ইমাম লিখেছেন:
'রুটি যাতে গরম থাকে তার জন্য পুরনো শাড়িছেঁড়া কাপড় চারভাঁজ করে খুঁচির মুখে ঢাকা দেওয়া। এই কাপড়ও আগের দিন খুব ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে তুলে রাখা হয়েছে। এত বেশী রুটি বানানোর কারণ হল শুধু বাড়ির আত্মীয়-স্বজন নয়, পাড়া প্রতিবেশী, অন্য পাড়ার জ্ঞাতিগোষ্ঠী এবং গ্রামের অভাবী লোকজন সবাইকেই রুটি হালুয়া গোশত দিতে হবে। বাড়িতেও ক'দিন ধরে কেবল রুটি-গোশতই খাওয়া হবে। যত মেহমান আসবেন, সবাইকেই রুটি-হালুয়া-গোশত খাওয়াতে হবে। সে যুগে মেহমানরা বেশ ভালো করেই পেট ভরে খেতেন। খেতে পারতেনও তাঁরা সেকালে। তাই যাঁরা খাওয়াতেন, তাদের আয়োজনটাও এ রকম বিরাটই করতে হত।'
তবে জাহানারা ইমাম লিখেছেন ছোটোবেলায় খাওয়া দাওয়ার পর্বের মধ্যে তাদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ থাকত গরুর কলজে ঘিরে। তিনি লিখেছেন, '.যেখানে দহ্লিজ ঘরের পাশে আমাদের গোয়াল-বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায় একটু আগেই কোরবানি দেওয়া হয়েছে। ততক্ষণে দু'একটা গরু-ছাগলের চামড়া ছাড়ানো হয়ে গেছে, আমাদের লক্ষ্য গরুর কলজে। আমরা প্রত্যেকেই একটা করে বাটি হাতে নিয়ে এসেছি—গরুর পেট থেকে কলজে বেরোনোমাত্র একটা বা দুটো কলজে সর্বাগ্রে ছোট ছোট করে কেটে আমাদেরকে দেয়া হবে—আমরা ওগুলো নিয়ে আবার বাড়ির ভেতরে ছুটব, সেখানে নানী, ফুপু ও চাচীরা কলজেগুলো শিকে গেঁথে আগুনে ঝলসে দেবেন আমাদের। ঝলসানো কলজে দিয়ে যে মহাভোজের সূচনা হত, তা শেষ হত কোর্মা, রেজালা, কোপ্তা, কাবাব, দো-পেঁয়াজা, ঝাল-কারী দিয়ে, সঙ্গে থাকত কখনো পোলাও, কখনো পরটা এবং সদাসর্বদা সেই চালের আটার বেলা রুটি। বেলুনে বেলে বানানো হয় বলে যার নাম বেলারুটি (উচ্চারণ-ব্যালা)। এই ভোজ চলত দু'তিন দিন ধরে।'
গরুভোজের এই পর্ব এখনও বিরাজমান। না, কথাটি ভুল। বরং বলতে হয় কেবল এটিই বিরাজমান। গরুর তৈরি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রেসিপি নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে চলে এখন নানা পরীক্ষানিরীক্ষা। মা হয়তো নাস্তার জন্য বানিয়ে রাখবে কোল্ড মিট, ছেলে চাইছে স্টেক, মেয়ে চাইছে টার্কিশ রেসিপির আদানা কাবাব। আয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু সেই শিকে গাঁথা ঝলসে কলজে খাওয়ার উচ্ছ্বাস, ফুপু -চাচিদের পাশে বসে বেলারুটি বানাতে দেখার আনন্দ আর দেখা যায় না ছোটোদের মাঝে। আর বড়দেরও থাকে না আগেকার দিনের সেই ধৈর্য, শক্তি, সময়।
তবে আগের মতো এখনো রাজধানী ফাঁকা হয়ে যায় ঈদের দুদিন আগেই। সারা বছর যে যেখানেই থাকুক না কেন, একসঙ্গে কোরবানি দেওয়ার খেয়ালে সবাই গ্রামে ফেরে। পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করে নেয় ঈদ আনন্দ। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে এই পারিবারিক মিলনমেলা এবং পরবর্তী সপ্তাহ পর্যন্ত খাবার আয়োজন, তার মধ্য দিয়েই যেন একালের ঈদেও আসে পূর্ণতা।
কোরবানির গরুর রোগমুক্তির জন্য কবি সেবার বাড়িতে মুর্শিদা গানের আসর বসিয়েছিলেন
এখন তো কোরবানির বড় বড় হাট বসে পথে পথে। হৃষ্টপুষ্ট গরুর গলায় ঝোলানো হয় বাহারি মালা। গরুর নামগুলোও হয় বাহারি। মহারাজ, রাণী, টাইগার, সুলতান, নবাব, কালা তুফান কিংবা কখনো তারকাদের নামে শাকিব খান, জায়েদ খান, পরীমনি, বুবলী ইত্যাদি। লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হয় এসব গরু, কখনো বা বসে নিলাম। কয়টি গরু কিনছেন, গরু না মহিষ না উট এসবের যেমন প্রতিযোগিতা আছে, তেমনি আছে কয় লাখ টাকা দিয়ে কত বড় গরু কেনা যায় সে প্রতিযোগিতাও।
এখন তো গরু অনলাইনেও পাওয়া যায়। গত বছর পাইলট প্রকল্প হিসেবে ডিজিটাল হাটের সূচনা করা হয়েছিল। সে বছর বেশ ভালো সাড়া পাওয়ার কারণে এ বছরেও একই উদ্যোগ নেয়া হয়। পশুর হাটে নারী ক্রেতাদের উপস্থিতি তো ছিলই, অনলাইন হাট হওয়ায় নারী উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে দেখা যায় এবার। তবে গরুর দরদাম, কেনা ও ভোজ নিয়ে সব আগ্রহ থাকলেও গরু কোরবানির মর্মান্তিকতা এখনো মনে দাগ কেটে যায় ছেলেবুড়ো কমবেশি সবারই। যদিও গরু কেনার পর থেকে যে খারাপ লাগা শুরু, তা শেষ হয় সেই গরুর মাংসের ঢেঁকুর তোলার মাধ্যমেই।
কবি জসীমউদ্দীনের গরুপ্রীতি নিয়ে আছে মর্মভেদী এক গল্প। একবার নাকি কোরবানির ঈদে ১১০ টাকা দিয়ে একটা বাছুর কিনেছিলেন। নাম রেখেছিলেন গৌরী। অনেক ডাক্তার, বৈদ্য ডেকে, ওষুধপথ্যি, গরম পানি, তুলা, ব্যান্ডেজ নিয়েও শেষমেষ বাঁচানো যায়নি তাকে। কথিত আছে, গৌরীর রোগমুক্তির জন্য কবি নাকি সেবার বাড়িতে মুর্শিদা গানের আসর বসিয়েছিলেন। সারারাত জিকির এবং চিৎকার করে মোনাজাত করেছিলেন।
গরু কোরবানির এই মর্মান্তিক স্মৃতি নিয়ে প্রায় সব ঘরেই কোনো না কোনো গল্প পাওয়া যাবে। গ্রামের দিকে অনেকে কবির মতোই গরু কিনে মাসব্যাপী লালন পালন করে এরপর হয়তো বিক্রি করে দেয়, কিংবা শখের প্রাণীটিকে কোরবানি দেয়। নিজের সন্তানের মতো বড় করে তোলা গরুটি নিজ হাতেই কোরবানি বা কারো কাছে বিক্রি করে দিতে হয়। এই কষ্ট এতটাই অসহনীয় যে, একবার নাকি ফজলে মিয়া নামের এক ব্যাক্তি এই শোকে মারাই গিয়েছিলেন। নিজের গরুটির কোরবানির দিন তিনি নিজেও পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। (২৩ জুন,২০২৩, কেমন ছিল সেকালে বাংলার কোরবানির ঈদ, প্রথম আলো)
বেশিরভাগ শহুরে বাসিন্দাই এখন এক-দুদিন আগে গরু খামার থেকে এনে নিজ বাড়িতে রাখে। অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে তো গরু গ্যারেজেই থাকে। নিচের ড্রাইভার,কেয়ারটেকার বা দারোয়ানরাই দেখেশুনে রাখেন। নিজ হাতে দেখাশোনা না করলেও কোরবানির গরু ঘিরে এক বিষাদ্ঘন অনুভূতি আর সেই এক-দুদিনের স্মৃতিও আমাদের কান্না ধরে রাখতে পারে না।